‘ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা’—কথাটা অনেকের কাছেই আপ্তবাক্য। এর সঙ্গে খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ, ধর্মঘট—শব্দগুলো একেবারেই বেমানান। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে অনেক সময়ই তা করতে বাধ্য হয়েছেন ক্রিকেটারেরা। দীর্ঘদিন পর এবার যেমন তা দেখা গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। ১৯ বছর আগে একবার ধর্মঘট দেখেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পাঁচ মাস আগে সেই ধর্মঘট শেষ হয়েছিল বোর্ড ও খেলোয়াড়দের মধ্যে সমঝোতায়। এবার কী ঘটবে?
বিসিবির নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও দেশের ক্রিকেটের নানা অসংগতিতে ভীষণ অসন্তোষ বইছে ক্রিকেটারদের মধ্যে। দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটই ডেকে বসেছেন সাকিব-তামিমরা। ১১ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেটীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা থেকে তাঁরা বিরত থাকবেন। এবারের এই ঘটনার ছয় বছর আগে ২০১৩ সালেও একবার প্রতিবাদ জানিয়ে বিসিবি কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়েছিলেন ক্রিকেটারেরা।
সে আন্দোলন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের প্রতিশ্রুতির মুখে আর খুব বেশি এগোয়নি। আসলে নানা অনিয়ম ও অন্যায়ের বিপক্ষে সব দেশেই নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে থাকেন ক্রিকেটারেরা। আর ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে যাওয়াও নতুন কিছু না। ইতিহাস বলছে, ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের প্রথম ধর্মঘট দেখা গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে। অঙ্কের হিসেব মতে, ধর্মঘটে যাওয়ার পথটা ১২৫ বছর আগেই দেখিয়ে গেছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারেরা।
বিলি মারডক। ভিক্টর ট্রাম্পার আসার আগে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন এই মারডক। ১৮৮৪ সালে ঘরের মাঠে মারডকের নেতৃত্বে অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। পাঁচ টেস্টের সে সিরিজে প্রথম ম্যাচের অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচের দলকে মেলানো যায় না। আকাশ-পাতাল পার্থক্য! প্রথম টেস্টে খেলানো একাদশের কেউ ছিলেন না দ্বিতীয় টেস্টে। একসঙ্গে অভিষেক ঘটেছিল নয়জন ক্রিকেটারের।
আগের টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্ব দেওয়া মারডকের জায়গা নিয়েছিলেন টম হোরান। এ যেন ২০০০ সালে এমসিসির বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচের আগে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের সেই ধর্মঘটের মতো। এমসিসি অধিনায়ক মিনাল প্যাটেলের সঙ্গে সেদিন টস করতে নামা খেলোয়াড়টিকে বাংলাদেশের কোনো সাধারণ দর্শক চিনতে পারেননি। চেনাটা কঠিনই ছিল। প্রথম বিভাগের উত্তরা স্পোর্টিং দলের অধিনায়ক মাহফুজুর রহমানকে সেদিন নামতে হয়েছিল টস করতে। কারণ জাতীয় দল তো বটেই, একজন বাদে প্রিমিয়ার লিগের কোনো ক্রিকেটারকেই সে ম্যাচের জন্য পাওয়া যায়নি। নিজেদের দাবি আদায়ে আন্দোলনরত ক্রিকেটাররা সেদিন গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেছিলেন।
সেদিন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটারেরা আসলে মারডকদের দেখানো পথেই হেঁটেছিলেন। যদিও মারডকদের দাবিটা ছিল ভিন্ন। প্রথম টেস্টের পর মারডকের নেতৃত্বে ম্যাচের ‘গেট মানি’র (টিকিট বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ) ৫০ শতাংশ অর্থ দাবি করেছিল অস্ট্রেলিয়া দল। দাবি না মানায় মেলবোর্ন টেস্টে খেলতে নামেনি মারডকের দল। হোরানের নেতৃত্বে ১০ উইকেটে হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। তৃতীয় টেস্টে নিয়মিত খেলোয়াড়দের বেশির ভাগ দলে ফিরলেও মারডক সে সিরিজে ফেরেননি। ছয় বছর পর (১৮৯০) তাঁকে আবারও দেখা গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে। এর দুই বছর নাগরিকত্ব পাল্টে ইংল্যান্ডের হয়েও একটি টেস্ট খেলেছিলেন মারডক।
সে ঘটনার দুই বছর পর খেলা থেকে ধর্মঘটে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরাও। ১৮৯৬ সালে অ্যাশেজ সিরিজে শেষ টেস্টের আগে ম্যাচ ফি দ্বিগুণ করার দাবিতে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন পাঁচ ‘প্রফেশনাল’ ক্রিকেটার। ইংল্যান্ডের ‘প্রফেশনাল’ ক্রিকেটারেরা তখন টেস্ট ম্যাচ প্রতি ১০ পাউন্ড করে পেতেন। অন্যদিকে একই দলে ‘অ্যামেচার’ হিসেবে খেলা ডব্লিউ জি গ্রেস তাঁদের চেয়ে বেশি অর্থ পেতেন। এ ব্যাপারটি ভালো লাগেনি বিলি গান, জর্জ লোহম্যান, টম রিচার্ডসন, টম হেউইড ও ববি অ্যাবেলদের।
খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন কেরি প্যাকার। অস্ট্রেলিয়ান টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল নাইন’-এর এ মালিক ১৯৭৭ সালে খেলাটির সম্প্রচার স্বত্ব কিনতে ব্যর্থ হন। এ কারণে গ্রেগ চ্যাপেল, ক্লাইভ লয়েড, ইমরান খানদের মতো ক্রিকেটারদের লোভনীয় অঙ্কের চুক্তিতে উড়িয়ে এনে জন্ম দিয়েছিলেন কেরি প্যাকার ওয়ার্ল্ড সিরিজের। ১৯৮৯ সালে বিসিসিআইয়ের সঙ্গেও পারিশ্রমিক নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছিল ভারতীয় দল। বোর্ডের চুক্তিপত্রে কিছু শর্ত নিয়ে অসন্তোষ ছিল ক্রিকেটারদের মধ্যে। বোর্ডে নির্দেশ অমান্য করে ঘরের মাঠে সিরিজ চলাকালীন সংবাদপত্রে লিখে ছয় মাস নিষিদ্ধও হয়েছিলেন সাবেক ক্রিকেটার দিলীপ ভেংসরকার।
এ ছাড়াও ১৯৯৭ সালে অ্যাশেজ সিরিজের আগে পারিশ্রমিক নিয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন দেশটির খেলোয়াড়েরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডে তো মাঝে মধ্যেই এমন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন ধর্মঘট প্রায় দুই দশক পর দেখা গেলেও ক্ষোভটা কিন্তু মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন ক্রিকেটারেরা। ক্ষোভ জমতে জমতে এই বিস্ফোরণ!