লিখেছেন ড: মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী মন্ট্রিয়ল, কানাডা থেকে
ক্লাস থ্রিতে ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসার আগে মাইজদিতে নানুর বাড়ির চৌহদ্দিতেই থাকতাম আমরা-তিনটা ঘরের উত্তর ঘর নানুদের, আমরা থাকতাম মধ্যের ঘরে আর দক্ষিন ঘর ছিল ভাড়া।আমার জীবনের প্রথম বই-খাতা-পেনসিল-কলম-কালির সাথে পরিচিতি মাইজদিতে এই নানুর বাড়িতেই।
মা-খালা-মামাদের বই
(১)
তখনো বড় ভাইয়া বা আমি স্কুলে যাইনা। বড় খালা মারা যাওয়ায় আম্মাই ছিল ভাইবোনদের মধ্যে বড়। আম্মার মেট্রিক পরীক্ষার পাঁচ দিন আগে বড় ভাইয়ার জন্ম আর ইন্টারের পরে আমার। আমার ২ বছর বয়সের মধ্যেই আম্মার বিএ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় উনার লিখাপড়া করার স্মৃতি আমার খুব একটা নাই। মেঝ খালা ততদিনে চিটাগাং ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হওয়ায় উনাকে শুধু ছুটির সময়ই নানুর বাড়িতে দেখতাম। কিন্তু ছোট তিন খালা আর মামা তখনো স্কুল-কলেজে যায়। খালাদেরকে দেখতাম সন্ধার পরই ক্লাসের ‘পাঠ্যবই’ হাতে নিয়ে মাথা দুলায়ে দুলায়ে শব্দ কইরা পড়তে। এক একটা লাইন একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার ..অসংখ্যবার! এইযে এক একটা লাইন বারবার করে পড়া সেইটাকে উনারা বলতেন ‘পড়া মুখস্ত করা’-যা ‘পরীক্ষা’র জন্য করতে হয়।খালা-মামাদের বইয়ের পাতা উল্টায়ে পাল্টায়ে দেখা ছিল আমার শৈশবের একটা শখ। উনাদের কিছু বই ছিল ‘নিউজপ্রিন্ট’ এর, আবার কিছু বই ছিল ‘হোয়াইট প্রিন্ট’ কাগজে ছাপা। নিউজপ্রিন্ট’ এর বইগুলা কেমন যেন ময়লা ময়লা লাগতো, অত আকর্ষন পাইতামনা। সেই তুলনায় ‘হোয়াইট প্রিন্ট’ এর বইগুলা ছিল অনেক পরিষ্কার আর ঝকঝকে। এই বইগুলার পাতা ধইরা ধইরা দেখতে অনেক মজা লাগতো। বইয়ের কোন কোন লাইন এর নীচে আবার কলম বা পেন্সিল দিয়ে লাইন টানা থাকতো যেগুলারে বলা হইতো ‘ইম্পরটেন্ট’ লাইন।মাঝে মাঝে বইয়ের কোন কোন লাইনের শুরুতে এবং শেষে ব্র্যাকেট দিয়ে উপরে ছোট্ট কইরা ১,২ ইত্যাদি সংখ্যা লিখা রাখতেন। পরে বুঝছি ঐ ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ লাইনগুলো হল বইয়ের ‘অনুশীলনী’র বিভিন্ন ‘প্রশ্নের উত্তর’।এরকম পাতা উল্টাতে গিয়ে মাঝেমাঝে কোন কোন বইয়ের সাদা জায়গায় দেখতাম কলম দিয়ে লিখা দুইটা ‘অক্ষর’ আর এর মাঝখানে ‘+’ চিহ্ন। এই ‘অক্ষর সংযোগে’র তাৎপর্য তখন পুরাপুরি না বুঝলেও এগুলা যে ‘বিশেষ’ একটা কিছু এইটা টের পাইতাম অক্ষরগুলার কারুকাজ দেইখা। একটা যত্নের ছাপ বা অনুরাগ টের পাওয়া যাইতো।যাই হোক, খালাদের মত আমার একমাত্র মামারে কোনদিনও জোরে বই পড়তে দেখি নাই। উনি তখন মনে হয় কলেজে পড়তেন তাই দিনের বেশীর ভাগ সময়ই বাইরে থাকতেন। রাতেও ফিরতেন একটু দেরী কইরা। কদাচিৎ উনারে বই নিয়ে বসতে দেখছি কিন্তু উনার পড়ার আওয়াজ কখনো শুনি নাই। আমার সেই মামা এখন দেশের বড় একজন শিক্ষাবিদ এবং একটি ইউনিভার্সিটির ভিসি। এখন মনে হয় মামার পড়ার স্টাইলটা বোধ হয় আমার বড় ভাই পাইসিল আর আমি পাইসিলাম আমার খালাদের। সত্যি, এই বান্দা ভারসিটিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অংক বাদে বাকী পড়া জোরে জোরে ‘মুখস্ত’ করতো। অথচ বড় ভাইরে দেখছি বেশীর ভাগ সময়ই সাউন্ড না কইরা পড়তে!
(২)
আমার এই মামা-খালাদের মুখেই প্রথম বাংলা, ইংরেজী, অংক, বীজগনিত, পাটীগনিত, ভুগোল, বিজ্ঞান, ব্যাকরন-কারক-সমাস, ইতিহাস, পৌরনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,যুক্তিবিদ্যা এই নামগুলা শুনি যা একরকম মাথায় গাঁইথা গেসিল সেই ছোটকাল থেকেই। উনাদের বেশীর ভাগ বইই ছিল ক্লাসের ‘পাঠ্যবই’ বা ‘মেইন বই’। এর বাইরে বিষয় অনুযায়ী দুই একটা ‘নোট বই’ আর গনিত-জ্যামিতি ‘সমাধান’ ও বাসায় দেখতাম। সেই আমলে ‘পুথিঘর’ এর ‘জনৈক অভিজ্ঞ হেডমাস্টার প্রনীত’ নোট বই এর খুব প্রচলন ছিল, কিন্তু পরীক্ষায় সরাসরি নোট বইয়ের লিখা তুলে দিলে নাম্বার বেশী পাওয়া যাইতোনা। বরং পাঠ্যবই আর দুই তিনটা ‘নোটবই’ মিলায়া আলাদা কইরা অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর গুলা ‘নোট’ কইরা লিখলে উত্তরে বেশী তথ্য বা বৈচিত্র থাকতো আর পরীক্ষায়ও নাম্বার বেশী পাওয়া যাইতো। প্রাইভেট টিচারতো বেশী ছিলনা সেই যুগে, আম্মা-খালারা তাই নিজেরাই এই নোট করার কাজটা করতেন। আম্মা মনে হয় ভাইয়াকে ক্লাস এইট পর্যন্ত সব সাব্জেক্ট এর নোট কইরা দিতেন- বড় প্রশ্ন, সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর, ব্যাখ্যা, সারাংশ, রচনা, ভাব-সম্প্রসারন, চিঠি-দরখাস্ত সবই।ঐ নোটগুলা পরে আমিও পাইছিলাম। আমাদের সময়ে সম্ভবত ক্লাস এইট-নাইনের দিকে ‘নোট বই’ এর বদলে এক ধরনের ‘গাইড বই’ এর প্রচলন ঘটে। নামে ভিন্নতা থাকলেও এদের বিষয়বস্তু মুলত একি ছিল।পিঠাপিঠি থাকার কারনে বয়সানুক্রমে এক খালা হতে আরেক খালায় ক্লাসের ‘পাঠ্যবই’ আর ‘নোট বই’ বা লিখা ‘নোট’ এর হস্তান্তর হইতো। এরপরেও বই-খাতার অস্তিত্ব টিকা থাকলে বংশানুক্রমে আমরা ভাইগ্নারাও দুই-একটা বই বা নোট হাতে পাইতাম। এগুলার মধ্যে ব্যাকরন, রচনা, ইতিহাস, সমাজ আর বিজ্ঞানের বইগুলাই বেশী থাকতো। উচু ক্লাসের পাঠ্যবই অনেক সময় নিচু ক্লাসের ‘নোট’ লিখায় কাজে আসতো। বাসায় একটা ইংলিশ-টু-বেংগলি ডিকশনারি বা অভিধান ছিল যেইটা আম্মা মনে হয় উনার মেঝ মামার কাছ থেকে পাইছিলেন। এই বইটা অনেক পুরানা ছিল-উপরের মলাটটা কোনদিন দেখি নাই। বয়সের কারনে হোয়াইট প্রিন্ট এর কাগজ একটু লাল হয়ে উঠছিল। প্রথম আর শেষের দিকের কয়েকটা পাতাও খুইলা আসছিল।বইটার বাকী অংশ অনেক টেকসই ছিল এবং বহুদিন এইটা আমাদের বাসায় ছিল। আমার স্কুল জীবনের পুরাটা সময়ে এই ডিকশনারিটা ব্যবহার করছি। এটাই মনে হয় ছোটকালে আমার দেখা সবচাইতে মোটা আর ভারি বই!
(৩)
বছরের শুরুর দিকে দেখতাম খালারা নতুন বছরের বইগুলা নিয়া ফুঁড়ুনি আর লাল-সাদা রংয়ের একটা পেচানো সুতা দিয়া ‘বই সিলাই’ করতো। পুরা বই সিলাইর কাজটা ছিল বড় শৈল্পিক! আমি খুব মনযোগ দিয়া দেখতাম কেমনে বই ‘সিলাই’ করা হয়। প্রথমে বইয়ের বাধাই করা জায়গার কাছেই উপর থিকা নিচে পরপর সমান দুরত্বে তিনটা ছিদ্র করা হইতো।তারপর কেমনে যানি ফুঁড়ুনির মাথায় ছোট্ট একটা খাঁজে সুতাটার একটা মাথা আটকায়া কয়েকবার ঐ ছিদ্রগুলার মধ্য দিয়া সুতাটারে আনা নেয়া কইরা শেষে এক হাতে সুতার একমাথা একটু টান দিয়ে ধইরা আরেক হাতের আংগুল দিয়ে সুতার বাকী অংশটারে বইয়ের কোন ছিদ্রের উপর চাপ দিয়া ধইরা একটা ‘গিট্টু’ দেয়া হইতো। এর পরে বাড়তি সুতাটা কেচি বা ব্লেড দিয়া কাইটা নেয়া হইতো। এখন ছিদ্রগুলা যদি বইয়ের বেশী সাইডে পড়তো ‘সিলাই’টা একটু নড়বড়ে হয়ে যাইতো। মাঝেমধ্যেই সুতাটা ছিড়া গিয়া বইয়ের কোন ফর্মা বাইর হইয়া পড়তো। এতে বইয়ের চেহারা খারাপ হয়া যাইতো।কোন কোন সময় দেখা যাইতো দুইটা ছিদ্র একই লাইনে আর তিন নম্বর ছিদ্রটা একটু বাইরে বা ভিতরের দিকে পড়ছে। মাঝখানের ছিদ্রটা আগে বা পরে পড়লে অত ভেজাল হইতোনা কিন্তু ‘উপরের’ বা ‘নিচের’ ছিদ্র একপাশে পইড়া গেলে খবর আসিল। ঐ জায়গা দিয়াই সুতাটা ছিড়া যাওয়ার চান্স থাকতো বেশী। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তখন আগের ছিদ্র থেইকা একটু দুরে নতুন কইরা একটা ‘ছিদ্র’ কইরা বইটারে নতুন কইরা ‘সিলাই’ করা হইতো। নতুন কইরা ছিদ্র করতে গেলে অনেক সময় পাশাপাশি দুইটা ছিদ্র ‘জোড়া’ লাইগা একটা বড় ছিদ্রতে পরিনত হইতো। এতে বইয়ের বাইরের চেহারা একটু নষ্ট হইয়া যাইতো- দেখতে বড় খারাপ লাগতো। কিন্তু বইয়ে আলগা কাগজের কভার লাগাইলে এই বিচ্যুতি আর চোখে পড়তোনা।
