জসিম মল্লিক
(পূর্ব প্রকাশের পর…)
আমি কেমন করে বেঁচে আছি
১. বাবা তুমি কিন্তু আজকে ড্রাইভ করছ না।
আমি কিছুতেই অরিত্রিকে ৪০১ এ গাড়ি ড্রাইভ করতে দিতে চাচ্ছি না। ৪০১ পৃথিবীর ব্যস্ততম হাইওয়ে। ছয় সাত লেনে গাড়ি চলে। সোঁ সোঁ করে গাড়ি যায়। বড় বড় লড়ি চলে। ১২০কি.মি বা তার বেশি স্পীড সব গাড়ির! আমরা যাব অটোয়া। চার ঘন্টার ড্রাইভ।
আমি কিছুক্ষন করি! কিংষ্টন পর্যন্ত। দু’ঘন্টা মাত্র। তারপর তুমি ড্রাইভ করো।
নো বাবা। নো। তোমার ব্যাক পেইন। তোমার সমস্যা হয়, আই নো।
সমস্যা হবে না পারব।
কিন্তু অরিত্রি আমাকে ড্রাইভিং সীটে উঠতেই দিল না। নিজেই উঠে বসে আছে এবং পুরোটা চালিয়ে অটোয়া নিয়ে গেলো। চমৎকার ড্রাইভ করেছে। আমি মনে মনে খুশী হলাম। একজন নির্ভরযোগ্য ড্রাইভার পাওয়া গেলো।
কখনো যদি ভারী কিছু নিতে যাই অর্ক বা অরিত্রি যদি সাথে থাকে আমাকে নিতে দেয় না। হাত থেকে কেড়ে নেয়।
তোমার ওয়েট লিফট করা নিষেধ। কেনো কথা শোনো না!
কিন্তু ওরাতো এখন থাকে না। বাজার সদায় করতে হয়। তখন কিছু না কিছু ওয়েট ক্যারি করতেই হয়। জেসমিন সাথে থাকলে নিজেই ক্যারি করে।
২. এতো সাবধানতা সত্ত্বেও কি ব্যাক পেইন ভাল হয়ে গেছে! না। যায় নি। ভোগায় খুউব। শুধু ভোগায়। গত তেত্রিশ বছর ধরে ভোগাচ্ছে। যাদের ব্যাক পেইন আছে এই পোষ্টটি শুধু তাদের জন্য। কারন তারাই বুঝতে পারবেন এর কষ্ট। আসলে যার যেটা নাই সে সেটা বুঝবে না। সব অসুস্থ্যতাই কষ্টের। এরচেয়েও অনেক অনেক কষ্ট নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। কোনোটাই কোনোটার চেয়ে ছোট নয়। মানুষের অনেক কষ্টের কথা আমরা জানি না। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে এই পৃথিবীতে আমরা জন্মেছি কি রোগে শোকে কষ্ট পেয়ে গত হওয়ার জন্য!
ছবিতে এতো এতো ওষুধ দেখে নিশ্চয়ই আপনারা ঘাবরে গেছেন! এটা বানানো কিছু না। সত্য। যখন যেটা দরকার হয় সেটা ব্যবহার করি। যখন যেটা মনে হয় খাই। শুধু ওষুধ খাওয়া আর ব্যবহার করাইতো না, আরো অনেক কার্যক্রম আছে। লেখার চেয়ারে আছে বিশেষ ব্যাক সাপোর্ট। গাড়ির ড্রাইভিং সীটেও তাই। শোওয়ার জন্য তিন ধরনের বেড আমার। একটা বেডে মেমোরি ফোম ও পিলো, একটায়ে অর্থোপেডিক ম্যাট্রেসেস এবং একটা ফ্লোরে শক্ত বিছানা। যখন যেটায় ইচ্ছা করে ঘুমাই। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন ইপসন সল্ট দিয়ে গরম পানিতে বাথটাবে ডুবে থাকি। হট ওয়াটার শেক নেই। ফিজিও থেরাপি দেই। আকু পাংচার করার কথাও ভাবছি। হোমিওপ্যাথিকও খেয়েছি।
৩. তরুন বয়স থেকেই আমার ব্যাক পেইন। ১৯৯০ সালে আমার একটা সার্জারি হয়েছিল। তারপর থেকে মোটামুটি ভাল ছিলাম। মাঝে মাঝে ব্যাথা হতো। কিন্তু কখনো ব্যাথা পুরোপুরি আমাকে ছেড়ে যায়নি। এখনতো আরো আকড়ে ধরে বসে আছে। কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না। মনে হচ্ছে আর ছেড়ে যাবেও না। তাকে দুরে সরিয়ে রাখার জন্য কত চেষ্টাই না করে যাচ্ছি। তাও কি ছেড়ে যায়! যায় না। আসে, যায় আসে এভাবে তামাশা চলছে। ব্যাথাকে শায়েস্তা করার জন্য যেসব দাওয়াই চলছে তার একটা ফিরিস্তি দেই।
