নঈম নিজাম : সময়টা এখন ভীষণ খারাপ। এই খারাপ সময়ে আপনাদের একটি গল্প শোনাই। গল্পটা পুরনো। ছোটবেলায় দাদির কাছে শুনেছি। হঠাৎ মনে পড়ে গেছে। ঘুম পাড়ানোর আগে দাদি আমার বোন ও আমাকে গল্প শোনাতেন। একদিন শোনালেন ছাগলের গল্প। আমি বললাম, দাদি, ছাগল আর গাধার গল্প শুনব না। রাজার গল্প শুনব। ঘুমানোর আগে আমার পছন্দ ছিল রাজার গল্প।
রাখাল বিস্ময় নিয়ে এবার বলল, রাজামশাই, এখন যাবেন না। রাজা বললেন, কেন যাব না? তোমার কি সমস্যা? জবাবে রাখাল বলল, আবহাওয়া ভালো না আজ। একটু পরই বৃষ্টি নামবে। রাজা বিস্মিত হলেন রাখালের কথায়। প্রধান আবহাওয়াবিদ ও মন্ত্রী জানিয়েছেন আজ ঝকঝকে রোদ থাকবে। কোথাকার কোন রাখাল কী বলে এসব! রাজা গুরুত্ব দিলেন না রাখালের কথায়। তিনি সামনের দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরই ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। রাজা সেদিন ছাতা নিয়েও বের হননি। ভিজতে হলো। ভিজতে ভিজতে রাজা বাড়ি ফিরলেন ভয়ানক অবস্থায়।
রাজসভার সবাইকে গালাগাল করলেন ছাতা না নেওয়ার জন্য। এর কিছুদিন পর রাজা সেই রাখালকে ডাকলেন রাজদরবারে। রাখাল করজোড়ে বলল, রাজামশাই, আমি কি কোনো ভুল করেছি? যদি করে থাকি ক্ষমা করে দিন। আমার বউ-বাচ্চা আছে। রাজা বললেন, ভুল করনি। তুমি শুধু বল কী করে সেদিন আমাকে আবহাওয়ার আগাম খবর দিয়েছ?
এভাবে আগাম খবর দেওয়ায় আমি আজ তোমাকে প্রধান আবহাওয়াবিদ করে দিলাম। আবহাওয়াবিদ কী জিনিস ভালো করে জানে না রাখাল। তাই ভয়ে ভয়ে বলল আসল কথা। বলল, হুজুর! সেদিন বৃষ্টির আগাম খবর দেওয়ার কৃতিত্ব আমার না। আমার ছাগলের।
রাজা বললেন, কীভাবে তোমার ছাগলের! ব্যাখ্যা করে বল। রাখাল বলল, বৃষ্টি আসার পূর্বমুহূর্তে আমার ছাগলটি সব সময় মুতে দেয়। তাই দেখে আমি বুঝি বৃষ্টি আসছে। সেদিন আপনি শিকারে যাওয়ার মুহূর্তে দেখলাম ছাগল মুতছে। তাই সাহস করে আপনাকে বলেছিলাম, কই যান বৃষ্টি আসার মুহূর্তে? আসলে আগাম আবহাওয়ার খবর দেওয়ার মূল কৃতিত্ব আমার ছাগলটার। আমার না। রাজা এই খবরে আরও খুশি হলেন। মূল খবর প্রদানকারীকে পাওয়া গেছে। বিলম্ব করলেন না আর রাজামশাই।
সঙ্গে সঙ্গে ছাগলকে বসিয়ে দিলেন আবহাওয়া মন্ত্রণালয়ে। আর রাখালকে বানালেন প্রধান আবহাওয়া কর্মকর্তা। এই গল্পের আরেক অংশ পরে শুনেছি, একই ধরনের। ধোপা ও গাধাকে নিয়ে। ধোপা এভাবে রাজাকে বৃষ্টির খবর দেয়। রাজা পরে গাধাকে দিলেন মন্ত্রণালয়ে। আর ধোপাকে করলেন আবহাওয়াবিদ।
জানি, আজ চারদিকে সবাই ভীষণ বিপদে। হঠাৎ কেন যেন এই গল্পটা মনে পড়ে গেল। মনটা আসলে ভালো নেই। বিষণœতা পেয়ে বসেছে আমাকেও। এই খারাপ সময়ে কিছু মানুষের কা-কীর্তিতে মন খারাপ হয়ে যায়। বেদনায় ছুঁয়ে যায় মন। আমরা বের হতে পারছি না নিষ্ঠুর মানসিকতা থেকে। ক্ষমতার দম্ভ থেকে।
