আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক বৈঠকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ১০টি দেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস। এই পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের নির্ধারিত সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে এই বৈঠকে। এতে বলা হেেয়ছে, এ ক্ষেত্রে প্রধানত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে। তবে অর্থ পাচার হয়ে গেলে তা ফেরত আনা কঠিন হওয়ার কারণে পাচার বন্ধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি সমন্বিত ডাটাব্যাজ তৈরি করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশ হতে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের উপায়’ সংক্রান্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক বৈঠকে এমন মতামত উঠে এসেছে। বৈঠকে উত্থাপিত এক কার্যপত্রে বলা হয়েছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রধানত ১০টি দেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এসব দেশের তালিকায় রয়েছে- কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস।
‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ১০১৮’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী গ্রাহকদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৭ সালের শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪৮১ দশমিক ৩২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। ২০১৮ সাল শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১৭ দশমিক ৭২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৭৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা থাকলেও এর মধ্যে কী পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সুইজারল্যান্ডে গেছে তা নিশ্চিত নয়। এর একটি অংশ বিদেশে বসবাস ও ব্যবসারত বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের মাধ্যমে পাঠানো হতে পারে।
অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই)-এর ‘ট্রেড-রিলেটেড ইলিসিট ফাইন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ইন ১৩৫ ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০৮-১০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম। প্রতিবেদন মতে, ট্রেড মিস-ইনভয়েসিংয়ের (আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং) মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে ৯৬০ কোটি ডলার, ২০১৪ সালে ৬৩০ কোটি ডলার ও ২০১৫ সালে ৫৯০ কোটি ডলার অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশ থেকে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে পাচারকৃত অর্থের তথ্য-উপাত্ত ওই প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতে, হাল-নাগাদ উপাত্ত না-পাওয়া গেলেও ট্রেড মিস-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার ক্রমশ কমেছে।
সূত্র মতে, বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ (বিএফআইইউ) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানিলন্ডারিংয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সন্দেহ করার মত যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে ‘এগমন্ট সিকিউর ওয়েব’-এর মাধ্যমে বিদেশী ‘এফআইইউ’-এর কাছ থেকে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। তবে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে বিদেশী ‘এফআইইউ’-এর মাধ্যমে তথ্য পাওয়ার সুযোগ সীমিত। তবে ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স’ অনুরোধের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিদেশী সংস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বলা হয়েছে, এ প্রেক্ষিতে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ এবং বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ শনাক্তকরণ ও তা ফেরত আনার বিষয়ে ‘বিএফআইইউ’সহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা- ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’, সিআইডি (বাংলাদেশ পুলিশ), সিআইআইডি ও সিআইসি (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) ও মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অনুরোধ পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেছেন, অর্থ পাচার হয়ে গেলে তা ফেরত আনা কঠিন। কারণ পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দিতে উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা স্বচ্ছ নয়। তাদের আগ্রহ ও অঙ্গীকারের মধ্যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে যেকোনো উপায়ে দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ করাটা বিশেষ জরুরি। অর্থ পাচার বন্ধে ব্যাংকগুলোতে বিএফআইইউয়ের নির্দেশিত নীতিমালা যথাযথ বাস্তবায়ন এবং আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং প্রতিরোধে ব্যাংকের নিজস্ব ডাটাব্যাজের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় একটি ডাটাব্যাজ গড়ে তোলা দরকার। এতে করে অর্থ পাচার ঠেকানো অনেকাংশ সম্ভব হবে।