বইয়ের উপরে প্রায় সময়ই খাকি রংয়ের শক্ত কাগজ বা পুরানা ক্যালেন্ডার এর কাগজের ‘আলগা কভার’ লাগানো থাকতো যার উপর বইটার নাম, খালাদের নাম, স্কুল বা কলেজের নাম এবং রোল নাম্বার লিখা থাকতো। খাকী কাগজটা আলাদা কিনতে পাওয়া যাইতো। কিন্তু আব্বার কাগজের ব্যবসা থাকায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কাগজের রীমের প্যাকেজিং এ যে খাকী কাগজ ব্যবহার করা হইতো সেইটা উনিই সরবরাহ করতেন। আর বছর শেষে পুরানো ক্যালেন্ডার রাইখা দেয়া হইতো বইয়ের কভার লাগানোর জন্য। এই আলগা কভার বইয়ের আসল মলাট আর সাইড ‘ছিড়া যাওয়া’ থিকা বইটারে সুরক্ষা করতো। এই কভার লাগানোর মধ্যেও একটা শিল্প টের পাইতাম: প্রথমে একটা বড় খাকি কাগজের টুকরা বা ক্যালেন্ডার এর পাতাকে একটু কসরত কইরা কেচি বা ব্লেড দিয়া কাইটা বইটার ফার্ষ্ট আর লাস্ট পাতা মোড়ানো হইতো। তারপর বাড়তি কাগজটা বইয়ের মলাটের ভিতরের দিকে তিনকোনার মত ভাঁজ কইরা আঠা বা টেপ দিয়া লাগায়ে দিয়া কভার বানানো সম্পন্ন হইতো। তারপর হাত দিয়া চাপ দিয়া ভাঁজগুলারে পোক্ত করা হইতো। এই কারুকাজ দেইখা সব সময় মনে হইতো কবে স্কুলে যামু, কবে আমার নিজেরও এরকম বই থাকবো এবং নিজেই নিজের বই বাধাই করমু! যাই হোক আলগা কভারের কারনে বইএর আসল প্রচ্ছদ দেখার সুযোগ খুব একটা হইতোনা। তবে অতিব্যবহারে অনেক সময় কভারটা খুইলা আসলে বা সামান্য ছিড়া গেলে ভেতর থিকা বইয়ের আসল মলাট বা প্রচ্ছদের একটা অংশ উকি মারতো। তখন কৌতুহলী হয়া আমিও ছিড়া কভারটা একটু উপরের দিকে তুলে ধইরা পুরা প্রচ্ছদটা দেখার চেষ্টা করতাম। এতে কইরা অনেক সময় কভারটা আরেকটু বেশী ছিড়া যাইতো। ভাগ্য ভালো যে খালারা কোনদিন দেখে নাই, বুঝেও নাই এই বাড়তি আকামের নায়ক কে বা কারা! যাই হোক খুইলা যাওয়া কভার উনারা আবার আঠা দিয়া লাগায়া দিতেন, নাইলে নতুন কইরা আবার ‘কভার’ লাগায়া দিতেন। পরবর্তীতে নিজের ছাত্রজীবনে এইরকম কইরা কত বই যে ‘সিলাই’ করছি বা বইয়ের উপর কত ক্যালেন্ডারের ‘কভার’ যে লাগাইছি তার ইয়ত্তা নাই। তবে আমাদের আমলে স্কচটেপ সহজে পাইতাম বইলা প্রায়ই সামান্য ছিড়া কভার টেপ দিয়া জোড়া লাগায়ে দিতাম। লাইটের আলোয় ঐ টেপ লাগানো জায়গাটা চকচক করতো।
(৪)
এইবার আসি ধর্মীয় বইয়ের কথায়। আম্মা আর নানুর দুইটা কোরান শরীফ ছিল যেগুলা উনারা কাপড় দিয়া সুন্দর কইরা প্যাঁচায়ে একটা উচু জায়গায় রাখতেন। আম্মার কোরান শরীফ এর মলাটটা ছিল ছাই রং প্লাস্টিকের আর কিছু কিছু পাতা খুইলা আসছিল। উনারা বলতেন ‘ওজু’ না কইরা ‘কোরান শরীফ’ পড়া যায়না। আব্বা, আম্মা আর নানুরে দেখতাম নিয়ম কইরা প্রতিদিন সকাল বেলা নামাজ পড়ার পর কাঠের ‘রেয়ালে’র মধ্যে কোরান শরীফ রাইখা ছোট্ট ‘তীরের’ মত একটু টুকরা কাগজ দিয়া অক্ষর ধইরা ধইরা সুর কইরা কোরান শরীফ পড়তে। অনেক সুন্দর লাগতো উনাদের তেলাওয়াত। যেই পাতায় পড়া শেষ হইতো ঐ পাতারই নিচের দিকে ঐ ছোট কাগজের টুকরাটারে একটু বাইরের দিকে রাইখা কোরান শরীফ বন্ধ করতেন আর আস্তে কইরা মলাটে একটা চুমু দিয়া কাপড় দিয়ে যত্ন কইরা পেচায়া নিতেন। এরপরে ‘রেয়াল’ বন্ধ কইরা কোরান শরীফ আর রেয়াল ঘরের উপরের দিকে ঝুলানো কাঠের তক্তার উপর যত্ন কইরা রাইখা দিতেন। মাঝে মাঝে উনাদের মুখে সুরার নাম, রুকু, পারা আর কোরান শরীফ ‘খতম’ মানে ‘পুরা কোরান পইড়া শেষ করা’র কথা শুনতাম। মনে মনে আমারও ‘সুরা শিখা’ বা ‘কোরান খতম’ করার ইচ্ছা হইতো। খালাদের কাছে আরবী অক্ষর, হরকত, মাদ, গুন আর শব্দ শিখার জন্য ‘কায়দা’, ‘আমপারা’ ( কোরান শরীফের ৩০ নম্বর পারা ) আর ‘আলিফ লাম মিম’ ( কোরান শরীফের ১ নম্বর পারা) নামে আলাদা তিনটা চিকন নিউজপ্রিন্টের বই ছিল। উনারা ভোরবেলা ফজরের পরে বাসা থেইকা বোর্ড স্কুলে হাইটা গিয়া আব্দুর রব হুজুরের কাছে কায়দা, আমপারা পড়তে যাইতেন। ঐখানে হুজুর বোর্ড স্কুলের বাইরে অথবা স্কুলের টিনের ঘরের ভিতরে চাটাই বিছায়া আশেপাশের হাজী বাড়ি, খোনার বাড়ি সহ আমাদের পাড়ার ২০-২৫ জন ছেলেমেয়েরে ১/২ ঘন্টা কইরা আরবী পড়াইতেন। আমি আর ভাইয়াও উনাদের পথ অনুসরন করে স্কুলে ভর্তি হবার আগ থিকাই আরবী পড়তে বোর্ড স্কুলে যাইতাম। ঐখানেই আমি কায়দা আর আমপারা পড়া শিখি। পরে বাসায় ঐ আব্দুর রব হুজুরকেই রাখলে উনার হাতেই প্রথম কোরান শরীফ খতম করি।তবে আমি নামাজ পড়ার জন্য আমপারার প্রথম ১০টা সুরা, আয়াতুল কুরসি আর সুরা হাশর আব্বার কাছে শিখি। আব্বাই আমারে নামাজ পড়া শিখাইছেন। বাসায় নানুর কাছে ‘নেয়ামুল কোরান’ আর ‘মকসুদুল মোমেনিন’ নামে দুইটা বই ছিল যেখান থেইকা উনি মাঝেমাঝে ‘দোয়া-দরূদ’ পড়তেন। আর সামনে থাকলে আমাদেরও দোয়া পইড়া ‘ফু’ দিয়া দিতেন। আম্মার কাছে ‘বেহেশতি জেওর’ নামে ঢাকার চকবাজার থেকে প্রকাশিত একটা বই ছিল যেইটা উনি মাঝেমাঝে পড়তেন। এই বইটার পাতাগুলা ছিল ‘হোয়াইট প্রিন্ট’ এর আর মলাটটা ছিল হালকা সবুজ রংয়ের- অনেক সুন্দর লাগতো, যদিও এই বইটা আমার কখনো পড়া হয় নাই। আম্মার কাছে হযরত আইয়ুব (আ:), বড়পীর আব্দুল কাদের জীলানী (র:) এবং বিবি ফাতিমা (রা:) এর জীবনী নিয়েও তিনটা বই ছিল যা স্কুলে ভর্তি হবার পরপরই পইড়া ফালাই।
(৫)
আমার আম্মা অনেক গল্পের বই পড়তেন। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, জরাসন্ধ, শংকর, বিমল, নীহার রন্জন, ফাল্গুনীর আম্মার প্রিয় রাইটার ছিল। উনার মুখে শেক্সপিয়ারের ওথেলো, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ এর কথা অনেক শুনতাম। কিন্তু আম্মা মনে হয় বড় ভাই, আমি আর আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাইর জন্মের পর আমাদেরকে সামলাইতে গিয়া খুব একটা সময় আর পাইতেন না গল্পের বই পড়ার। আম্মার কালেকশনে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, বড় দিদি, মেঝ দিদি, পরিনীতা, রামের সুমতি, দত্তা, দেবদাস হইতে শুরু কইরা বঙ্কিমের কপালকুন্ডলা, ইন্দিরা, দুর্গেশনন্দিনী, আনন্দমঠ, নীহার রঞ্জনের কীরিটী, ফাল্গুনীর হাসপাতাল, শাপ মোচন, উত্তর ফাল্গুনী, শংকরের এক ব্যাগ শংকর, মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্য, মুনির চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, সঞ্চয়িতা, নজরুলের সঞ্চিতা, রিক্তের বেদন, আকবর হোসেনের কী পাইনি, অবাঞ্ছিত, কৃষন চন্দর, বিমল মিত্র, বিমল কর ও অন্যান্য লেখকের মোটা-চিকন কত গল্পের বই যে ছিল! এই বইগুলা আমাদের বাসার কাচের দরজাওয়ালা একটা শোকেসের মধ্যে থাকতো, বাইর থিকা বইয়ের মলাট বা নাম চোখে পড়তো। মাঝেমাঝে শোকেস খুললে বইগুলা ভালো কইরা দেখার সুযোগ পাইতাম। খালা-মামারাও এই বইগুলা নিয়া পড়তেন। এগুলারে উনারা বলতেন ‘গল্পের বই’ যা কিনা ‘পাঠ্য বই’ বা ‘স্কুলের বই’ থেকে আলাদা। দুপুরে বা রাতে ‘পাঠ্যবই’ পড়ার পরে বা পরীক্ষা শেষে অবসরে উনারা শুইয়া শুইয়া এই গল্পের বইগুলা পড়তেন। এই বইগুলা স্কুলজীবনে ক্লাস ফোর ফাইভের দিকে পড়া শুরু কইরা মনে হয় সেভেন এইটের মধ্যে শেষ কইরা ফালাই। শোকেসের ঐবইগুলোর মধ্যে আব্বার কালেকশনের একটা ইংরেজী বই দেখসিলাম-আইয়ুব খানের ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’। এই বইটা ছোটবেলায় অনেক দেখছি কিন্তু তেমন নড়াচড়া করা হয় নাই বড় হবার আগে।
নানুর বাসায় খালা-মামাদের শেল্ফ এ কিছু সুন্দর রংগীন মলাট আর পরিষ্কার কাগজের রাশিয়ান বাংলা বই- ‘রুশ দেশের উপকথা’, ‘রুশ গল্প সংকলন’, ‘মা’, ‘ইস্পাত’, মাও সেতুং এর একটা ‘লাল’ বই, দুই-একটা ‘দস্যু বনহুর’ ও চোখে পড়তো। রাশিয়ান বইগুলোর পাতা এত ঝকঝকে আর মসৃন ছিল যে মাঝে মাঝে পাতার উপর থেকে নিচে হাতের আংগুল উঠানামা করায়ে পাতার মসৃনতা টের পাইবার চেষ্টা করতাম। পড়া শিখার পরপরই দুএকটা রাশিয়ান বই পইড়া ফালাই ওখান থিকা। এই বইগুলার কয়েকটা চরিত্র-আইভান, পাভেল, গুস্তাভ, আনা, শাশা এগুলার নাম এখনো মনে পড়ে। রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ এ একটু বড়দের কন্টেন্ট থাকায় পড়া নিষেধ ছিল। মনে আছে আমরা ঢাকায় চলে আসার আগে বড় ভাইয়ার বন্ধু সোহাগ ভাই উনারে দস্যু বনহুর এর ‘ নাথুরামের কবলে মনিরা’ বইটা উপহার দিসিল কিন্তু ‘বড়’ হবার আগে বইটা পড়া হয় নাই। ইমদাদুল হক মিলন এর ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ ও এরকম একটা বই ছিল। যাই হোক পরে বড় হইয়া এই বইগুলা পড়ে বিশেষ নেকি হাসিল করি! খালাদের কাছে আফজাল হোসেন আর ইমদাদুল হক মিলন এর ‘যুবকদ্বয়’ নামে একটা বই ছিল যেইটা প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা দিয়া নতুন কইরা শুরু করা যাইতো। উপরের মলাটে আফজালের ছবি এর পর তার লিখা, পিছনের মলাটে মিলনের ছবি এরপর তার লিখা শুরু। দুই অংশের ছাপা উল্টা করে থাকায় বইটা বিশেষ নজরে আসছিল। এইরকম অ্যারেন্জমেন্ট এর বই হোল লাইফে আমার আর চোখে পড়ে নাই। খালাদের কাছে কমলা রংয়ের মলাটে নজরুলের একটা কবিতা সংকলন ছিল যেখানে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘শিকল পরার ছল’, ‘লিচুচোর’, ‘বিদ্রোহী’ এই কবিতা গুলা ছিল। উনারা নজরুলের এই কবিতাগুলা, শামসুর রাহমানের ‘ স্বাধীনতা তুমি’, আবু জাফর ওবায়দুল্লার ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ এই কবিতাগুলা আবৃত্তি করতেন, তবে বেশী শুনা যাইতো উনাদের কলেজ বা ভার্সিটির কোন প্রোগ্রামের আগে, রিহার্সেল এর সময়। আমার খালারা ভাল আবৃত্তি করতেন-এক খালা কলেজে থাকতে কবিতা আবৃত্তিতে কুমিল্লা বোর্ডে ফার্ষ্ট হইছিলেন। পেপারে উনার ছবি আসছিল এবং ঐ পেপার কাটিংটা আমাদের বাসার অ্যালবামে অনেকদিন ছিল। এই খালা পরে ঢাকা ভার্সিটিতে গিয়াও অনেক পুরষ্কার পাইছিলেন। উনারে কয়েকবার বিটিভিতে ভার্সিটির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানেও দেখায়। আমরা নানারবাড়ির সাদাকালো টেলিভিশনে আয়োজন কইরা বইসা ঐ অনুষ্ঠান দেখছি- এক অবিস্মরনীয় ব্যাপার ছিল নিজের আপন মানুষকে বিটিভিতে দ্যাখার। উনি এখন ঢাকার এক কলেজে ভুগোল এর অধ্যাপক, সুন্দর কবিতাও লিখেন। আরেক খালা পিটিআই স্কুলে উনার ট্রেনিংয়ের সময় ‘সন্তান হারা মা’র চরিত্রে অভিনয় কইরা আবৃত্তির এক পর্যায়ে দর্শক -ছাত্রদের সারি থেকে আমারে টাইনা নেন-একটু লজ্জা পাইসিলাম মনে আছে এখনো। আমার মামাও মনে হয় শখে কবিতা লিখতেন। মাইজদির কোন একটা বাংলা ম্যাগাজিনে (গাংচীল) এরশাদ আমলে উনার একটা স্বৈরাচার-বিরোধী কবিতা ছাপা হয়। নিরাপত্তার জন্য উনার নাম একটু নাম চেন্জ কইরা ছাপা হয় কবিতাটিতে- এইটুকু মনে আছে। মামার কাছে কয়েক সপ্তাহ পরপর বা মাসে একবার ‘উদয়ন’ নামে একটা রাশিয়ান পত্রিকা আসতো। এত সু্ন্দর ঝকঝকে পিছলা কাগজ আর রংগিন পত্রিকা সেই আমলে আর চোখে পড়ে নাই।
বই পড়ার হাতেখড়ি
(১)
মাইজদি পিটিআই স্কুলে বড় ভাই ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়েন।উনি যখন ক্লাস ফোরে উঠে আমি তখন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই। আমার আর ভাইয়ার অক্ষরজ্ঞান হয় মুলত আম্মার হাতধরেই। আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম বইলা আম্মা যখন উনারে পড়াইতো আমারো হালকা-পাতলা কিছু কিছু জিনিস মুখস্ত হয়া যাইতো। একটা রংগিন ছবি-সমৃদ্ধ বর্নমালা’ বই এর কথা মনে আছে যেখানে ‘অ’ তে অজগর, ‘আ’ তে আম পড়ে বর্নমালা শিখছিলাম। ঐ বইয়ে বিশাল একটা অজগরের ছবি আমার এখনো মনে আছে। একই সময়ে কার, ফলা, যুক্তাক্ষর, শব্দ, বিভিন্ন ফুল, ফল, দিন, মাস, দিক এর নাম আর বাক্য পড়তে শিখি সীতানাথ বসাক প্রনিত ‘আদর্শলিপি’ থিকা। একটা হালকা হলুদ রংয়ের পাতলা মলাট আর নিউজপ্রিন্ট এর উপর কাল অক্ষরে ছাপা চিকন আদর্শলিপি বইটা একটু কঠিন লাগতো। এ বইতে ‘ঋ’ অক্ষরের পর ‘লি’ নামে ‘৯’ এর মত দেখতে একটা স্বরবর্ন ছিল কিন্তু ঐটার কোন ব্যবহার খুজে পাই নাই। পরবর্তীতে দেখি যে বাংলা বর্নমালা থিকা ঐ ‘লি’ অক্ষরটা উইঠা গেছে। ঐ বইয়ের কয়েকটা বাক্যের কথা এখনো মনে আছে- অ- অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো, আ- আলস্য দোষের আকর, ই- ইক্ষু রস অতি মিষ্ট, ঈ- ঈশ্বরকে বন্দনা করো, ঊ- ঊর্ধমুখে গমন করিওনা ইত্যাদি আরও অনেক নীতি-আদর্শিক বাক্য। স্কুলে ক্লাস ওয়ান-টুতে দরকার না থাকলেও আম্মা আমাদেরকে ইংরেজী বর্নমালা ঘরে বইসা শিখায় কিন্তু ক্লাস থ্রির আগে ঐটার অত কোন গুরুত্ব ছিলনা। স্কুলে ভর্তির আগেই একটা চিকন লাল কভারের ‘শতকিয়া’ বা ‘ধারাপাত’ বই থিকা বিভিন্ন সংখ্যা, যোগ, বিয়োগ, গুন-ভাগ আর নামতা শিখি। অবশ্য আব্বা আমারে ২ থেকে ২০ পর্যন্ত সবগুলা নামতা মুখেমুখে শিখাইছিলেন। এই জিনিসগুলার অনেক কিছুই ভাইয়ারে পড়ানোর সময় আমারও মাথায় ঢুইকা যায়। দু:খ লাগছিল উনি যখন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়- আমি কেন উনার সাথে ভর্তি হইতে পারলামনা!
