সারা বিশ্বের সোশাল মিডিয়া থেকে এক লক্ষেরও বেশি নারীর ছবি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে ভুয়া নগ্ন ছবি তৈরি করা হচ্ছে এবং অনলাইনে তা শেয়ার করা হচ্ছে বলে এক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে এসব ছবি থেকে নারী দেহের পোশাক সরিয়ে ফেলা হচ্ছে এবং মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে এসব নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি সেনসিটির তৈরি এই রিপোর্টটি আরো জানাচ্ছে যে এসব বিবস্ত্র নারীর অনেকেই অল্পবয়সী।
কিন্তু যারা এসব করছে তারা প্রায়ই একে শুধুমাত্র ‘বিনোদন’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।
বিবিসি এধরনের একটি সফটওয়্যার পরীক্ষা করে দেখেছে। তবে তার ফলাফল আশানুরূপ হয়নি।
কিন্তু সেনসিটি দাবি করছে, ‘ডিপফেক বট’ নামে প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীদের নগ্ন বানানোর কাজ চলছে।
ডিপফেক হলো কম্পিউটারে তৈরি এক ধরনের ছবি বা ভিডিও যা দেখলে ধরা যাবেন না সেটি নকল। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায়ই সেলেব্রিটিদের নিয়ে ভুয়া পর্নোগ্রাফিক ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা হয়।
তবে সেনসিটির প্রধান নির্বাহী জর্জিও পাত্রিনি বলছেন, সেলেব্রিটিদের ছেড়ে সাধারণ মানুষের ছবি ব্যবহার করে ভুয়া ভিডিও কিংবা ছবি তৈরি করার ঝোঁক এখন বাড়ছে।
“সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে কারো একটি ছবি থাকলেই তাকে নিয়ে এ ধরনের ছবি তৈরি করা সম্ভব,” বলছেন তিনি।
টেলিগ্রাম ডিপফেক বট
মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রাইভেট মেসেজিং চ্যানেলে একটি শক্তিশালী এআই বট (রোবট প্রোগ্রাম) ব্যবহার করা হয়। এর ব্যবহারকারীরা এই বটকে কোন নারীর ছবি পাঠাতে পারে। এবং এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বটটি কয়েক মিনিটের মধ্যে ছবিতে ঐ নারীর দেহ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলতে পারে। এর জন্য টেলিগ্রামের গ্রাহককে কোন অর্থও দিতে হবে না।
বিবিসি কয়েকজনের অনুমতি নিয়ে তাদের ছবির ওপর পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু কোন পরীক্ষার ছবিই বাস্তবসম্মত দেখায় নি।
এধরনের একটি অ্যাপ গত বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে করা হচ্ছে ঐ সফটওয়্যারের একটি ক্র্যাকড ভার্সন এখন আবার ব্যবহার করা হচ্ছে।
যে এই সেবাটি দিচ্ছে তার অ্যাডমিন, যিনি নাম ব্যবহার করেন শুধু ‘পি’, তিনি বলছেন, “এসব আমি কেয়ার করি না। এটা হচ্ছে শুধুই বিনোদন, এবং এতে কারও কোন ক্ষতি করা হচ্ছে না।
“এটা দিয়ে কেউ কাউকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে না। কারণ এসব ছবির মান বাস্তবসম্মত না।”
আরও পড়তে পারেন:
তিনি আরো জানান, তাদের টিম যে ধরনের ছবি শেয়ার করা হচ্ছে তার ওপর নজর রাখে। “যখন আমরা দেখতে পাই যে শিশুদের ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে তখন আমরা ব্যবহারকারীকে চিরদিনের জন্য ব্লক করে দেই।”
তিনি বলছেন, তবে কেউ যদি এসব ছবি অন্যদের সাথে ব্যবহার করতে চায় সেটা নির্ভর করছে কে ছবিটি তৈরি করেছে তার ওপর।
এই ধরনের ছবির তুলনামূলক ক্ষতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, “যুদ্ধ, রোগবালাইসহ এমন অনেক কিছু আছে যা বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর।”
এই বিষয়ে টেলিগ্রামের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
‘শিশু যৌন নির্যাতন’
সেনসিটি তার রিপোর্টে বলছে, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের একই মাস পর্যন্ত প্রায় ১,০৪,৮৫২ নারীর ছবির অপব্যবহার করে ডিজিটাল কায়দায় তাদের বিবস্ত্র করা হয়েছে। এসব ছবি সোশাল মিডিয়াতে খোলাখুলিভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে।
সংস্থাটির তদন্তে কিছু কিছু ছবি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের।
“এর মানে হলো কোন কোন ইউজার এই বট ব্যবহার করে শুধুমাত্র শিশুদের যৌন নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও তৈরি করছে।”
সেনসিটি বলছে, রুশ সোশাল মিডিয়া সাইট ভিকে-তে এই বটের প্রচুর বিজ্ঞাপন ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মের ওপর এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ ইউজার রাশিয়া এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের দেশগুলির বাসিন্দা।
তবে ভিকে বলছে, “তাদের প্ল্যাটফর্মে এধরনের কন্টেন্ট তারা বরদাশত করে না এবং এসব যারা ছড়ায় তারা তাদেরকে ব্লক করে।”
এ বছরের গোঁড়ার দিকে টেলিগ্রামকে রাশিয়ায় সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই রিপোর্টের লেখকরা বলছেন, তারা তাদের সব তথ্য টেলিগ্রাম, ভিকে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোন জবাব আসেনি।
নিনা শিক ‘ডিপফেক অ্যান্ড ইনফোক্যালিপ্স’ নামে একটি বইয়ের রচয়িতা। তিনি বলছেন, ডিপফেক কন্টেন্টের নির্মাতারা ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্ব জুড়ে। সেকারণে “কোন ধরনের আইনগত সুরক্ষা তাদের ধরত পারে না।
“এজন্যেই ডিপফেক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি পর্নোগ্রাফিক ভিডিওর সংখ্যা প্রতি ছয় মাস পর পর দ্বিগুণ হচ্ছে,” তিনি বলেন।
“আমাদের বর্তমান আইন ব্যবস্থা এই সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের ফলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে কল্পনা করা যায় না। এসব প্রযুক্তিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে আমাদের সমাজ সে সম্পর্কে এখনও মনস্থির করে উঠতে পারেনি।
“এসব ভুয়া পর্নের যারা শিকার হয়েছেন, তাদের জীবনের ওপর এর প্রভাব একেবারেই বিধ্বংসী। তারা এতটাই অমর্যাদা আর অসম্মানের মুখোমুখি হন যে তাদের জীবন একেবারে ওলটপালট হয়ে যায়।”
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যই প্রথম কোন রাজ্য যেখানে ডিপফেক প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ব্রিটেনের সরকারও এখন এসংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের কথা চিন্তাভাবনা করছে। BBC Bangla