মো. মুসলিম খান রনি। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানাধীন পশ্চিম ঢেমশা এলাকায় বাড়ি হলেও থাকেন নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন মুরাদপুর এলাকায়।
সবাই তাকে চেনেন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। তিনি নিজেও পরিচয় দেন পাঁচলাইশ থানা স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা হিসেবে।
চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেন নিয়মিত। স্বেচ্ছাসেবকলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে সেসব ছবি প্রচার করেন তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে।
মুসলিম খান রনি নিজেকে রাজনৈতিক নেতা পরিচয় দিলেও এর আড়ালে তিনি ছিনতাইকারী দলের সদস্য। রাজনীতির আড়ালে ছিনতাই হলো তার পেশা। আর এ বিষয়টি উঠে এসেছে তার স্বীকারোক্তিতেই। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, কীভাবে ব্যাংক ফেরত মানুষের কাছ থেকে পথরোধ করে টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
মুসলিম খান রনি সাতকানিয়া উপজেলার পশ্চিম ঢেমশা এলাকার শহীদুল আলমের ছেলে। গত ৮ অক্টোবর রাতে মুরাদপুর হামজা খাঁ লেইনের বাসা থেকে কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। বর্তমানে কারাগারে আছেন রনি।
টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা
গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টার ১০ মিনিটের দিকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে এনায়েত বাজার মোড় থেকে রিকশাযোগে জিইসি মোড় যাচ্ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভিসেস এর অফিস সহকারী মিরাজুল ইসলাম। বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে কোতোয়ালী থানাধীন আলমাস সিনেমা হল মোড় ও ওয়াসা মোড়ের মাঝখান বরাবর পৌঁছালে একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে কয়েকজন তার পথরোধ করে।
মিরাজুল ইসলামকে জোর করে রিকশা থেকে নামিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে তার চাবি, মোবাইল ফোন ও সঙ্গে থাকা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে নেয় তারা। মিরাজুল ইসলামকে সিএনজি অটোরিকশায় নিয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কদমতলী ফ্লাইওভারের মাঝখানে বরাবর তাকে নামিয়ে দেয়। সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামিয়ে দেওয়ার সময় চাবি ও মোবাইল ফোন ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এ ঘটনার পর কোতোয়ালী থানায় গিয়ে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী মিরাজুল ইসলাম।
যেভাবে ধরা পড়ে
মামলা দায়েরের পর তদন্তের দায়িত্ব পান কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) পলাশ চন্দ্র ঘোষ। আসামি শনাক্তে বেশ বেগ পেতে হয় পুলিশকে। টানা ২৩ দিন চেষ্টার পর টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত সিএনজি অটোরিকশাটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
প্রথমে সিএনজি অটোরিকশার চালক জাবেদ প্রকাশ সোহেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তার কাছ থেকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের বিষয়ে তথ্য পায়। এরপর বাকলিয়া থানাধীন তুলাতলী এলাকা থেকে মো. ওয়াসিম প্রকাশ বেদি ওয়াসিমকে এবং পাঁচলাইশ থানাধীন মুরাদপুর হামজা খাঁ লেইন এলাকা থেকে মুসলিম খান রনিকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ।
মুসলিম খান রনি ও ওয়াসিমের জবানবন্দি
গ্রেফতারের পর মুসলিম খান রনি ও মো. ওয়াসিমকে আদালতে পাঠানো হলে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তারা। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দুইজনই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
তারা পৃথক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, জয়নাল নামে তাদের গ্রুপের একজন ‘ডিউটি’ আছে জানিয়ে ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে ফোন করে মুসলিম খান রনি ও মো. ওয়াসিমকে বহদ্দারহাট মোড়ে যেতে বলেন। এদের মধ্যে মুসলিম খান রনি দেরি হওয়ায় শুলকবহর রাফির দোকানের সামনে অপেক্ষা করেন ও ওয়াসিম বহদ্দারহাট চলে আসেন।
মুসলিম খান রনি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, জয়নাল ফোন করার পর তার দেরি হওয়ায় তিনি মাকসুদুর রহমান টিপুকে ফোন করেন। টিপুও তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন। তখন টিপুকে মুসলিম খান রনি জানান, তিনি শুলকবহর রাফির দোকানের সামনে আসবেন, তারা যেন সেখানে আসেন। পরে শুলকবহর রাফির দোকানের সামনে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে আসেন টিপু, জয়নাল, ওয়াসিম ও সজীব।
