মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
বাংলাদেশীদের একটি নিজস্বতা, স্বকীয়তা আছে। যা বিশ্বের অন্য সবার থেকে নিজেদের পরিচয়কে করেছে স্বতন্ত্র। এই স্বকীয়, স্বতন্ত্র,পরিচয় কেন্দ্রিক কৃষ্টি কালচার দেশের মাটি ও মানুষের প্রকৃত পরিচয়ের প্রতিনিধি। দেশ ও দেশের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, ধর্মীয় মূল্য বোধ, আচার ব্যবহার, পরিবেশ, প্রকৃতির, সমন্বয়ে তা গড়ে উঠেছে। সেটিই আমাদের জাতীয় কৃষ্টি কালচার। এটি বিশ্বেরও সম্পদ। বাংলাদেশী কৃষ্টি কালচারে মুসলিম কৃষ্টির প্রভাব এবং তার ণ্ডরুত্বের দিকটিও এ প্রসঙ্গে অবশ্যই আলোচনায় আসবে। বাংলাভাষী মুসলমানেরা বাংলাদেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ, সেহেতু এদেশের কৃষ্টি, কালচারে সমাজে ও সামাজিক ক্ষেত্রে আচার ব্যবহার, চাল চলনে তার একটি প্রভাব আছে যা স্বাভাবিক।
বিশ্বের অন্যান্য মুসলিমদের থেকে বাংলাদেশের মুসলমানদের কালচারে আছে ভিন্ন এক সত্বা। এই ভিন্নতা, স্বতন্ত্রতা, স্বকীয়তা নিয়ে নিজেদের মত করেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ এবং এ দেশের কালচার। নুতন, পুরাতন, অতীত, বর্তমান, মিলিত অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়েই যা এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশী কালচার তার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য নিয়েও অপেক্ষাকৃত নুতন এটি সত্য এর অনেক কিছুই নুতন ভাবে নুতন পরিচয় পরিচিতি নিয়ে গড়ে উঠছে। কৃষ্টি, কালচারকে ঘিরে এ আলোচনায় সে বিষয়টিও থাকবে। এবং ণ্ডরুত্বের সাথে আলোচিত হবে। কৃষ্টি, কালচারের এ ধারা দুনিয়া জোড়া পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের বহমান ধারা থেকে কিন্তু বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সে বিষয়টিও উল্ল্যেখ যোগ্য। সেটিও লক্ষণীয়।
ণ্ডরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে এ সময় এক দিকে আছে চিন্তা, অনুসন্ধান, গবেষণা, আলাপ আলোচনা অপর দিক জুড়ে আছে আবেগ, উচ্ছাস, তর্ক, বিতর্ক এ পথেই এগিয়ে চলেছে।
এদেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কালচারও বাংলাদেশী কালচারকে সম্মৃদ্ধ করছে। এটিও একই ভাবে সত্য। এবং সম ভাবে ণ্ডরুত্বপূর্ন। এ আলোচনায় শুরুতে মুসলিম কৃষ্টি কালচারের বৈশিষ্ট্য এবং তার ণ্ডরুত্বের দিক ণ্ডলি তুলে ধরা হবে। আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই দিকটি এখনও অনেকটাই অস্পষ্ট। এবং অনেকটাই দুর্বলভাবে উপস্থাপিত।
আরব, ইরান, টার্কি, কসোভো, আলবেনিয়া, চেসনিয়া, বসনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সোমালিয়ার মুসলমানদের নিজ দেশের নিজস্ব কৃষ্টি -কালচারে মুসলিম কৃষ্টি নিয়ে এক্সট্রা ভাবে এখন তাদের ভাবতে হয় না। কারন সময়ের সাথে এ বিষয় ণ্ডলি তারা সেট করে নিয়েছে।
বাংলাদেশি মুসলমানদের এখনও যেতে হচ্ছে নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার পরিচয় পরিচিতি বিনির্মাণ ও সংগঠিত করার প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে। এই পর্বে তাই এ বিষয়টি আলোচনায় ণ্ডরুত্ব রাখে।
আমাদের দেশে বাংলাভাষী মুসলমান জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ হলেও ইংরেজ আমল থেকে মুসলমানেরা অন্যান্য সব বিষয়ের সাথে শিক্ষা, কৃষ্টি, কালচার এবং অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়েন। এটি ছিল মুসলিম বাংলার মুসলমানদের জন্য অন্ধকার যুগ। পরাধীন ব্রিটিশ আমল থেকে যার শুরু। অসহযোগিতা এবং নেতিবাচক মনভাব কাটিয়ে মূল স্রোতে ফিরে এসে বাঙালি মুসলমান নিজেদেরকে প্রতিযোগী অন্যান্য জন ণ্ডষ্টি থেকে নিজেদের অবস্থানকে অনেকটাই পিছনে দেখতে পান। যা এখনও তার সঠিক অবস্থানে ফিরে আসেনি।
পরবর্তীতে মূলত দুটি কারণে শিক্ষিত মুসলিম সমাজের বড় অংশই মুসলিম পরিচিতি কে তুলে ধরবার দায়িত্ব, কর্তব্য পালনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন নি। এবং এ বিষয়টিতে উপযুক্ত ণ্ডরুত্ব প্রদানে ব্যর্থও হয়েছেন। যা রাজা রামমোহন, বঙ্কিম চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাদের নিজ সমাজের জন্য সঠিকভাবে পালন করেছেন।
একদিকে মুসলিম শিক্ষিত সমাজের একটি বড় অংশের মাঝে নিজ কৃষ্টি, কালচার, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে এক ধরনের অনুৎসাহ ও অবজ্ঞা ছিল। আর ছিল এক ধরনের বিভ্রান্তি যা বাংলার মুসলিম সমাজকে ভিতর থেকে দুর্বল করে তুলেছিল। এখনও এ বিষয়টি একটি দুর্বলতার দিক।