ব্যাথা যখন থাকে তখন নানা ধরনের জেল যেমন ভলটারেন বা ভলিজেল লাগাই। মুভ স্প্রে করি, লাকোটা লাগাই। কখনো কখনো ব্যাক ব্রেসেস পড়ে ড্রাইভ করি না হয় হীটওয়ারপস। স্যালোনপাস প্যাচ লাগাই কখনো। প্রতিদিন অন্ততঃ একবার ডা. হো’স এর পেইন থেরাপি টেন্স+ইএমএস+পালস ম্যাসেজ করি। ইন্ডিয়া থেকে আনিয়েছি আর্য়ুবেদিক অয়েল এবং ইউনানি ট্যাবলেট। বাম লাগাই দুই তিন প্রকার। এছাড়াও অল্প ব্যাথায় টাইলেনল আর তীব্র ব্যাথায় হাই পাওয়ারের ন্যাপ্রোক্সিন খাই। নিয়মিত খাই ক্যালসিয়াম, ওমেগা থ্রি ফীস ওয়েল, মাল্টি ভিটামিন এবং গ্লুকোসামিন(ভিটামিন ডি যুক্ত)। সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে খাই আদা, হলুদ, রসুন গোলমরিচ, মধু ইত্যাদির মিক্স। নিয়ম করে স্ট্রেস করি।
জানি এই পোষ্ট পড়ে অনেকেই বিরক্ত হচ্ছেন। আগেও অনেকবার ব্যাকপেইন নিয়ে লিখেছি। এসব নিয়েই বেঁচে আছি। ঘুরছি, ফিরছি, লিখছি, আপনজনদের কষ্ট দিচ্ছি। লম্বা লম্বা জার্নি করছি।
শরীর আর মন ওপপ্রোতভাবে জড়িত। শরীর মনকে দারুভাবে প্রভাবিত করে। আমার করে। শরীর খারাপ থাকলে আমি বিপর্র্যস্তবোধ করি। জীবন সর্ম্পকে আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়। এই ব্যাথা নিয়েও ৩০টির মতো বই লিখেছি। লেখা না থাকলে জীবন হতো আরো দুর্বিসহ। একদিন অলৌকিক কিছু ঘটবে এই স্বপ্ন দেখি।
টরন্টো ১৯ জুলাই ২০১৯
এভাবে দিন যায়, দিন আসে
১. প্রায় একমাস পর ডেক্সটপের সামনে বসলাম। চেয়ার টেবিলে বসলেও টের পাচ্ছি কী বোর্ড চালাতে মোটেও স্বচ্ছন্দবোধ করছি না। অক্ষরণ্ডলো কোথায় যেনো লুকিয়ে আছে। এলোমেলো লাগে। চোখে ঝাপসা দেখি। যেখানে যেটা থাকার কথা সেখানে সেটা আছে ঠিকই কিন্তু আমারই সমস্যা হচ্ছে খুঁজে পেতে। স্মুথলি হচ্ছে না। টের পাই এখনও মাথা ঝিম ঝিম করে, শরীর টল টল করে। বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে পারি না। শুয়ে থাকলেও কাশির দমকে খাবি খাই। গত এক সপ্তাহ ধরে বলতে গেলে চেতন ও অবচেতনের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় আছি। কখন সকাল হয়, কখন দুপুর বা কখন রাত টের পাইনা! এভাবে দিন যায়, দিন আসে। কারো ফোন ধরতে পারি না।
১৮ তারিখ টরন্টো ফিরেছি হজ্জ থেকে। তারপর থেকেই এই অবস্থা। পরদিনই গেলাম ডাক্তারের কাছে। গিয়ে দেখি আমার ফ্যামিলি ডাক্তার ভ্যাকেশনে। ওয়াকিংএ একজন ডাক্তারকে দেখালাম আমরা দুজনই। বললাম ঠান্ডা, কফ, চোখে ইনফেকশন। সবকিছু তিনি মন দিয়ে শুনলেন। কিন্তু কোনো ওষুধ দিলেন না। বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। তার পরের চারদিন খুব খারাপ গেলো আমাদের। বেঘোরে পড়ে থাকি কাউচে। কখন রাত ফুরিয়ে সকাল হয়, সকাল ফুরিয়ে দুপুর টেরও পাই না। তীব্র এক কষ্ট। চোখ বন্ধ করলেই কী সব চোখের সমানে ভেসে উঠে। স্পষ্ট নয় কিছুই। অবর্ণনীয় এক কষ্টের অনুভূতি।
২. অর্ক অরিত্রি প্রতিদিন ফোন করে। আসতে চায়। আমরা মানা করি। ওরা আক্রান্ত হোক আমরা চাই না। অরিত্রি বলল, বাবা আবার ডাক্তারের কাছে যাও। এন্টিবায়োটিক লাগবে। অন্য ডাক্তার দেখাও। আমরা তাই করি। গতকাল অন্য ডাক্তার দেখাই আমি আর জেসমিন। ডাক্তার সবকিছু ভালমতো চেক করলেন। জেসমিনকে বললেন তোমার নিমুনিয়া। আমারও ইকফেকশন। চোখের জন্য অরিত্রি প্রথম দিনই ওভার দ্য কাউন্টার থেকে এন্টিবায়োটিক এনে দিয়েছিল। ডাক্তার বলল এটা ঠিক আছে, ব্যবহার করো। তোমার চোখ ক্লিয়ার হচ্ছে। তারপর দুজনকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ দিলেন। অথচ প্রথম দিন ডাক্তার তেমন কিছু বললেন না। এমনটা হচ্ছে কানাডায় আজকাল। ক্রস চেক করতে হচ্ছে!