(২)
ক্লাস টু পর্যন্ত বাংলা আর অংক বই ছাড়া আমাদের আর কোন বোর্ডের বই ছিলনা এবং এই দুইটা বইই স্কুল থেকে আমাদেরকে ফ্রি দেয়া হইতো। বাংলা বইর নাম ছিল ‘আমার বই’ আর অংক বইয়ের নাম ছিল ‘গনিত’। বড় ভাইয়ার সময়ে বোর্ডের বাংলা বই বাদে বাকীসব বই নিউজপ্রিন্টে ছাপা হলেও আমাদের সময়ে ক্লাস ফোর আর ফাইভ এর দুই-একটা বই বাদে সবগুলো বইই উন্নতমানের হোয়াইট প্রিন্ট কাগজে ছাপা হইতো। বছরের শুরুতে নতুন বই পাবার জন্য কী যে উত্তেজনায় অপেক্ষায় করতাম বইলা বুঝাইতে পারমুনা! নতুন বই পাইতে দেরী হইলে আব্বার সাথে ঘ্যানর ঘ্যানর কইরা মাইজদি টাউনের জিলা স্কুলের সামনের ‘বুক সেন্টার’ লাইব্রেরি হইতে বাংলা আর অংক বই কিনা আনতাম। পরে বোর্ডের বই হাতে পাইলে একই বই দুইটা হয়া যাইতো। নিজেরে একটু সমৃদ্ধ মনে হইতো! যাই হোক নতুন বই হাতে পাইলেই প্রধান কাজ ছিল নতুন পাতা আর ছাপার কালির গন্ধ শুঁকা আর কিছুক্ষন পরপর বইএর পাতা নাড়াচড়া কইরা দেখা। তারপর রাতের বেলা যত্ন কইরা মাথার কাছে বই দুইটা রাইখা ঘুম দিতাম। পুরাপুরি ব্যবহারের আগে অপেক্ষা করতাম ‘বই বাধাই’ আর বইয়ের উপর ‘ক্যালেন্ডারের কভার’ লাগানোর জন্য। আমাদের ক্লাস ওয়ান আর টুতে স্কুল থিকা ‘পরিবেশ পরিচিতি সমাজ ও বিজ্ঞান‘ নামে দুইটা চিকন বই সিলেক্ট কইরা দিসিল। এই বইগুলা বোর্ডের বই ছিলনা কিন্তু ‘বুক সেন্টার’ থেইকা আব্বা আমাদেরকে কিনা দিত। এই বই থেকেই প্রথম পরিবেশ, বিজ্ঞান, দেশ, শহর,বিভাগ, জেলা, থানা/উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম, সাগর, মহাসাগর, হ্রদ, সমভূমি, মালভুমি, প্রনালী এগুলার সংজ্ঞা শিখি। ভাইয়ারে অবশ্য উনার ক্লাস থ্রি-ফোর-ফাইভে বোর্ডের ইংরেজী, সমাজ, বিজ্ঞান আর ধর্ম বই পড়তে দেখছি। কিন্তু উনার সময় বইগুলা মনে হয় কিনতে হইতো-তখনো প্রাথমিক শ্রেনীতে বোর্ডের বই ফ্রি দেয়া হইতোনা। স্কুলের ‘ইংলিশ ফর টুডে’র বাইরেও আম্মা ঢাকা থিকা মামারে দিয়া ‘অ্যাকটিভ ইংলিশ’ আর ‘ওয়ার্ক বুক’ নামে দুইটা বই আনাইয়া আলাদাভাবে ভাইয়ারে ইংরেজী শিখাইতেন। এই বই দুইটা আমারেও ক্লাস থ্রি থিকা পড়ানো হয়। ক্লাস ফাইভে ভাইয়ার বৃত্তি পরীক্ষার আগে ‘ছাত্রসখা’ নামে একটা মোটা বই কিনা হয় যেখানে দেশের চারটা বিভাগের বৃত্তি পরীক্ষার প্রশ্ন আর উত্তর থাকতো। দুই একটা পুথিঘরের নোট বইও ছিল বাসায় কিন্তু ওগুলা ভাইয়ারে পড়তে না দিয়া আম্মা নিজের হাতেই নোট কইরা দিতেন। আম্মা অসীম ধৈর্য নিয়ে এই ‘ছাত্রসখা’ পড়ায়া, বিভিন্ন বিষয়ের ‘নোট’, রচনা নিজের হাতে লিখা দিয়া ভাইয়ারে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য তৈরী করেন। উনার সেই চেষ্টা বৃথা যায় নাই- ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ভাইয়া পুরা চিটাগাং বিভাগে ট্যালেন্টপুলে ফার্ষ্ট হইছিলেন। এর আগে ক্লাস ফোরে ফেনিতে এক আঞ্চলিক বৃত্তি পরীক্ষায়ও ভাইয়া ফার্ষ্ট হয়। ক্লাস সেভেনে ভাইয়ারে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করার জন্য আম্মা একটা ‘গুরুগৃহে’র ‘ক্যাডেট গাইড’ ঢাকা থিকা মামারে দিয়া কিনা আনাইছিলেন। আম্মা ভাইয়ারে ক্লাস ফাইভ থিকাই এই ক্যাডেট গাইড থেকে অনেক কিছু পড়াইতে শুরু করেন। এই গাইডে বাংলা, ইংরেজী, অংক, জ্যামিতি, শব্দার্থ, ব্যাকরন, এক কথায় প্রকাশ, ট্র্যান্সলেশন, রচনা, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, রচনা, সাধারন জ্ঞান সবকিছু ছিল! আমার কাছে এই বইটারে একরকম ‘বিশ্বকোষ’ মনে হইতো। আম্মার এই প্রচেষ্টাও সফল হয়- ভাইয়া ক্লাস সেভেনে ঠিকই ক্যাডেট কলেজে চান্স পান এবং পড়েন। স্কুলে ভর্তির পর ইংরেজী কথাবার্তা শিখার জন্য আব্বা ‘র্যাপিডেক্স ইংলিশ’ নামে মোটা একটা বইও কিনা আনেন আমাদের জন্য। এই ধরনের বাড়তি বইগুলা পড়ানোর কারনেই মনে হয় ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিয়া স্কুলে ভর্তি হওয়া সহজ হয় আমাদের দুই ভাইয়ের।