অপর দিকে মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের একটি বড় অংশেরই রেনেসাঁ এবং আধুনিকতা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির কারনে মুসলমানকে পিছিয়ে রেখেছিল। যা সমতা, চিন্তা ও বুদ্ধি ভিত্তিক অগ্রসরতা এবং প্রকৃত সামর্থ ও শক্তির ভিত্তি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়নি এবং তা জাতি গঠনের কাজে ও সহায়ক হয়নি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। সে জন্যই প্রয়োজন শত মাদ্রাসা করার চেয়ে একটি ইসলামি কালচারাল ভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা। আজ সেটি অতি জরুরিভাবে ভেবে দেখতে হবে ।
এই ভার্সিটি শিক্ষিত মুসলিম কে বিশ্বের অন্যান্য মতবাদ ও ধর্ম অনুসারীদের সাথে নিজেদের মৌলিক পার্থক্যর দিক সম্পর্কে যেমন জানাবে তেমনি। বিশ্ব মানবতা, প্রকৃত ইসলামী উদারতা ও ভ্রাত্বিত্বের দিকটিও তুলে ধরতে সক্ষম হবে। সম্প্রদায়িকতা ও ক্ষুদ্রতা মুক্ত মেধাবান শিক্ষিত নব যুব সম্প্রদায়ই পারবে ইসলামোফোবিক চক্রকে সত্যিকার ভাবে বুদ্ধি ভিত্তিক মোকাবেলা করতে। সভ্য সমাজ থেকে দূরে লুকিয়ে থেকে নয়। শুধু মাত্র কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করে নয়। নিজেদের সত্যিকার অবস্থান ঐতিহ্য কৃষ্টি কালচারের মহৎ ও সুন্দর দিক ণ্ডলি সৃষ্টিশীল পথে সত্যিকার মেধা ও মননের মাঝে সারা বিশ্বে তুলে ধরবে।
মেধাহীন ভীরুতায় অন্যের অনুসরণ করবে না। নিজের নিজস্বতাকে নিয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। মুসলিমদের করণীয় সম্পর্কেও জাতিকে পরিষ্কার ধারণা দেবে। কর্ম না করে ধর্মের নামে সব কিছুতে বাগড়া দেওয়ার কালচার চিরতরে বন্দ হবে। তার জন্য চাই জ্ঞান চর্চার সুযোগ। একটি সত্যিকার গবেষণা বিদ্যা কেন্দ্র। প্রস্তাবিত এই বিশ্ববিদ্যালয় দেবে সে সুযোগ। মানবতা সহ জ্ঞান, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুসলিম কৃষ্টি, কালচারের প্রকৃত স্বরূপ চর্চা ও গবেষণায় দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করে তুলবে। আর সারা বিশ্বকে বাংলাদেশী, মুসলিম, ইসলামী, কৃষ্টি, কালচার ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতা মুগ্ধ করবে।
বাংলাদেশী কৃষ্টি-কালচারের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইসলামিক কৃষ্টি কালচার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আবশ্যক এর বেশ কিছু কারণ আছে।
ক: জাতিকে নিজস্ব কৃষ্টি-কালচারের সাথে পরিচয় ঘটাতে এবং মেধা যুক্ত গবেষক মানবতাবাদী এক দল উদ্দমী তরুণ যুব শ্রেণী গড়ে তুলতে। যা বর্তমান প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সমূহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশী আগ্রাসী ভাব ধারার খপ্পরে থেকে সাবলীল ভাবে নিজস্বতা ধরে রাখতে পারেনি। সেটি প্রমাণিত। সাংস্ক্রিতিক আগ্রাসন মোকাবেলায় তাই ইসলামিক কৃষ্টি-কালচার বিশ্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিকল্প নাই।
খ: জাতীয় ঔক্য প্রতিষ্ঠায় এ বিশ্ব বিদ্যালয় তার ভূমিকা রাখবে।
গ: জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা অনুযায়ী আমাদের কৃষ্টি, কালচার, সাহিত্য, সাংস্কৃতি এগিয়ে না যাবার কারণে সারা দেশ জুড়ে দ্রুত মূল্য বোধের অবক্ষয় ও নানা মুখী সংকট দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টি যত দ্রুত আমরা অনুধাবন করতে পারব ততই মঙ্গল জনক। সংকট থেকে উত্তরণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের স্বকীয়তা, নিজস্ব ঐতিহ্যের দিক ণ্ডলি তুলে ধরা সহজ হবেনা। এটি সত্য। কারন এই প্রতিষ্ঠান ণ্ডলি অতীতে এবং বর্তমানে অপ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সহ বাইরের আগ্রাসী কুট চাল প্রতিরোধে সক্ষম হয়নি। আগ্রাসী ভাব ধারার ভাব ধারার খপ্পরে থেকে সাবলীল ভাবে নিজস্বতা ধরে রাখতে পারেনি। সেটি প্রমাণিত।
ঘ: একই সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিকে অতীত এবং বর্তমানের মাঝে সেতু বন্ধন গড়ে তুলবে অন্য দিকে আমাদের ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতিক বিকাশে ণ্ডরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাংলাদেশী কৃষ্টি-কালচারের সমৃদ্ধি ও পূর্নতা আনতে এটি প্রয়োজন। সব শেষে বলা যায় এ বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের অন্যান সকল জাতি ণ্ডষ্টির মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে একটি মেল্টিং পট হিসাবে কাজ করতে পারবে। এবং বাংলাদেশী কৃষ্টি কালচারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের সত্যিকার গর্বিত অংশ করে তুলবে।