কবিগুরু বলেছেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে… নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ- সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।’ একটা ভয় কাজ করছে। এ ভয় আগামীর অজানা দিনগুলো নিয়ে। কোথাও কোনো ভালো খবর নেই। সারা বিশ্ব থেকে কেবলই খারাপ খবর আসছে। ভয়ঙ্কর একটা সময় অতিক্রম করছি সবাই। এমন খারাপ সময় আর আসেনি।
যুদ্ধ ছিল, মহামারী ছিল, সবকিছু কখনো স্তব্ধ হয়নি। সবার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে ভয়ভীতিতে। বাস্তবে এই পৃথিবী কি অন্ধকারে তলিয়ে যাবে? মানুষের কণ্ঠস্বর কি চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে? শহরগুলো কি চলে যাবে আগামীর গবেষণায়? হয়তো একদিন টিকে থাকা আগামী প্রজন্ম গবেষণা করবে। তারা লিখবে, আমাদের পূর্বপুরুষরা একদা পৃথিবীতে বাস করত।
করোনা ভাইরাস নামের এক ভয়ানক মহামারি সবাইকে শেষ করে দেয়। কেউ কল্পনায়ও আঁচ করতে পারেনি এমন ভয়ঙ্কর কিছুর। সবার দিন কাটত ক্ষমতার দাম্ভিকতা আর পৃথিবী জয়ের। তারা লিপ্ত ছিল হানাহানি আর প্রতিহিংসায়। নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসে গবেষণা করত বিভিন্ন ভাইরাস নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ায়নি।
বাড়িয়ে দেয় অন্যায়-অবিচার। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় ভাইরাস দিয়ে মানবহত্যার। মানুষের অহংকার ছিল চিকিৎসা-বিজ্ঞান জয়ের। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নেওয়ার। গড় আয়ু বাড়ানোর। নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কারের। আধুনিক অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলার। মানুষের এই ভয়াবহতায় আধুনিক সভ্যতা লুণ্ঠিত হয়। বিপন্ন হয়ে পড়ে আর্তমানবতা।
মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশে। ভয়ানক পরিস্থিতিতে বিশ্ব হয় লন্ডভন্ড। মানবসভ্যতা চলে যায় তলানিতে। চিকিৎসাবিজ্ঞান কিছুই করতে পারেনি। বিশ্ব মোড়লরা অসহায়ত্ব নিয়ে ঘরে ঢুুকে যান। কারও ক্ষমতারই মূল্য ছিল না দুই পয়সার।
আমরা কেউই এড়াতে পারছি না বিশ্ববাস্তবতাকে। সামান্য সর্দি-কাশি, গলাব্যথা হলে ভয় ধরে যাচ্ছে। ভাবনায় আসছে এই বুঝি শেষ হয়ে গেলাম! ভীতির রাজত্ব আজ বিশ্বজুড়ে। অসুস্থ সাধারণ মানুষ হাসপাতালে ফোন করলে উত্তর আসে, আপনি বাসায় থাকুন। বের হবেন না। আমরা আপাতত কিছু করতে পারছি না। সারা দুনিয়ার হাসপাতালগুলোর একই চিত্র।
উন্নত বিশ্বের চিকিৎসকরাও প্রকাশ করছেন নিজেদের অসহায়ত্ব। অনেক চিকিৎসক-নার্স আক্রান্ত হচ্ছেন। মারাও যাচ্ছেন। