লিখেছেন জান্নাতুল নাঈম পিয়াল
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কাছে নির্মম পরাজয়ের পর, জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশীদের ‘শুয়োর’ বলে গাল দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি এখনো অনেক পাকিস্তানির কাছেই বাংলাদেশীদের পরিচয় হলো ‘ভুখে নাঙ্গে বাঙ্গালি’! কিন্তু আসলেই কি বাংলাদেশীদের তাতে কিছু যায় আসে? বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ও মানব উন্নয়ন সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে ঢের এগিয়ে বাংলাদেশ। আর শুধু কি নিজ দেশেই বাংলাদেশীদের এত উন্নতি? না, দেশের পাশাপাশি প্রবাসেও পাকিস্তানিদের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশীরা। যেমন ব্রিটেনে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুই দেশের নাগরিকরাই বাস করে বটে, কিন্তু বাংলাদেশীদের ধারেকাছেও নেই পাকিস্তানিরা। শিক্ষাই বলুন, কিংবা অর্থনীতি, পাকিস্তানিদের পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশীরা।
বাংলাদেশীদের কাছে পাকিস্তানিদের এই হার মানার চিত্র উঠে এসেছিল ২০১৫ সালে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছিল, ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীরা কেবল পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীদেরই পেছনে ফেলেনি, তারা এমনকি পরাস্ত করেছে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদেরও। তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, সে বছর ব্রিটেনে বসবাসরত ৬১ শতাংশ বাংলাদেশী ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা পাঁচটি ভালো জিসিএসই লাভ করেছে। সেই তুলনায় পাকিস্তানিদের মধ্যে এই অর্জন ৫১ শতাংশ। এমনকি ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের এই অর্জনও ৫৬ শতাংশ, অর্থাৎ বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের চেয়ে ৫ শতাংশ কম।
পারিবারিক উপার্জনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশী পরিবারগুলোর গড় উপার্জন পাকিস্তানি পরিবারগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়াওজুন লি তার এক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন, বাংলাদেশী ও পাকিস্তানিদের গড় আয়ের ব্যবধান ক্রমশই বাড়ছে। শ্রমশক্তির বাজারেও ইতিপূর্বে যেসব জায়গা পাকিস্তানিদের দখলে ছিল, সেগুলো এখন চলে আসছে বাংলাদেশীদের কব্জায়।
ঘরের মাটিতে বাংলাদেশীরা কীভাবে পাকিস্তানিদের চেয়ে এগিয়ে গেছে, সে বিষয়ে তো অনেক গবেষণাই হয়েছে। কেন পাকিস্তানের উন্নয়নকর্মী জাইঘাম খান টক-শোতে এসে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতি আহবান জানান, পাকিস্তানকে যেন বাংলাদেশ বানিয়ে দেয়া হয়, তা-ও এখন কারো অজানা নয়। কিন্তু ব্রিটেনের মতো একটি বহুসাংস্কৃতিক দেশেও কীভাবে বাংলাদেশীরা পাকিস্তানিদের চেয়ে সবদিক থেকেই এতটা এগিয়ে গেল, তা অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগায়।
ব্রিটেনে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, দুই দেশের মানুষদেরই বেশ বড়সড় সম্প্রদায় রয়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ৪,৪৭,২০১। অপরদিকে পাকিস্তানির সংখ্যা ছিল ১১ লক্ষ ২৫ হাজারের মতো। দক্ষিণ এশীয় হওয়ার সুবাদে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই বেশ কিছু সাদৃশ্য বিদ্যমান। কিন্তু আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্যও লক্ষণীয়। এবং সম্ভবত সেইসব বৈসাদৃশ্যই পাকিস্তানিদের চেয়ে বাংলাদেশীদের এগিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশী ও পাকিস্তানিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিলটি হলো, দুই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই মূলত একটি নির্দিষ্ট কাজের সাথে জড়িত। পাকিস্তানিরা যেমন ট্যাক্সিক্যাব চালানোকে প্রাধান্য দেয়, তেমনই বাংলাদেশীদের পছন্দের পেশা হলো রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। আবার পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশীরা অধিকাংশই উঠে এসেছে নিজ নিজ দেশের কোনো নির্দিষ্ট প্রত্যন্ত অঞ্চল বা শহর থেকে। অধিকাংশ পাকিস্তানি প্রবাসীরই আদি নিবাস হলো পাকিস্তানের মিরপুর। আর অধিকাংশ বাংলাদেশীই এসেছে সিলেট থেকে।
পাকিস্তানি প্রবাসীরা ব্রিটেনে আসতে শুরু করে ১৯৬০’র দশকে, এবং তারা সমগ্র ব্রিটেন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে শুরু করে। বেশিরভাগ পাকিস্তানিই তখন কাজ নিয়েছিল টেক্সটাইল সেক্টরে। অপরদিকে বাংলাদেশীরা, বিশেষত সিলেটিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ব্রিটেনে পাড়ি জমাতে থাকে ৮০’র দশকে। ততদিনে ব্রিটেনে টেক্সটাইল শিল্প ইতিমধ্যেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। আর যতটুকু যা কাজের সুযোগ ছিল, তা তো পাকিস্তানিরা আগে থেকেই দখল করে বসে ছিল। তাই শুরুতে বাংলাদেশীদেরকে খানিকটা বিপাকে পড়তে হয়েছিল বটে, তবে এই ব্যাপারটি তাদের জন্য একপ্রকার শাপে বরই হয়েছিল। অন্য কোথাও সুবিধা হবে না এমন আশঙ্কা থেকে, বেশিরভাগ বাংলাদেশীই আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিল লন্ডন কিংবা এর আশেপাশের এলাকায়, যেখানে স্কুল ও শিক্ষার মান উত্তরাঞ্চলের শহরগুলো, অর্থাৎ যেখানে পাকিস্তানিরা থাকত, সেখানকার চেয়ে তুলনামূলক ভালো ছিল।
