নগরে ক্ষুধার্ত পেটে রাত কাটে ৮% পরিবারের, খাদ্যহীন ১২% পরিবার

দেশের মহানগরগুলোতে ৮ শতাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই রাত কাটাতে হয়েছে। এছাড়া প্রায় ১২ শতাংশ পরিবারে কোনো খাবারই ছিল না। এর বাইরেও প্রায় তিন শতাংশ পরিবারের সদস্যদের দিন-রাত কোনো সময়ই কোনো খাবার জোটেনি। দেশের অন্যান্য মহানগরগুলোর তুলনায় খাদ্য সংকটে ভুগতে থাকা এমন পরিবারের সংখ্যা ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘নগর আর্থসামাজিক অবস্থা জরিপ-২০১৯’ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। গত বছরের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই জরিপটি চালানো হয়।

দেশের নগরগুলোতে মানুষের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি তুলে আনতে আটটি বিভাগীয় শহরের ৮৬টি নমুনা এলাকায় জরিপটি পরিচালনা করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এসব এলাকায় ২ হাজার ১৫০টি পরিবারের (নগরাঞ্চলের খানা) তথ্য সংগ্রহ করা হয় জরিপের আওতায়। তাতে নগরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য, সঞ্চয় ও ঋণ পরিস্থিতি, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, পানি ও পয়ঃব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর প্রভৃতি বিষয়ের চিত্র উঠে এসেছে।

এই জরিপের অংশ হিসেবে নমুনা পরিবারগুলোকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— ‘গত ৩০ দিনে পর্যাপ্ত খাবার না থাকার কারণে আপনি বা আপনার পরিবারের কোনো সদস্য কি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে গিয়েছিলেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবেই ৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের কোনো না কোনো সদস্যকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এই সংখ্যা ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরের নগরগুলোতে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

একই জরিপে অংশ নেওয়া ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, জরিপে অংশ নেওয়ার আগের একমাসের কোনো না কোনো সময় তাদের ঘরে কোনো ধরনের খাবারই ছিল না। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এই হার ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ। ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে এই হার ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ।

বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে, জরিপে অংশ নেওয়া নগরাঞ্চলের পরিবারগুলোর মধ্যে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ পরিবার বলছে— তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য থাকবে কি না, সেটি নিয়ে তারা শঙ্কিত। আর ২০ দশমিক ৬৪ শতাংশ পরিবার বলছে, তারা পছন্দসই খাবার খেতে পারেন না। এর বাইরেও তিন বেলা খাবার খাওয়ার জন্য একেক বেলায় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে ১৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ পরিবারকে। আর অপছন্দের খাবার খেতে হয়েছে ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ পরিবারকে। প্রয়োজনের তুলনায় কম খেয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ পরিবার। বিবিএসের জরিপ বলছে, পরিবারগুলো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার জন্য খাবারের গুণগত মান কিংবা খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।

বিবিএসের এই জরিপে আটটি বিভাগীয় শহরকে জরিপ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে নিম্ন আয়ের অংশকে প্রাধিকার দিয়ে নগরাঞ্চলের খানা তথা পরিবার নির্বাচন করা হয়। উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আয়— এই তিনটি স্তরে নির্বাচন করা হয় নমুনা পরিবার। প্রতিবেদনে বিবিএস মহাপরিচালক মো. তাজুল ইসলাম বলছেন, দেশের সিটি করপোরেশন এলাকাগুলো থেকে কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড পারসোনাল ইন্টারভিউ (ক্যাপি) মোবাইল অ্যাপে ২০টি মডিউলে দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামান্য ক্ষুধার্ত বা ক্ষুধার্ত নয়— এমন পরিবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৯৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে বাকি নগরগুলোতে এর পরিমাণ ৯৫ দশমিক ১০ শতাংশ। সার্বিকভাবে এই হার ৯৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। মোটামুটি ক্ষুধার্ত পরিবারের হার ঢাকা-চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। আর তীব্র ক্ষুধার্ত পরিবার ঢাকা-চট্টগ্রামে শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ, ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ।

জানতে চাইলে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, জরিপে যে তথ্য পাওয়া গেছে, আমরা সেই তথ্যই প্রকাশ করেছি। এখনো দেশে অতিদরিদ্র মানুষ রয়েছে। তারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন। তাদের এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে। এছাড়া ভাসমান মানুষ, অথবা যারা কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে নগরগুলোতে আসেন, তারা এসেই তো কাজ পান না। তখন তাদের মধ্যে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়।