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় অন্যরাও বলছেন, কিছুই করার নেই। গরিব ও মাঝারি দেশের ডাক্তাররা অপেক্ষায় আছেন চিকিৎসাসামগ্রীর। ক্ষমতাবানরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। মৃত্যুর ভয়াবহ মিছিল এখন যুক্তরাষ্ট্রে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের গলায় হম্বিতম্বি নেই। মুসোলিনির দেশ ইতালির প্রেসিডেন্ট তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। মেডিকেল সায়েন্স বলছে, আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা অপেক্ষায় থাকুন। রাষ্ট্রনায়করা ঘরে ঢুকে গেছেন। কেউ জারি করছেন কারফিউ। আবার কেউ বলছেন, বলার কিছু নেই, করার কিছু নেই। জনপ্রতিনিধিরা চিন্তায় আছেন নিজেদের জান বাঁচানো নিয়ে। কেউ কেউ প্রতিদিন ভিডিওবার্তায় উপদেশ দিচ্ছেন।
কেউ বলছেন, আপনারা ভালো থাকুন। কিন্তু মানুষ আজ ভালো নেই। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর বাতাসে শুধু লাশের গন্ধ। ঘরে ঘরে কান্নার রোল। লাশের শেষকৃত্যও কেউ করতে পারছে না। প্রিয়জনরা পারছে না অংশ নিতে। পিতার লাশ কীভাবে দাফন হলো জানে না পুত্র। আর পুত্রের খবর জানে না পিতা। মা জানে না সন্তানের কথা। সন্তান জানে না মায়ের কথা।
লন্ডন, নিউইয়র্ক থেকে বন্ধুদের ফোন আসে। সবাই বলছে, ভালো নেই। বাংলাদেশিরাও মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি অনেকে। কার কী হবে কেউ জানে না। বুকটা ভেঙে যায়। হায়রে আমার আগামীর বিশ্ব।
মানবতার এই ভয়াবহ বিপদে সবাই অসহায়। এই ভাইরাস আপন -পর চেনে না। বিত্তবান-বিত্তহীন জানে না। সরকারি দল-বিরোধী দল মানে না। রাজা-প্রজা-মন্ত্রীকে তোয়াক্কা করে না। সামান্য অসচেতনতা দেখলেই হামলা করছে। প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে। শেষ করে দিচ্ছে। পালানোর পথ নেই। চাইলে কেউ যেতে পারছে না এক দেশ থেকে আরেক দেশে।
নিজস্ব অবস্থানেই থাকতে হচ্ছে। অর্থবিত্ত-ক্ষমতা সবকিছু আজ মূল্যহীন। ফ্লাইট উড়ছে না। থেমে যাচ্ছে সব কোলাহল। দিল্লি গেট এখন মানবশূন্য। আগ্রার তাজমহলে কেউ নেই। দুনিয়ার কোনো সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ নেই কারও। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন স্তব্ধ। ইতালির ভেনিস থমকে গেছে। জুরিখ, জেনেভার লেকের রাজহাঁসগুলো অদ্ভুত নীরবতায় অবাক চোখে দেখছে কোথাও কেউ নেই।
প্যারিসের আইফেল টাওয়ার আগের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে ভুতুড়ে এক শহরে। লন্ডন টাওয়ার ব্রিজ, নিউইয়র্কের মাথা উঁচু করে থাকা লিবার্টি অব স্ট্যাচুর আজ মাথা নিচু! বন্ধ হয়ে গেছে প্রার্থনালয়। থমকে গেছে মসজিদের আজান, মন্দিরের ঢাকের শব্দ আর গির্জার ঘণ্টা। লকডাউনে সবকিছু স্তব্ধ। অঘোষিত অথবা ঘোষিত কারফিউ মাথায় নিয়ে সবাই ঘরে বন্দী।
প্রিয়জন, অফিস-আদালত থেকে সবাই বিচ্ছিন্ন। স্বেচ্ছায় গৃহবাসী। ভ্যাটিকান সিটি স্তব্ধ। মক্কায় তাওয়াফ, মদিনায় জিয়ারত বন্ধ, মসজিদে নেই নামাজ- কখনো কেউ ভেবেছিলেন এমন হবে? মানুষের কীসের এত বড়াই! এখনো মানুষ জানতে পারেনি মালয়েশিয়ার নিখোঁজ ফ্লাইটটি কোথায়? বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যই থেকে গেল।
