২৮ অক্টোবর ইতিহাসের এক কলঙ্কিত দিবস। ২০০৬ সালের এই দিনে আওয়ামী ও ভারতপন্থি বাম হায়েনাদের লগি-বৈঠার পৈশাচিক নৃশংসতা দেখেছিল বিশ্ববাসী। ঐদিন ভারতপন্থি সন্ত্রাসীদের নৈরাজ্য ও লগি-বৈঠার তান্ডবে নিহত হয়েছিলেন ১৭ জন। আহতের কোন হিসাব নেই। ভাংচুর, নৈরাজ্যে ও নৃশংসতায় ক্ষতি হয়েছিল কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ওই দিন পলাশীর যুদ্ধের ন্যায় পুলিশ ও বিডিআর চুপচাপ দাড়িয়ে ধ্বংসজজ্ঞ দেখেছিল। আওয়ামী এবং ভারতপন্থি বামরা যখন পল্টনমোড়ে রাস্তায় পিটিয়ে ৭ জনকে হত্যার পর লাশের উপর নৃত্য করছিল, শতশত পুলিশ তখন উদ্বিগ্ন পথচারির সাথে দাঁড়িয়েছিল সাক্ষী গোপালের মত। তৎকালীন বিদায়ী চার দলীয় জোট সরকারের শেষ দিন ছিল এটি। সেদিন রাত ১২টা পর্যন্ত ছিল সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ। বিদায়ের এই দিনেই আইন শঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন আচরণ বিস্মিত করেছিল দেশবাসীকে।
২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর অর্থাৎ লগি-বৈঠার মহা তান্ডবের পরের দিন ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘দেশজুড়ে নৈরাজ্য’। পত্রিকাটির উপ-শিরোনামে বলা হয়েছিল নিহত-১১ জন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার শিরোনাম ছিল-‘দেশজুড়ে সহিংসতায় নিহত ১৫’। তবে ইন্ডিয়াপন্থি প্রথম আলো সেদিন এই ঘটনাকে সেকেন্ড লিড হিসাবে প্রকাশ করেছিল। তাদের শিরোনাম ছিল- ‘সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে নিহত ১১’। মূলত পরর্বীতে জানা যায় ওইদিন সারা দেশে ভারতপন্থিদের নৃশংস হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১৭ জন।
এই শিরোনাম গুলোতেই সাক্ষী হয়ে আছে লগি-বৈঠার জঙ্গি হামলায় মানবতা বিরোধী গণহত্যার ঘটনা।
২৯ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে ইত্তেফাকের শিরোনামে বলা হয়েছিল ‘দেশজুড়েনৈরাজ্য’
যেভাবে তান্ডব শুরু হয়েছিল ঢাকার পল্টনে:
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। এই ভাষণের পর থেকেই জঙ্গি উল্লাসে মেতে উঠে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তৎকালীন চার দলীয় জোটের শরীক দল জামায়াতে ইসলামী পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে ২৮ অক্টোবর সকাল থেকেই সমাবেশ শুরু করে। সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিএনপিও নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় অফিসের সামনের রাস্তায় সমাবেশের আয়োজন করে। তবে বিএনপি’র সমাবেশ তেমন জমে উঠেনি সেদিন।
জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখছেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা নিয়ে মুক্তাঙ্গন ও গুলিস্তান এলাকায় সমাবেত হতে থাকে সকাল থেকেই। বেলা ১১টার কিছু পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের একটি জঙ্গি মিছিল প্রেসক্লাবের দিক থেকে, আরেকটি জঙ্গি মিছিল মুক্তাঙ্গন থেকে লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পল্টন মোড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দুই মিছিল পল্টনের মোড়ে একত্রিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর সামবেশে হামলা চালায়। এই হামলায় জামায়াতে ইসলামীর ৬জন কর্মীকে পল্টনমোড়ে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। শত শত পুলিশ, টেলিভিশন ক্যামেরা, ও ফটোসাংবাদিকসহ গণমাধ্যম কর্মীদের সামনেই ঘটে এই হত্যাকান্ড। শুধু লগি-বৈঠাই নয়, আগ্রেয়াস্ত্র উঁচিয়েও এসেছিল আওয়ামী ক্যাডাররা। জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে হামলা চালিয়ে ৬জন কর্মীকে ধরে নিয়ে এসে পল্টানমোড়ে পিটিয়ে হত্যার পর মৃত দেহের উপর লাফিয়ে উঠতে দেখা যায় ভারতপন্থি জঙ্গিদের । রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠনের নেতা বাপ্পাদিত্য বসুসহ অনেক ভারতপন্থি বামদেরও লাশের উপর নৃত্য করতে দেখা গিয়েছিল সেদিন।