প্রতিবেদনে উঠে আসা আরও কিছু পরিসংখ্যান

প্রতিবেদনে বলা হয়, নগর এলাকায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো খুব সীমিত পরিসরে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি যে কর্মসূচিগুলো নগরে দেখা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি। জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলোর মাত্র ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এই সুবিধা নিচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রামে এর পরিমাণ মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ, ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরের নগরগুলোতে ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নগরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী বয়সের ৯৩ শতাংশ শিশু এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী বয়সের ৬৮ শতাংশ শিশু স্কুলে যায়। অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার প্রবণতার বিপরীতে মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কম।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের চিত্র বলছে, প্রায় ৬৭ দশমিক ২৩ শতাংশ পরিবার অন্য পরিবারের সঙ্গে টয়লেট ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে থাকে। বাইরের নগরগুলোতে এই হার ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। নগর অঞ্চলের পরিবারগুলোর পানি, পয়ঃব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যবিধি সুবিধা সম্পর্কে বলা হয়েছে, নগরের ৮৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ পরিবারের টয়লেটের পাশে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, যা ঢাকা-চট্টগ্রামের পাশাপাশি অন্য নগরগুলোতেও প্রায় সমান।

এছাড়া ৯০ শতাংশ পরিবারে হাত ধোয়ার স্থানে পানির উপস্থিতি রয়েছে, হাত ধোয়ার স্থানে সাবান বা এ জাতীয় পণ্যের উপস্থিতি রয়েছে ৬৬ শতাংশ পরিবারে। আর নগরে পানি সরবরাহের সুবিধা পেয়ে থাকে ৯১ দশমিক ৫৬ শতাংশ পরিবার, যা ঢাকা-চট্টগ্রামে ৯২ দশমিক ৯ শতাংশ ও বাইরের শহরগুলোতে ৮৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর নগরগুলোতে ৪৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ পরিবারে স্যানিটারি ল্যাট্রিন, ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ পরিবারে পাকা ল্যাট্রিন (পানি নিরোধক), ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ পরিবারে পাকা ল্যাট্রিন (পানি নিরোধক নয়), শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ পরিবারে কাঁচা স্থায়ী ল্যাট্রিন ও শূন্য দশমিক ০৬ শতাংশ পরিবারে কাঁচা অস্থায়ী ল্যাট্রিন রয়েছে। শূন্য দশমিক ০৬ শতাংশ পরিবারে ল্যাট্রিন নেই।

জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৩১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের ঘরে টেলিভিশন নেই, নেই পৃথক রান্না ঘরও। যদিও জরিপে অংশ নেওয়া ৯৯ দশমিক ৬১ শতাংশ পরিবারই বলছে, তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রায় সবাই জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন। সৌর বিদ্যুৎ ও অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ পান মাত্র শূন্য দশমিক ০৩ শতাংশ পরিবার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরের পরিবারগুলোতে প্রতি মাসে জনপ্রতি ব্যয় চার হাজার ৪২ টাকা। অন্য নগরগুলোতে এর পরিমাণ তিন হাজার ৬৮৩ টাকা। সার্বিকভাবে সব নগর মিলিয়ে জনপ্রতি খরচ মাসে ৩ হাজার ৯৬৬ টাকা। এর মধ্যে সিংহভাগ— ২ হাজার ২৭ টাকা খরচ হয় খাবারের পেছনে, যা মোট খরচের ৫১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর বাইরে

বাড়িভাড়ায় ব্যয় ২১ শতাংশ ও চিকিৎসায় ব্যয় ৫ শতাংশ। অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাড়ি ভাড়া দিতে হয় অনেক বেশি।

পেশার বিষয়ে বলা হয়েছে, নগরাঞ্চলে ঝুঁকি প্রবণতার মধ্যে থাকা পরিবারগুলোর পরিবারপ্রধানের পেশার মধ্যে বেতনভিত্তিক কাজ করেন ২৫ শতাংশ, ২০ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এছাড়া ১৮ শতাংশ আত্মকর্মসংস্থান ও ১৫ শতাংশ দিনমজুর হিসেবে নিয়োজিত। এছাড়া ১৬ শতাংশের বেশি পরিবারপ্রধান কোনো ধরনের আয়ের সঙ্গে যুক্ত নন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সবগুলো নগরের ৯৮ শতাংশ পরিবারের বাসগৃহে ঢেউ টিন, সিআই শিট, ইট, সিস্টেম বা কংক্রিটের উপকরণে তৈরি স্থায়ী দেয়াল রয়েছে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