সেখান থেকে সবাই সিএনজি অটোরিকশায় মুরাদপুর হয়ে ২ নম্বর গেইট যায়। ২ নম্বর গেইট মোড় হয়ে ফের তারা মুরাদপুর মোড়ে আসেন। তখন ঘুরেও তারা কোনো ‘পার্টি’ পাননি। দুপুর ২টার দিকে মামুনকে মুরাদপুর আসতে বলেন তারা। মামুনও মুরাদপুর মোড়ে আসেন। একসঙ্গে হোটেল আজমিরে ভাত খান সবাই। খাওয়া শেষে সিদ্ধান্ত হয় ওয়াসিম ‘পার্টি’ খুঁজবে, অন্যরা তাকে ফলো করবে।
‘ঘুরতে ঘুরতে তারা এনায়েত বাজার মোড়ে চলে যান। সেখানে ব্যাংকের খাম হাতে একজন ‘পার্টি’ জুবিলী রোডের দিকে যেতে দেখেন তারা। ওয়াসিম তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। অন্যরা ওয়াসিমের পেছনে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে অনুসরণ করতে থাকেন। ‘পার্টি’ আলমাস সিনেমা হল মোড় ও ওয়াসা মোড়ের মাঝখান বরাবর পৌঁছালে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে তার রিকশার গতিরোধ করেন তারা। ’
‘টিপু ‘পার্টির’ সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। এসময় মামুন, জয়নাল ও সজীব এসে টানা-হেঁচড়া করে ‘পার্টিকে’ সিএনজি অটোরিকশায় তুলে নেয়। ওয়াসিম ও মুসলিম খান রনি রিকশা নিয়ে মুরাদপুর চলে যান। অন্যরা ‘পার্টিকে’ নিয়ে সিআরবির দিকে চলে যান। পরে মুসলিম খান রনিকে ফোন করে টিপু জানান, ‘পার্টির’ কাছ থেকে ১ রাখ ২০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে এবং ‘পার্টিকে’ কদমতলী ফ্লাইওভারে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় টিপু ফোন করে মুরাদপুর এসে মুসলিম খান রনিকে ২০ হাজার টাকা দেন। ’ জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন মুসলিম খান রনি।
ওয়াসিম প্রকাশ বেদি ওয়াসিমও তার দেওয়া জবানবন্দিতে একই তথ্য উল্লেখ করেন। তবে ওয়াসিম ভাগে ১৫ হাজার টাকা পান। ওয়াসিমের কাজ ‘পার্টি’ খুঁজে বের করা। এ কারণে এই গ্রুপের সদস্যরা ওয়াসিমকে বেদি নামে ডাকে। এটি তাদের সাংকেতিক নাম।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) নোবেল চাকমার তত্ত্বাবধানে মামলার তদন্তে ছিলেন কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই পলাশ চন্দ্র ঘোষ।
সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) নোবেল চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার পর আমরা কোনো ক্লু পাচ্ছিলাম না। তবুও আমরা হাল ছেড়ে দিইনি। টানা ২৩ দিন চেষ্টার পর আমরা টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত সিএনজি অটোরিকশাটি শনাক্ত করতে সক্ষম হই। পরে সিএনজি অটোরিকশার চালক জাবেদ প্রকাশ সোহেলকে গ্রেফতার ও তার দেওয়া তথ্যে ওয়াসিম ও মুসলিম খান রনিকে গ্রেফতার করি।
কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মুসলিম খান রনি ও ওয়াসিম। তারা পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের তথ্য পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই পলাশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, টাকা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের নাম পেয়েছি। তারা পেশাদার ছিনতাইকারী। এ গ্রুপের দলনেতা জয়নাল। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। জয়নালসহ জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এসআই পলাশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, এ ছিনতাইকারী গ্রুপের সদস্যরা সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশায় করে ঘুরে ঘুরে টার্গেট চিহ্নিত করে। পরে পথের মধ্যেই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। ওয়াসিমের কাজ হলো টার্গেট চিহ্নিত করে তাকে ফলো করা। অন্যরা টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার কাজ করে।
এসআই পলাশ বলেন, গ্রেফতারের পর মুসলিম খান রনি জানিয়েছেন- তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে তিনি কোনো পদে নেই বলে জানিয়েছেন।
এদিকে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার মুসলিম খান রনির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। নিজেকে পাঁচলাইশ থানা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সংগঠক হিসেবে পরিচয় দেন। মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন তিনি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এএইচএম জিয়াউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, মুসলিম খান রনির বিষয়ে শুনেছি। তিনি স্বেচ্ছাসেবকলীগের কোনো পদে নেই। তবে স্বেচ্ছাসেবকলীগের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন।
মুসলিম খান রনির গ্রেফতারের বিষয়টি ‘ষড়যন্ত্র’ হতে পারে বলেও মনে করেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এএইচএম জিয়াউদ্দিন।