সেদিনের হত্যাকান্ডোর শিকার হয়েছিলেন, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের মেধাবী ছাত্র ও শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তার লাশের ওপর উঠে নৃত্য করতে করতে উল্লাস প্রকাশ করেছিল।
হত্যাকান্ড চলাকালে কাছেই দাড়িয়ে থাকলেও পুলিশ তেমন কোন ভুমিকা পালন করেনি। পুলিশের সামনেই শিবির কর্মী মুজাহিদুল ইসলাম, জামায়াত কর্মী মোশাররফসহ ৬ জনকে রক্তাক্ত অবস্থায় মারতে থাকলেও একটি বারের জন্য পুলিশের হুইসেল বাজেনি সেদিন।
হত্যাকান্ড পরবর্তীতে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে জামায়াতের সমাবেশ আবারো শুরু হয়। তৎকালীন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্য শুরু হওয়ার পর নির্মাণাধীন র্যাংগস টাওয়ারের ছাদ থেকে সমাবেশ লক্ষ্য করে ১০-১২টি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে দফায় দফায় গুলি ছোড়ে লগি-বৈঠা বাহিনীর লোকেরা। সেদিন তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি পথচারী, এমনকি ছোট্ট শিশুরাও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে তাদের তাÐব। পুলিশের নির্লিপ্ততা ও নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে এখনো জনমনে হাজহারো প্রশ্ন বিরাজ করছে।
২৯ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে প্রথম আলোর সেকেন্ড লিড নিউজ ছিল এই ভয়াবহতম নৃশংসতার ঘটনা। তাদের প্রধান ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছিল শিবির কর্মীদের হামলায় একজন পথচারি নিহত!
তান্ডবের হুকুমদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা
এই গণহত্যার হুকুমদাতা ছিলেন আজকের ফ্যাসিবাদি সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ অক্টোবর যুব লীগের এক সমাবেশে বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা তাঁর দলের লোকজনকে লগি-বৈঠাসহ যার যা আছে তাই নিয়ে ২৮ অক্টোবর রাস্তায় নামার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশেই আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ঝাপিয়ে পড়েছিল বিদায়ী সরকারের দলীয় নেতাকর্মীদের উপরে।
মহাজোট নেতাকর্মী নামধারী পাষণ্ডরা শেখ হাসিনার নির্দেশের পর লগি-বৈঠা দিয়ে বর্বরোচিত কায়দায় শুধু হত্যাই নয়, মৃতদেহের ওপর করেছে উল্লাস-নৃত্য। বিভৎসভাবে পিটিয়ে মেরেছিল জীবন্ত মানুষ গুলোকে। সেই পৈচাশিক দিনে প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ ও মুহুর্মুহু বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করে হায়েনার মতো উল্লাস প্রকাশের দৃশ্য মনে হলে মানুষ আজও শিউরে ওঠে।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি নির্বাহী আদেশ বলে নির্লজ্জভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। মহাজোটের লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীদের হত্যার দায় থেকে মুক্তি দেয়া হলেও ওই লাশের দায় কে নেবে? এ প্রশ্ন আজ স্বজন হারানো পরিবারসহ দেশবাসীর। লগি-বৈঠার তান্ডব চালাতে যিনি হুকুম দিয়েছিলেন তার কি কোন দায় নেই এই নৈরাজ্য ও হত্যাকান্ডের ঘটনায়?