অধিকাংশ বাংলাদেশীই তাদের প্রাথমিক নিবাস হিসেবে বেছে নেয় লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকাকে। সবাই এক জায়গায় কিংবা কাছাকাছি থাকার কারণে, বাংলাদেশীদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য সৃষ্টি হয়। যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশীরা পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়াতে পারত। ফলে বাংলাদেশ ছেড়ে এতদূরের একটি শহরে গিয়েও, সেটিকে আপন করে নিতে বাংলাদেশীদের খুব বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এই সুবিধাটি পাকিস্তানিরা পায়নি। তারা সংখ্যায় হয়তো বাংলাদেশীদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে, তাদের মধ্যে একতা খুব একটা ছিল না।
এখানে একটি বিষয় স্বীকার করে নেয়া ভালো। লন্ডনের বাংলাদেশীরা যে ইতিমধ্যেই সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে গেছে, এমনটা কিন্তু দাবি করা যাবে না। বেশিরভাগ পাকিস্তানিরই যেমন ব্রিটেনে নিজস্ব বাড়ি আছে, বাংলাদেশীদের বেলায় তা সত্যি না। এখনো এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশীই নিজের বাড়ির বদলে সোশ্যাল হাউজিংয়ে বসবাস করে। অথচ স্থানীয় ব্রিটিশদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ সোশ্যাল হাউজিংয়ে বসবাস করে। অর্থাৎ এই একটি দিকে বাংলাদেশীরা পাকিস্তানি ও স্থানীয় ব্রিটিশ উভয়ের চেয়েই এখনো পিছিয়ে আছে।
অন্যদিকে স্থানীয় ব্রিটিশদের চেয়ে বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি পরিবারগুলো একটি দিকে সমান পিছিয়ে আছে। তা হলো, নারীদের কর্মসংস্থান। বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি উভয় সম্প্রদায়েই দেখা যায় যে, অনেক নারীই কোনো উপার্জনমূলক কাজের সাথে জড়িত নয়। এর ফলে বাংলাদেশী ও পাকিস্তানিদের পারিবারিক আয় বৃদ্ধির সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়ে।
তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানিদের চেয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশীরা। শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা পাকিস্তানিদের চেয়ে ছেলে-মেয়ের মধ্যে অনেক কম বৈষম্য প্রদর্শন করে। বরং বাংলাদেশীদের মধ্যে দেখা যায় যে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই পড়ালেখায় অনেক ভালো করছে। শেষ পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে হয়তো এখনো বাংলাদেশী নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি নিয়ন্ত্রণধারী পদে আসীন হয়, তারপরও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নারীরা সামগ্রিকভাবে ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ভূমিকা রাখছে। শিক্ষার বিষয়টি অন্য আরেকভাবেও বাংলাদেশীদের জন্য সহায়ক হচ্ছে। ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ার ফলে, সেই সাথে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার সুবাদে, বাংলাদেশীরা নিজ সম্প্রদায়ের বাইরেও অন্যান্য সম্প্রদায় এবং স্থানীয় ব্রিটিশদের সাথে ভালো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে, ফলে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে। অথচ বেশিরভাগ পাকিস্তানীদের যোগাযোগ, বন্ধুত্ব ও বিচরণ এখনো কেবল নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
আরেকটি বড় কারণ হলো বিয়ে। অনেক পাকিস্তানিই এখনো ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়া সত্ত্বেও নিজ দেশ থেকে নারী বা পুরুষকে বিয়ে করে আনে। সে কারণেই, ব্র্যাডফোর্ডের মতো জায়গায়ও এখনো অধিকাংশ পাকিস্তানিই প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী। অথচ ১১ লক্ষাধিক পাকিস্তানি পাঁচ প্রজন্ম ধরে ব্রিটেনে বাস করে বলে, বেশিরভাগ পাকিস্তানিরই এখন অন্তত দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসী হওয়ার কথা। একই কথা বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যে, অনেক বাংলাদেশীই দেশে এসে বিয়ে করে স্বামী বা স্ত্রী নিয়ে যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে অনেক। অনেক বাংলাদেশী যেমন ব্রিটেনে বসবাসরত অন্য বাংলাদেশী প্রবাসীকে বিয়ে করে, তেমনই কিছু বাংলাদেশী আবার ব্রিটেনের স্থানীয়দেরও বিয়ে করে। ফলে পাকিস্তানিদের চেয়ে কয়েক প্রজন্ম পরে ব্রিটেনে যাওয়ার পরেও, অনেক বাংলাদেশীই এখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসী।
মূলত শিক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে কার্পণ্য না করা, এবং অর্থ উপার্জনের জন্য অপেক্ষাকৃত টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী পেশাকে বেছে নেয়াই ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ। তবে এখনো বাংলাদেশীদের অনেক দূর যাওয়া বাকি। নারী কর্মসংস্থানে যদি বাংলাদেশীরা আরো উদারমনা হয়, এবং মুসলিম মানেই জঙ্গী এমন মনোভাব দূর করতে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের সাথে আরো বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশীরা হয়তো শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও শুধু পাকিস্তানিদের কেন, স্বয়ং ব্রিটেনের স্থানীয়দেরকেও হার মানাতে সক্ষম হবে।