লিখেছেন ফারজানা নাজ
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অশ্রুতপ্রায় অধ্যায় ‘যুদ্ধশিশু’ বিষয়ক গবেষণায় বিগত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নিরলস গবেষণা করছেন কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক মুস্তফা চৌধুরী। কর্মসূত্রে তিনি কানাডার রাজধানী অটোয়ার কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কর্মসংস্থান এবং ইমিগ্রেশন, মানবসম্পদ বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছেন। তিনি ২০১১ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান। কানাডায় তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের সম্পৃক্ততায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কানাডায অভিষিক্ত হয়েছেন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে।
গ্রন্থাগার ও আর্কাইভে বিভাগে কর্মরত থাকাকালে মূলত নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণের দায়বদ্ধতা থেকে যুদ্ধশিশুদের বিষয় গবেষণা কর্ম শুরু করেন মুস্তফা চৌধুরী। তাঁর সমৃদ্ধ গবেষণার ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হয় ‘৭১র যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস (একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড) এই সমৃদ্ধ গ্রন্থটি। সাবলীল বাক্যবিন্যাস, সুচারু ও প্রাসঙ্গিকভাবে তথ্যবহুল প্রামাণ্যদলিল গবেষক তুলে ধরেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার শিকার বাংলাদেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত বীরাঙ্গনা মহীয়সী নারীদের জীবনের করুন অশ্রুত পরিণতি আর অনন্য আত্মত্যাগের ইতিহাসের আলোকিত দিক। সেই ধারাবাহিকতায় তাঁর এই গ্রন্থ প্রয়াসে গবেষক ১৫ জন যুদ্ধশিশুর জীবনের প্রামাণ্য সচিত্র তথ্যসংবলিত পূর্ণাঙ্গ ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশজুড়ে দেশের বিশ্বাসঘাতক রাজাকার ও আলবদরের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্রমাগত নিষ্ঠুর পৈশাচিক বর্বরতায় লাঞ্ছিত ধর্ষিত ও নির্যাতিতা হয়েছেন বাংলাদেশের অসংখ্য অসহায় মা–বোন।
এই মহান বীরাঙ্গনা নারীদের অকথ্য নির্যাতনের ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও ভূমিষ্ঠ ‘যুদ্ধ শিশুদের’ বাংলাদেশে যুদ্ধ পরবতী জীবন, অনেক নির্যাতিতা নারীকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো, সংকটময় মুহূর্তে সেই শিশুদের পাশে এসে দাঁড়ানো আন্তর্জাতিক রেডক্রসসহ উদারপন্থী সংস্থা এবং প্রবাসের বিশেষত কানাডার কয়েকটি পরিবারে তাদের দত্তক রূপে স্বীকৃতি, বৃহত্তর প্রবাসের পরিমণ্ডলে দত্তক সন্তান রূপে যাপিত জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বাস্তবতা, পরিণত বয়সে যুদ্ধশিশুদের আত্মপরিচয়ের সংকট, তাঁদের বর্তমান অনুভূতি ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষঙ্গের সমন্বয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক, মানবিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের সমন্বয়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে এই গ্রন্থের মূল পটভূমিকা। যুদ্ধপরবর্তী জীবনে বাংলাদেশের যুদ্ধ শিশুদের সামাজিক অবস্থান, বাংলাদেশের বিরাজমান সামাজিক কুসংস্কার ও ঘুণে ধরা রক্ষণশীলতা, নারীর অবদানের প্রতি ভ্রান্ত নেতিবাচক ও সংকীর্ণ মানসিকতা, বীরাঙ্গনা নারী অর্থাৎ এই শিশুদের মায়েদের সামাজিক চাপের মুখে পরিত্যাগ করা অথবা অবাঞ্ছিত রূপে আখ্যাদান, সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতার সেই সংকটময় পরিপ্রেক্ষিতে দেশের কেউ তেমন আগ্রহী না হলেও প্রবাসের বিশেষ করে কানাডায় এই শিশুদের দত্তকগ্রাহী কয়েকটি পরিবার শিশুদের দত্তক সন্তান হিসেবে গ্রহণ আর এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ও কানাডার প্রশাসনিক জটিলতা, গ্রন্থে আলোচিত ১৫ জন যুদ্ধ শিশুর বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়, ইতিবাচক ও নেতিবাচক বাস্তবতা, দত্তকগ্রাহী বাবা মায়েদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক, আত্মপরিচয় সম্পর্কে সঠিকভাবে জ্ঞাত হয়ে এই শিশুরা পরিণত বয়সে তাঁদের অনুভূতি, আবেগের যৌক্তিক আত্মবিশ্লেষণের ও তাঁদের শেকড়ের সন্ধান ইত্যাদি বিভিন্ন দিক সুনিপুণভাবে বিন্যাস লাভ করেছে তাঁর ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল সমৃদ্ধ গ্রন্থটিতে।