শুধু ঢাকাতেই নয়, লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা সেদিন সারাদেশে চালিয়েছে এই নারকীয় নৈরাজ্য ও নৃশংসতা। ওইদিন লগি-বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডবেঢাকাসহ সারাদেশে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। ঢাকায় নিহত হয়েছিলেন ৭ জন।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ২৯ অক্টোবরের শিরোনাম ছিল ‘দেশজুড়ে সহিংসতায় নিহত ১৫’
২৬ থেক ২৮ অক্টোবর ৩ দিনে নিহত ৫৪
লগি-বৈঠা নিয়ে আওয়ামী তান্ডব শুরু হয়েছিল ২৬ অক্টোবর থেকেই থেকে। ২৫ অক্টোবর গুলিস্তানে অনুষ্ঠিত যুব লীগের সমাবেশ থেকে শেখ হাসিনা হুকুম দিয়েছিরেন লগি-বৈঠা নিয়ে রাস্তায় নামার জন্য। পরের দিন থেকেই শুরু হয় দেশজুড়ে লগি-বৈঠার নৈরাজ্য। ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর। ৩ দিনে আওয়ামী নৈরাজ্যে খুন করা হয়েছিল চারদলীয় জোটের ৫৪ নেতাকর্মী। ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। বিদায়ী চার দলীয় জোট সরকারের শরীক রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দল গুলোর কার্যালয় ভাংচুর করা হয় বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা-কর্মীর বাড়িঘরেও হামলা চালানো শুরু হয় ২৫ অক্টোবর থেকেই।
২৬ অক্টোবর (২০০৬) ছিল লগি-বৈঠার প্রথম মহড়া। যুবলীগের সমাবেশ শেষে লগি-বৈঠার জঙ্গি মিছিল ঢাকার রাজপথে।
মামলা প্রত্যাহার
জামায়াত-শিবিরের ৭ নেতাকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। যুবমৈত্রীর পক্ষ থেকে জামায়াত নেতাদের আসামি করে আরও একটি মামলা করা হয়। যুবমৈত্রীর মামলায় ১০ জামায়াত নেতাকে অভিযুক্ত করে পরবর্তীতে চার্জশিট দেয়া হয়। জামায়াতের দায়ের করা মামলাটি পল্টন থানা ও পুলিশ তদন্ত করে ৪৬ জনকে অভিযুক্ত করে ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দেয়। চার্জশিট দাখিল করেন ডিবি’র সাব-ইন্সপেক্টর এনামুল হক। চার্জশিট দাখিলের পর একই বছর ২২ এপ্রিল তা গ্রহণ করেন মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা। তিনি শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ২০০৭ সালের ২৩ এপ্রিল এক আদেশে মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। সারাদেশে লগি-বৈঠা নিয়ে মহাজোট নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেয়ায় এ মামলায় বর্তমান ফ্যাসিবাদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চার্জশিটে হুকুমের আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এ এটাকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে উল্লেখ করে প্রত্যাহারের সুপারিশ করে। সরকারের সুপারিশের ভিত্তিতে আওয়ামী আদালত বাদীপক্ষ ও নিহতদের পরিবারের বক্তব্য গ্রহণ ছাড়াই একতরফা মামলাটি বাতিল করে দেন।
আজও থামেনি নিহতদের পরিবারের কান্না:
২৮ অক্টোবরের তাÐবে নিহত হয়েছিল ছাত্রশিবিরের সদস্য স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র মুজাহিদুল ইসলাম, হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন, লালবাগের জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিন, জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমান হাবিব, জুরাইনের জামায়াত কর্মী হাজী আনোয়ারুল্লাহর ছেলে জসিম, সিদ্ধিরগঞ্জের আবদুল্লাহ আল ফয়সাল। একই সময় যুবমৈত্রীর কর্মী রাসেল আহমদ নিহত হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম। একই দিন গাজীপুরে মারা যান জামায়াত কর্মী রুহুল আমিন, নীলফামারীতে মারা যান জামায়াত কর্মী সাবের হোসেন, মাগুরায় আরাফাত হোসেন সবুজ, মেহেরপুরে আব্বাস আলী ও সাতক্ষীরায় জাবিদ আলী। লগি-বৈঠার নৃশংসতার ১৪ বছর পার হলেও এখনও শোকের সাগরে ভাসছে নিহতদের পরিবার। মহাজোট নেতাকর্মীদের হামলায় আহতদের অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করে নিদারুণ কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের ভাগ্যে ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে বিচার জোটেনি। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিনা বিচারেই কষ্ট সয়ে যেতে হবে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের।