সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বেগম জিয়া ছিলেন হুমায়ূনের একজন গুণগ্রাহী। হুমায়ূন আহমেদ এটা জানতেন। এ বিষয়ের ওপর কয়েকটি তথ্য দিতে চাই। দিতে চাই এই কারণে যে, হুমায়ূনকে আওয়ামী লীগের নৌকায় তোলার জন্য মরিয়া তত্পরতা চলছে। সরকারের সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালরা এজন্য আগ বাড়িয়ে দখল করে নিতে চাচ্ছে সব। মুছে দিতে চাইছে অন্য সব পরিচিতি। যা খুবই দৃষ্টিকটূ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।
শুরুটা করতে চেয়েছিলাম আমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু আপাতত সে প্রসঙ্গ থাক। অন্য একদিন এ বিষয় নিয়ে লেখা যাবে। তবে যেটুকু বিষয় যুক্ত কেবল সেটুকুই বলছি।
আমি তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘কথামালা’ নামে একটি সাহিত্য-সংস্কৃতিনির্ভর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করি। ৫০ মিনিটের প্রোগ্রাম। মাসে একবার প্রচার হয়। বলে রাখা ভালো, তখন বিটিভিই দেশের একমাত্র চ্যানেল।
মনীষী আহমদ ছফা একদিন রাগ করলেন আমার ওপর। কী করে বেড়াচ্ছেন? ইতিহাসে নাম লেখানোর জন্য কিছু করুন। দেশের স্বার্থে হুমায়ূনকে নিয়ে এগিয়ে যান। আমি প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো বিটিভিকে নিয়ে। জীবন্ত একজনের ওপর এককভাবে পঞ্চাশ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি প্রোগ্রাম করার যৌক্তিকতা নিয়ে তারা চিন্তায় পড়লেন। আমি গেলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মরহুম মোজাম্মেল হক তখন প্রেস সচিব। তাকে বললাম। তিনি নিজেও হুমায়ূনের মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। আমাকে নিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সব শুনে বললেন, হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন অসাধারণ গুণী লেখকের জন্য ৫০ মিনিটের একটা ম্যাগাজিন করা আর এমন বেশি কী? করুন।
আমি ছুটলাম হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে। কবি আতাহার খান আর আমি হাজির হলাম। হুমায়ূন ভাই সানন্দে সম্মতি দিলেন। নানা দৌড়ঝাঁপ করে ২০ দিনের মধ্যে শেষ করলাম ডকুমেন্টারির কাজ। প্রচার হলো যথারীতি ‘কথামালা : হুমায়ূন পর্ব’, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নির্মিত ও প্রচারিত বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। সময়টা ১৯৯৩ সাল, ৯ মার্চ।
৫৫ মিনিটের ওপর ছিল প্রোগ্রামটা। আজকের জিটিভির প্রধান নির্বাহী আমাদের প্রিয় শিল্পী রওশন আরা মুসতাফিজের স্বামী, মুসতাফিজুর রহমান তখন সম্ভবত অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান। তিনি আমার প্রযোজক আলাউদ্দিন আহমদকে বলে দিয়েছিলেন, ভালো প্রোগ্রাম হয়েছে। অতিরিক্ত সময় কোনো সমস্যা নয়।
অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল রাত ১১টায়। মোজাম্মেল ভাইয়ের ফোন, শিকদার, প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানটা দেখেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে বলেছেন।
ততদিনে মোজাম্মেল ভাইয়ের সঙ্গেও হুমায়ূন ভাইয়ের একটা ভালো সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। দু’জনই আমুদে মানুষ। মিল হয়ে গেল দ্রুত। মোজাম্মেল ভাই ও সে সময়কার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি সৈয়দ আবদাল আহমদের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হুমায়ূনের এক-দুবার সাক্ষাত্ও হয়ে গেল।
হুমায়ূন আহমেদ তখন ‘আগুনের পরশমণি’ নির্মাণ নিয়ে মেতে উঠেছেন। সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছবি। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টা জেনে তত্কালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে বলে দিলেন, যদি একটা ছবিকেও অনুদান দিতে হয় তাহলেও সেটা যেন হুমায়ূন আহমেদের ছবিকে দেয়া হয়। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সানন্দে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করলেন।
সরকারি অনুদানের পরিমাণ সে সময় ছিল মাত্র ১৮ লাখ বা ২৪ লাখ টাকা। আমার ঠিক মনে নেই। হুমায়ূন ছবি নিয়ে মাঠে নেমে গেলেন। দরকার সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সাহায্য। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ছবি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সদস্য, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান ইত্যাদি না হলে চলবে কেন? সে ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তার মিলিটারি সেক্রেটারি আজকের আওয়ামী লীগের এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী করে দিলেন।
ছবি রিলিজ করা যাচ্ছে। এফডিসিতে বকেয়া পড়ে গেছে ২০ লাখের ওপর টাকা। আবারও এগিয়ে এলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বললেন, ছবি বানাচ্ছেন হুমায়ূনের মতো নন্দিত কথাশিল্পী। ছবিটার উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ। এ ছবি তো পুরোটাই রাষ্ট্রের টাকায় হওয়ার কথা। এফডিসির পুরো পাওনা মওকুফ হয়ে গেল।
রিলিজের আগেই ছবি নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে উত্সাহ দেখালেন।
হুমায়ূনও চাইলেন ছবিটা প্রধানমন্ত্রীকে দেখাবেন। তড়িঘড়ি ব্যবস্থা হলো। দ্রুত ডিএফপি’র ছোট প্রেক্ষাগৃহটির মেশিনপত্র, প্রজেক্টর, স্ক্রিন ঝাড়-পোছ হলো। বেগম খালেদা জিয়া হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ছবিটা দেখলেন। ছবির শেষে দেখি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চোখ মুছছেন।
সে বছর আগুনের পরশমণি ৮টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেল। আমার আনন্দ ধরে না। সহায় হলেন তত্কালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম ও মরহুম মোজাম্মেল হক। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের গলায় পরিয়ে দিলেন ‘একুশে পদক’। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান।
লেখা কবি আব্দুল হাই শিকদার