লিখেছেন কৃষ্ণপদ সেন
এ যেন হরিষে বিষাদ। আমাদের মন্ট্রিয়ল গত প্রায় এক মাস থেকে আনন্দে ভাসছে। আমাদের দুই দুটি মেয়ের মালবদলের আনন্দে আমরা আনন্দিত। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আর পারিবারিক আয়োজনে আয়োজিত অনুষ্ঠান ছিল নৈমিত্তিক। আমাদের মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাবে। স্বামী সোহাগিনী হয় স্বামীর সংসার আলোকিত করবে। আর সেই আনন্দে আনন্দিত এই শহর।
পুরো নারীরা নিজেদের কে ভারতীয় সাজে সাজিয়ে , নিত্য নুতন শাড়ী গহনায় , বিভিন্ন সামাজিক পারিবারিক আয়োজনে তাদের সরব উপস্থিতি কে স্মৃতিময় করে রাখতে ব্যস্ত। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মুখরিত ছবি আর ভিডিও তে। এই পান্ডব বর্জিত শীতের শহরে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় তুষারের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত। কর্মব্যস্ত জীবনে ভারতীয় শাড়ী গহনায় নিজেকে উপস্থাপন করার সূযোগ খুবই সীমিত। আর পুরুষদের তো আরো কম। দেশ থেকে আনা রঙিন পান্জাবী টা গায়ে জড়ানোর সূযোগ কোথায় ? তাই তারাও কম কিসে ?
এমনই এক আনন্দঘন দিনে সবাই কে বিষাদে ডুবিয়ে দিয়ে মহাপ্রস্থানের খেয়ায় যাত্রী হলো আমাদের এক বৌমা। আমাদের ছেলে বাবুর স্ত্রী ছিল সে। বিশ্বরূপ দেব চৌধুরী বাবু। তার সহধর্মিণী রীপা দেব চৌধুরী। হবিগঞ্জের মেয়ে রীপা। অত্যন্ত অমায়িক , শান্ত , ধীরস্থির স্বভাবের এই বৌমা টি ছিল আমাদের আরো একটি মেয়ে। যিনি ই একবার রীপার সাথে কথা বলেছেন , আমার বিশ্বাস , তিনি ই মেয়েটা কে কোনদিন ভুলতে পারবেন বলে। আজকে রবিবার ৯জুলাই ২০২৩ , অন্তর্জলী যাত্রা করলো রীপা।
হবিগঞ্জ শহরের বি কে জি সি স্কুলে পড়ার পর হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে ও পড়াশোনা করেছে রিপা। আজ প্রায় পনেরো বছর সে এই শহরের বাসিন্দা। মা তিন বোন , দুই কন্যা আর রীপাকে নিয়ে ছিল বাবুর সংসার। বাবুর বাবা আমাদের বিকাশ দা গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর। বৃহত্তর সিলেটের শ্রীমঙ্গল শহরে তাদের আদি নিবাস। রীপাদের আদি নিবাস হবিগঞ্জে। মা বাবা আর এক ভাইয়ের সংসারে বড়ই আদরের এক আহ্লাদী মেয়ে ছিল রীপা। ভালো গান গাইতো রীপা। মন্ট্রিয়লের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং পূজা পার্বণের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে রীপা ছিল এক অপরিহার্য মুখ। বছর কয়েক আগে রীপার মা বাবা মন্ট্রিয়ল বেড়িয়ে গেছেন।
মেয়েটি বেশ ক’বছর ধরে অসুস্থতায় ভুগছিল। কিন্তু অসুস্থতা কি ধরনের জানা ছিল না। একবার আমি দেশে। তখন মেয়ে টি খুবই অসুস্থ। আমি আমাদের কুলদেবতা সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছি। তখন আমার মেয়ে রূপা ফোন করে আমাকে রীপার রোগমুক্তির জন্য পূজা দিতে বল্লো। তখনই প্রথম ওর রোগের বিস্তারিত জানালাম। তারপর থেকে যতবারই পূজা দিতে গিয়েছি , রীপার নাম পূজা দিয়ে ওর রোগ মুক্তি কামনা করেছি। বেশ কয়েক বারই রীপা যমরাজের সাথে যুদ্ধ করে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল।নিজেকে পরাজিত হতে দেয়নি। দশভুজার শক্তি দিয়ে পরাজিত করেছে মরন ব্যাধি ক্যান্সার কে। কিন্তু এবার আর পেরে উঠতে পারলো না সে।
আজ এখানে বিয়ের আনন্দে বিষাদের কান্না। তাইতো বলি ” এতো আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা তোমায় ছাড়া।” তোমাকে বিদায় বলতে মন মানছে না। তবুও বিদায় তো দিতেই হয়। এবার বড় অল্প সময় নিয়ে এসেছিলে মা , আগামী বার যখন আসবে , তখন হাতে অনেক অনেক সময় নিয়ে আসবে। কত গল্প কত কথা যে বলার রয়ে গেল। যে লোকেই থাকো মা , ভালো থেকো। শান্তিতে থেকো।।