(৩)
মাইজদি পিটিআই স্কুলে ভাইয়ার ক্লাশ ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়ার সময় উনার বিভিন্ন ক্লাসের ‘বাংলা বই’ আর ‘চয়নিকা বই’ এর গল্প-কবিতাগুলা উনার সাথে সাথে আমারও একরকম মুখস্ত হয়ে যায়। আমাদের সময়ে বাংলা বইয়ের নাম ছিল ‘আমার বই’। ক্লাস ওয়ানের বাংলা বইয়ের ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা’, ‘ভোর হল দোর খোল’, ‘আজ ঈদ মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ’, ক্লাস টু’র বইয়ের ‘নাম তার মতি বিল’, ‘পালের নাও’, ‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মত’, ‘রংতুলিতে ছোপছাপ’, ‘একজন সৎ মানুষের কাহিনী, ‘কক্সবাজারে একদিন’, ‘ছাতার কবলে বাঘ’, ‘দুখু মিয়া’র গল্প, ক্লাস থ্রি’র বই এর ‘এমন যদি হত’, ‘আজব দেশের ধন্যরাজা’, ‘কাটুমের গল্প’, ‘পোশাকের গুনে’, ক্লাস ফোর এর বইয়ের ‘বায়েজিদ বোস্তামী’, ‘চীন জাপানের শিশু’, ‘সুখী মানুষ’, ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’, ক্লাস ফাইভের বইয়ের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’, ‘স্বর্গ-নরক’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী’, ‘স্বনির্ভর আরেক যুদ্ধ’, ‘বিড়ম্বনা’, ‘কুপোকাত’, ‘ঝড়ের পরে’ এই কবিতা আর গল্পগুলা আম্মা যখন ভাইয়ারে পড়াইতো বারবার শুনতে শুনতে আমারো মুখস্ত হয়ে যাইতো। ‘ঝড়ের পরে’ গল্পে একটা লাইন ছিল “সবাই অবাক সবাই ভাবে ব্যাপারখানা কি, ভয়কাতুরে মাহবুব আজ এমন সাহসী?” নিজের নামে একটা পড়ার লাইন শুইনা মনে অনেক রোমাঞ্চ লাগতো সেই সময়। এই গল্প-কবিতার বেশীর ভাগই আমাদের সময়েও বাংলা বইতে ছিল বলে পড়া মুখস্ত বা বুঝার ক্ষেত্রে কোন ঝামেলা পোহাইতে হয় নাই। ভাইয়া আর আমাদের সময় ক্লাস ওয়ান-টু’র বই পুরাটাই একরকম ছিল- একই গল্প আর কবিতা। শুধু আমাদের সময় থেকেই ক্লাস ওয়ান থিকা ক্লাস সেভেন এর বাংলা বইয়ে ধাপে ধাপে সাত বীরশ্রেষ্ঠর গল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমি প্রথম বীরশ্রেষ্ঠের গল্প পাই ক্লাস টু’র বাংলা বইতে- “আমি মরবো তোমাদের বাঁচাবো” নামে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নুর মোহম্মদ শেখ এর জীবন আর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার গল্প।
ভাইয়ার চয়নিকা বইতে ছোটদের অনেক মজার মজার গল্প-কবিতা থাকতো। এ বইয়ের একটা কবিতা ‘ক্রিং ক্রিং টেলিফোন’ আমার অনেক প্রিয় ছিল। কবিতাটার সাথে বইয়ের ঐ পৃষ্ঠায় একটা বিড়াল টেলিফোন কানে ধরে ইঁদুরের সাথে কথা বলতেছে-এইরকম একটা মজার ছবিও ছিল। চয়নিকা বই থেকেই প্রথম ‘নিজাম ডাকাত’, ‘সুয়োরানি আর দুয়োরানির গল্প- লবনের মত আর চিনির মত ভালবাসি’, ‘খরগোস আর কচ্ছপের গল্প’ এই গল্পগুলা পড়ি। সত্যিই একটা মজার বই ছিল এই চয়নিকা। দুর্ভাগ্য যে আমি স্কুলে ভর্তি হবার পর এই বইটা মনে হয় তুলে নেয়া হয়। অনেক মিস করসিলাম এই বইটা!