৩. ১৮ তারিখ সকাল আটটায় আমাদের ফ্লাইট ল্যান্ড করে। ওরা চারজনই এসেছিল ফুল নিয়ে এয়ারপোর্টে। আমি যখন মক্কা থেকে জেদ্দা যাচ্ছিলাম তখনই টের পাই যে আমার চোখ আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পরবতী ৩২ ঘন্টায় চোখের কোনো ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব হয় না। জেদ্দা এয়ারপোর্টেই বসে ছিলাম ৮ ঘন্টা। তারপর দু’ঘন্টা জেদ্দা থেকে কায়রো ফ্লাইট। কায়রোতে আরো ছয় ঘন্টা লেওভার। কায়রো এয়ারপোর্টে কোনো ম্যাডিক্যাল সুবিধা পেলাম না। ইজিপ্টএয়ারের ফ্লাইটে উঠেও কোনো আই ড্রপ জাতীয় কিছু না পেয়ে হট ওয়াটার সেক দিলাম। তাতে কিছুটা আরাম পাই। জেদ্দায়ও একবার দিয়েছিলাম।
কায়রো থেকে বারো ঘন্টার জার্নি শেষ করে টরন্টো পৌঁছাই। তারপর ঘরে ফিরে ক্লান্তিতে লুটিয়ে পরি বিছানায়। গত তিন সপ্তাহ কিভাবে সময় পার হয়েছে জানিনা। কোনো কিছু ভাবার সময় ছিল না। চারঘন্টার বেশি
ঘুমাইনি। যতদিন মক্কা বা মদিনায় ছিলাম জাগিতক কিছুই মাথায় ছিল না। অরিত্রি ওষুধপত্র এনে দিয়ে যায়, বেবির বাসা থেকে সাত আট দিনের খাবার নিয়ে আসে। আহারে ছেলে মেয়েণ্ডলারে ঠিকমতো দেখতেও পাই নাই। জেসমিন কিছুতেই ওদের আসতে দিতে চায় না। মায়ের মন। যদি ওরা অসুস্থ্য হয়! তাও অরিত্রি পরশুও এক ঝলক এসেছিল।
গত একমাস ফেসবুকে তেমন নিয়মিত ছিলাম না। মক্কা বা মদিনায় বসে কখনো সখনো এক আধটু উঁকি দিয়েছি। কখনো আপডেট দিয়েছি। আর টরন্টো ফিরে গত একসপ্তাহতো একটা ঘোর ঘোর পৃথিবীতে বাস করছি। ঘুসঘুসে জ্বরে আক্রান্ত হলে মাথা স্বাভাবিক থাকে না। কোথায় যেনো হারিয়ে যাই। চোখ বন্ধ করলেই অস্পষ্ট ভেসে উঠে কিছু মানুষ, কিছু অচেনা জায়গা, কিছু কোলাহল।
ফোনের ছোট্ট মনিটরে চোখ রাখি ফাঁকে ফাঁকে। বন্ধুদের পোষ্ট দেখি। সবকিছুই আগের মতো। কিছুই বদলায়নি। নতুনত্ব কিছু নাই। আমার যেসব বন্ধুরা আগে যেমন ঘন্টায় ঘন্টায় পোষ্ট দিতেন এখনও তাই দেন। ওসব পড়ে আমার কষ্টের দিনণ্ডলো কাটে। আশার কথা হচ্ছে এন্টিবায়োটিক ওয়া্ক করতে শুরু করেছে সম্ভবত। আলহামদুলিল্লাহ। তবুও এক একটা দিনকে বড় দী্ঘ মনে হয়, সময় যেনো পাথরের মতো অনঢ় পড়ে থাকে।
টরন্টো ২৫ আগষ্ট ২০১৯