সকাল থেকে পত্রিকার অনলাইনের ওয়েবে খবর ভাসছে চুয়াডাঙ্গার একটি সীমান্তে বাংলাদেশী যুবককে হত্যা করেছে হানাদার বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী)। ঠিক সেই দিনেই দুপুরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনন্দের সাথে ঘোষণা করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণের সংবাদ। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার রজতজয়ন্তি উপলক্ষ্যে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে আগামী বছরের ২৬ মার্চ। এ উপলক্ষ্যেই গুজরাটে মুসলিম নিধনে কসাই বলে খ্যাতি পাওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদিকে আগামী বছর ২৬ মার্চ ঢাকায় আসার সম্ভাবনার কথা জানালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। এছাড়া চলতি বছরের ১৬ অথবা ১৭ ডিসেম্বর নরেন্দ্র মোদীর সাথে শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল বৈঠকের বিষয়েও অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রোববার (১৮ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকায় নবনিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। এই বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি আসতে পারেন।” সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ বলেন, এটি ছোট বিষয়। এটি কখনো ইস্যু হওয়া উচিত নয়। কিন্তু প্রায়শই হত্যা সংঘটিত হচ্ছে, ইস্যু হয়ে আলোচনায় উঠছে। এটি দু:খজনক।
নবনিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী গত ৫ অক্টোবর নাটকীয়ভাবে ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এর আগে কোন ভারতীয় হাই কমিশনার স্থল সীমান্ত দিয়ে এসে এমন নাটক সৃষ্টি করেননি। গত ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন। ঢাকায় যোগ দেয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এটাই তার প্রথম বৈঠক।
বাংলাদেশে মোদীর সম্ভাব্য সফরের ঘোষণা এমন এক দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিলেন, যেদিন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ঠাকুরপুর সীমান্তে গুলি করে এক বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। ভারত সীমান্তবর্তী ঠাকুরপুর গ্রামের ওমেদুল ইসলাম (২২) -কে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ।
আওয়ামী সমর্থক মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ’র হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৩ জন বাংলাদেশী। যাদের মধ্যে ৩৭ জন নিহত হন গুলিতে, আর বাকি ৬ জনকে নির্যাতন করে খুন করা হয়। ২০২০ সালের প্রথম ছয়মাসেই সীমান্তে বিএসএফ ২৫ জন নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোয়।
গত বছরের প্রথম ছয়মাসের তুলনায় সীমান্তে চলতি বছরে বিএসএসফ বেশি বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ১৮ জন বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করেছিল বিএসএফ। ২০২০ সালে একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ জনে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এদিকে সরকারি হিসাবেই শেখ হাসিনা সরকারের দশ বছরে সীমান্তে ২৯৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের পরম বন্ধুরাষ্ট্র ইন্ডিয়া, যার সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক।
২০১৯ সালের ১১ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার তথ্য জানিয়েছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ১০ বছরে ভারতীয় বিএসএফ সীমান্তে ২৯৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। মন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ সালে ২৪ জন, ২০১২ সালে ২৪ জন, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ জনের মৃত্যুর হিসাব দেওয়া হয় সংসদে।
তবে মানবাধিকার সংগঠন গুলোর হিসাব মতে, এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবেই দেখা যায় ২০১৮ সালে ১৪ জন বাংলাদেশীকে বিএসএফ হত্যা করেছে। যদিও সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে ৩ জন মাত্র।
সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএসএফের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় তা ‘শূন্যে নামিয়ে আনা’র প্রতিশ্রুতি দেওয় সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার এবং বিজিবির নতজানু নীতির কারণে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা বেড়েই চলেছে।
গুজরাটের কসাই:
ভারতের গুজরাট রাজ্যে ২০০২ সালে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গায় অন্তত ৫০০০ মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গুজরাটের তখনকার মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় নির্মম এই গণহত্যা সংঘটিত হয় বলে তখন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ওই দাঙ্গায় অন্ততঃ ৪০০ মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করে। অনেক মুসলিম মহিলাকে তাদের পরিবারের সামনেই বিবস্ত্র করা হয়। হিন্দুবাদীরা তাদেরকে ধর্ষণ করে, লাঠি, ছুরি ইত্যাদি দিয়ে আঘাত করে।
মুসলমানদের অধিকাংশকেই টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয় অথবা আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। কংগ্রেসের একজন সাবেক মুসলিম এমপিকেও পরিবারসহ ওই দাঙ্গায় হিন্দু উগ্রবাদীরা পুড়িয়ে মারে। তিনি বারবার পুলিশের কাছে টেলিফোন করলেও তাদেরকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। উগ্রবাদী হিন্দু সন্ত্রাসীরা বহু মসজিদ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। ওই দাঙ্গায় আড়াই লাখ মুসলিম গৃহহীন হয়।
সেই দাঙ্গার মূলহোতাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে অতিথি করা হলে তা দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।