মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী হিসেবে সুপরিচিত বগুড়ার দুই ভাই প্রবীর কুমার দত্ত ও সমীর কুমার দত্ত। স্যোশ্যাাল ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক ও ব্যক্তি পর্যায়ে বহু মানুষের কাছে ভালো লাভে টাকা খাটানোর টোপ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে ভারতে চলে গেছে। ভারতে অবস্থান করে ব্যাংকে বন্ধক রাখা তাদের সম্পত্তি স্থানীয় প্রভাবশালী ভুমিদস্যু চক্রকে ব্যবহার করে হাতিয়ে নেওয়ার জোর তৎপরতাও চালাচ্ছে।
এই খবর জানাজানি হওয়ার পর গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক বগুড়া শাখা থেকে সদর থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। একই সাথে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বগুড়ার পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসককেও লিখিতভাবে অবহিত করেছে। জিডির বিষয় তদন্ত করছেন বগুড়া সদর থানার এসআই বেদার উদ্দিন।
জিডিতে অভিযোগ করা হয়েছে, বগুড়ার ঝাউতলা রাজাবাজারের ব্যবসায়ী প্রবীর কুমার দত্ত সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বগুড়া শাখার একজন খেলাপি গ্রাহক। তার বিরুদ্ধে আদালতে পৃথক ৬টি চেকের মামলা রয়েছে। আদালত ২০১৯ সালের ১৯ মে আদালত রায়ে ব্যাংকের পাওনা নির্ধারণ করেন ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ২৭ হাজার ৬২৯ টাকা। সেই সাথে প্রবীর কুমারকে কারাদন্ড দেন।
আদালত রায় ঘোষণার পর আত্মগোপন করেন প্রবীর ও বন্ধকী সম্পত্তির গ্যারান্টার তার বড়ো ভাই সমীর দত্ত। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট বন্ধকী সম্পত্তির ওপর আদালত নিলাম বিজ্ঞপ্তির নির্দেশনা দেন। আগামী ২৬ জানিুয়ারি নিলাম বিজ্ঞপ্তির বাক্স খোলা হবে। উপযুক্ত নিলামকারী না পাওয়া গেলে সম্পত্তির মালিকানা ব্যাংকের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
আইনি প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর বগুড়া শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা ব্যাংকপাড়া খ্যাত অঞ্চলে ওই বন্ধকী সম্পত্তি দখল করার চেষ্টার খবর পায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ব্যাংক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে দখলদারদের নিয়োজিত শ্রমিকরা দ্রুত কেটে পড়ে। কর্মকর্তারা ব্যাংকে ফিরে যাওয়ার পরই আড়ালে থাকা শ্রমিকরা বেরিয়ে জায়গার দখল নিতে তৎপরতা শুরু করে। এরপরই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ থানায় জিডি করে। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি মিডিয়ার আড়ালে রাখা হয়। তবে এক ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে একটি লাইভ বক্তব্য প্রচার করলে অনেকের নজরে আসে।
গত রোববার ইনকিলাবের পক্ষ থেকে বিষয়টি অনুসন্ধানকালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় যোগাযোগ করা হয়। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকসহ দায়িত্বরত কর্মকর্তারা মুখ খুলতে নারাজ। তবে তাদের কথা, ব্যাংক তথা দেশের স্বার্থ রক্ষায় তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের খেলাপি গ্রাহক ও দন্ডাদেশপ্রাপ্ত প্রবীর ও সমীর পালিয়ে ভারতে গিয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, তেমন কথাই আমরা শুনেছি। আমরা তাদেরকে লাপাত্তা হিসেবেই ধরে নিয়েছি।
ব্যাংকে রক্ষিত একটি মূল্যবান সম্পত্তি কোন প্রক্রিয়ায় দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অলোক চ্যাটার্জি নামে এক ব্যাক্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা সম্পত্তির কথিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে বগুড়ায় একটি ভূমি মাফিয়া চক্রের সহায়তায় জায়গাটি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাংকে বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আদালত নির্দেশনাও দিয়েছেন সেই জমিতে কথিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বলে কিছু করার বৈধ সুযোগ নেই।
অনুসন্ধানে দেখা যায় উল্লেখিত অলোক চ্যাটার্জি এবং তার পিতা রতন কুমার চ্যাটার্জির এনআইডি নম্বর জাল। আর জাল এনআইডি ব্যবহার করেই অলোক চ্যাটার্জি একটি কোম্পানির মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করছেন। অলোক ভারতে পলাতক মাড়োয়ারি দুই ভাই প্রবীর ও সমীরের বিভিন্ন স্বার্থ দেখভাল করছেন। অলোক সরাসরি নয়, মোবাইল ফোনেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের সতত্যা যাচাইয়ের জন্য গত রোববার ইনকিলাবের পক্ষ থেকে অলোক চ্যাটার্জিকে ফোন করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। সোশ্যাল ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফোনে কথা বলতেও রাজি নন। তবে নিজেই যোগাযোগ করার কথা বলে ফোন রেখে দেন। গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সমীর ও প্রবীর দুই ভাই বনেদি মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকেই তারা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ পাচার শুরু করেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঠান্ডা মাথায় তারা পরিকল্পনা করেই বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যাক্তি পর্যায়ে অনেকের কাছ থেকে টাকা আত্মসাত করে ভারতে পালিয়েছে। বর্তমানে শিলিগুড়ি, কোলকাতা এবং মুম্বাইয়ে তাদের ফ্লাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীর সহায়তায় তাদের গোপনে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ, যাতায়াত এবং গোপন অর্থনৈতিক কারবার চালু রয়েছে।