সূরা আরাফের ৯১ নম্বর আয়াতে পরিষ্কার বলা আছে, ‘তারপর আমার ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করে ফেলল। ফলে তারা তাদের নিজেদের ঘরেই মৃত অবস্থায় উল্টে পড়ে রইল।’ সূরা ইউনুসের ১৩ নম্বর আয়াতে বলা আছে, ‘অবশ্যই আমি তোমাদের আগে বহু জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যখন তারা সীমা অতিক্রম করেছিল।’
সূরা আরাফের ১৩৩ নম্বর আয়াতে বলা আছে, ‘শেষ পর্যন্ত আমি এই জাতিকে পোকামাকড় বা পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত, প্লাবন ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দিয়ে ক্লিষ্ট করি।’ সূরা ইবরাহিমের ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘জুলুমকারী বা ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের সম্পর্কে তুমি কখনো মহান আল্লাহকে উদাসীন মনে করবে না।’
কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন,
“তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।
সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।
জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোৎস্না আমার’
কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।”
আল্লাহ বিপদ দেন, আবার উদ্ধারও করেন। আর উদ্ধার করেন বলেই মানবজাতি টিকে আছে। ছোটবেলায় মাঝরাতে অসুস্থ হলে মনে হতো এই রাত শেষ হচ্ছে না কেন? মা বলতেন, বাবা! একটু ধৈর্য ধর, অন্ধকারের পরই আলো আসবে। সূর্য উঠবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কাছে মনে হতো, অন্ধকার রাতের কোনো শেষ নেই। দুঃখের রাতগুলো সহজে শেষ হয় না।
অনেক আত্মীয়ের মৃত্যুর রাতে পাশে ছিলাম। দেখতাম সেই রাত শেষ হতে চাইত না। একটু আলোর জন্য আকুতি নিয়ে অপেক্ষা করতাম। সে অপেক্ষা শেষ হতো না। বিশ্বাস ছিল, একসময় অন্ধকার কাটবেই। ভোরের আলো ফুটবেই। এখনো বিশ্বাস করি, এ পৃথিবী একদিন স্বাভাবিক হবে। কেটে যাবে সব সংকট, মানুষের এই দুঃখ-কষ্ট। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের দূরে সরাবে।
হয়তো তত দিনে বদলে যাবে অনেক কিছু। পরিবর্তন আসবে বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে। আমরা হয়তো হারাব আমাদের অনেক প্রিয়জনকে। তত দিনে নিজেরাও থাকব কিনা জানি না। হয়তো এ লেখাও হতে পারে শেষ লেখা আমার কিংবা আপনার জন্য। তবু বলছি, আবার পূর্বদিগন্তে লাল সূর্য ছড়াবে আলোকরশ্মি। নতুন সূর্যের আলো দেখতে চাইলে আমাদের সতর্ক হতে হবে।
সচেতন থাকতে হবে। এই দুঃসময়ে হিংসা-বিদ্বেষ, গুজব ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। সবাই বাড়িতে থাকুন। অন্যের প্রতি সহনশীল হোন। পারলে দাঁড়ান অসহায় মানুষের পাশে। মানুষই পারবে বিপর্যয় রোধ করতে। হয়তো সময় লাগবে। থাকি না সেই সময়ের অপেক্ষায়। সলিল চৌধুরী লিখেছেন, ‘ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রি এখানে থেমো না/এ বালুর চরের আশার তরণি যেন বেঁধো না’।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।