গবেষকের গ্রন্থে আলোচিত যুদ্ধ শিশুদের কয়েকজন হলেন শিখা, রানি, ওমর, অরুণ, রাজীব, মলি প্রদীপ, সমর, রুফিয়া রিতা, রেজিনা ও জরিনাসহ আরও অনেকে। এ ছাড়া গ্রন্থে আলোচিত কানাডার দত্তক গ্রহণকারী কয়েকজন দম্পতি হলেন কানাডার অন্টারিওর ডেইল ও ডোরেন গুড দম্পতি, ডেল ও ডোলা ওয়েহ লসি, কুইবেক প্রভিন্সের জোয়েল ও ট্রুডি হার্ট, লিওড ও সান্ড্রা সিম্পসন, ড. রবার্ট ও হেলকে ফেরিয়ে এবং সাস্কাচুনের রবিনা ও বারবারা মড়েল, নোভা স্কোশিয়ার কেনেথ ও মিৎজি ম্যাকলোগ প্রমুখ।
বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের নিয়ে প্রথমবারের মতো সমৃদ্ধ এই গবেষণা সমাজ ও ইতিহাস সচেতন পাঠককে অবধারিতভাবে আকৃষ্ট করার একটি সুদৃঢ় ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে এবং করবে। গবেষক গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে কানাডায় অবস্থানরত এই যুদ্ধশিশু ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং তাঁর গ্রন্থের একটি অধ্যায়জুড়ে তাঁদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যুদ্ধশিশুদের সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে গৃহীত নতুন একটি আইন ‘বাংলাদেশ পরিত্যক্ত শিশু অধ্যাদেশ বা অর্ডার ১৯৭২, পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন, নিষ্ঠুরতার, বিকৃত বর্বরতা ও গণধর্ষণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য দিক তার গ্রন্থে আলোকপাত হয়েছে।
গবেষকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক পারেন্টহুড ফেডারেশন, কানাডার সরকারি রেকর্ড হতে প্রাপ্ত তথ্যের সংযোজন পুরো গ্রন্থে অনন্য মাত্রা যোগ করে। এই দীর্ঘ গবেষণা কর্মে বাংলাদেশে ‘যুদ্ধশিশু’ বিষয়ক তথ্যের সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাব ও অপ্রতুলতা, অসহযোগিতার দিকটা গবেষকের কাজে বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ সারা বিশ্বের গণহত্যা এবং বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আরও বিস্তৃত গবেষণা হয় করা প্রয়োজন। আর এদিকে তরুণরা একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।
আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের কৃষ্টির স্বরূপ, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের প্রতিটি দিকের বুনিয়াদ সঠিকভাবে নির্মাণ, উপস্থাপন ও হৃদয়ঙ্গম করার যথাযথ প্রেক্ষাপট সৃষ্টির নিরিখে স্বাধীনতার ইতিহাসের অর্জন এবং একই সঙ্গে এর বর্বরতার স্বরূপকে তুলে ধরা প্রয়োজন। তাই উদাসীন না হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস গবেষণায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনয়নের লক্ষ্যে এ দিকটিতে ভবিষ্যতে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই মহীয়সী বীরাঙ্গনা নারীদের অনন্য আত্মত্যাগ ও যুদ্ধশিশুদের প্রতি দেশের সামাজিক কাঠামোয় সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার ইতিবাচক উদারনৈতিক কল্যাণকামী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানসিকতা গড়ে তোলা বিশেষ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এই গুরুত্ববাহী দিককে বৈশ্বিক অঙ্গনে তুলে ধরার প্রয়াসে ইংরেজি ভাষায় আমেরিকা ও বাংলাদেশ থেকে একই প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত হয়েছে লেখকের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য বাস্তব তথ্য সংবলিত গবেষণা গ্রন্থ—Picking Up the Pices: 1971 War Babies Odyssey from Bangladesh to Canada আমেরিকা থেকে প্রকাশিত) এবং Unconditional love: Story of Adaptations of 1971 War Baies. (একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স বাংলাদেশে)। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই অশ্রুতগাঁথার আর ইতিহাস সংরক্ষণকারী নিবেদিতপ্রাণ গবেষক মুস্তফা চৌধুরীর প্রয়াসের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।