(৪)
পিটিআই স্কুলে ভাইয়া ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়েন এবং প্রতি ক্লাশেই ফার্ষ্ট হইতেন। স্কুলের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে ‘প্রথম পুরষ্কার’ হিসেবে উনি ‘তাপসী রাবেয়া বসরী (রা:), বিবি রহিমা (রা:)’, খাজা মাইনুদ্দীন চিশতি (রঃ)’, বিশ্বনবী, ‘মোজেজায়ে নূরনবী’- এই পাঁচটি মোটা হার্ড-কভারের মলাট আর নিউজপ্রিন্টে ছাপা বই পাইছিলেন। পড়তে শিখার পর আমিও ঐ বইগুলা পড়তে শুরু করি। এই বইগুলার শুরুতে নবীদের নামের একটা লিস্ট থাকতো। মুলত সেখান থিকাই আমি অনেক নবী-রাসুলের নাম জানতে পারি। আম্মা শিখাইছিলেন যে সকল নবীদের নামের শেষে ‘আলাইহিস সালাম (আ:)’ কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা:) এর নামের শেষে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম’ অবশ্যই বলতে হবে। আমি নিজেও পিটিআই স্কুলে ক্লাস ওয়ান আর টুতে ভালো রেজাল্টের জন্য ‘হযরত ইসমাইল (আঃ)’ আর ‘হযরত বেলাল (র:) এর জীবনী সংক্রান্ত দুইটা বই পুরষ্কার হিসাবে পাইছিলাম। বহুদিন পর্যন্ত এই বইগুলা আমার কালেকশনে ছিল। পরে বাসা বদলাইতে গিয়া অনেকগুলা বইই হারায়ে যায়।
(৫)
মামা ইন্টারের পরে যখন ভার্সিটিতে পড়তে ঢাকা চলে যান তখন ঢাকা থেকে মাইজদিতে ছুটিতে আসার সময় আমার আর ভাইয়ার জন্য দুই-তিনটা কইরা চীনা আর রাশিয়ান বাংলা গল্পের বই, মুক্তধারার বাংলা ছড়ার বই নিয়া আসতেন। এই বইগুলাতে ছোট ছোট গল্প-কবিতা আর অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি থাকতো। নতুন বইএর গন্ধ শুঁকতেও অনেক ভালো লাগতো। বইগুলার নাম এখন আর মনে নাই তবে এই বইগুলা পড়েই সম্ভবত আমার গল্পের বই পড়ার আগ্রহ তৈরী হয়। নিয়ম ছিল দুপুরে ঘুমানোর সময় অথবা রাতে স্কুলের পড়া শেষ কইরা পরে গল্পের বই পড়ার।অবশ্য স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে এই নিয়মে একটু শিথীলতা আসতো। তখন আরো বেশী সময় জুড়ে ‘গল্পের বই’ পড়া যাইতো।
স্কুলে থাকতে একবার ভাইয়া আব্বার সাথে ঢাকা যায়। আসার সময় উনি ‘গোপাল ভাঁড়’ এর একটা চিকন নিউজপ্রিন্টের বই নিয়া আসেন। এই প্রথম বাংলায় লিখা একটা পিউর হাসির ‘গল্পের বই’ পড়ি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সাথে গোপালের সুক্ষ রসিকতায় কী যে মজা পাইতাম তখন! ভাইয়া এই বইটার সাথে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থিকা প্রকাশিত ‘হযরত মুসা (আ:)’ এর জীবনী সংক্রান্ত আরেকটা বইও নিয়া আসেন। এই বইটা রংগিন হোয়াইট প্রিন্টের ছিল আর বইয়ের মলাট অনেক শক্ত কভারের ছিল। এরপরে আরেকবার ঢাকা থেকে আসার সময় ভাইয়া ‘বাংলাদেশী হাসির গল্প’, ও ‘আলাদিন’ নামে দুইটা বই নিয়া আসে। অনেক মজা পাইছিলাম এই বই দুইটা পইড়া। এগুলা হোয়াইট প্রিন্টে ছাপা ছিল, আর বইয়ের ভিতরে অনেক ছবিও থাকতো। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র একটা মোটা নিউজপ্রিন্টের বইও মনে হয় এই সময় পড়ে ফেলি। ক্লাস টুতে থাকতে আমার ক্লাসের এক বন্ধু দীপেলের কাছ থিকা একটা নামবিহীন রূপকথার বই হাতে পাই। বইটা সম্ভবত ইন্ডিয়ান কিন্তু কোন মলাট না থাকায় কোনদিন জানতে পারি নাই বইটার নাম আসলে কি ছিল। কিন্তু বইটির কাগজ, ছাপা, ভেতরের রংগিন ছবি আর গল্পগুলো এত বৈচিত্রময় আর আকর্ষনীয় ছিল যে পড়ার সময় এক অন্য জগতে হারায়া যাইতাম। দুর্ভাগ্যক্রমে বইটা পরে হারায়ে ফেলি। এবইটার মত আর কোন বই এতটা দাগ কাটে নাই ঐসময়ে। এখনো মনে হয় বইটা যদি কোনভাবে খুইজা পাইতাম আরেকবার!
ক্লাস টু’র মাঝামাঝিতে আব্বা একবার ঢাকা থিকা ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র উপর একটা চিকন রংগিন বই নিয়া আসেন। এইটাই মনে হয় আমার পড়া প্রথম ‘কমিক্স’ স্টাইলে লিখা একটা বই যেখানে আলীবর্দি, সিরাজ, মীরজাফর, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, মানিকচাঁদ, মোহনলাল, হলওয়েল, ক্লাইভ, আলেয়া, লুৎফা, ঘসেটি বেগম, গোলাম হোসেন এই চরিত্রগুলার অনেক রংগিন ছবি আঁকা ছিল। ছবিগুলো অনেক জীবন্ত লাগতো এবং বহুদিন পর্যন্ত এই ছবিগুলাকেই ইনাদের আসল চেহারা মনে হইতো। এখনো পলাশীর যুদ্ধের এই চরিত্রগুলার কথা মনে হইলেই ঐ বইয়ের ছবিগুলা চোখে ভেসে উঠে। বইয়ের কারেক্টারগুলার মুখের ডায়লগও ছিল অনেক মজার। এতবার এই বইটা পড়ছি যে সবগুলা লাইন মুখস্ত হয়ে গেসিল!
এইছিল মাইজদি জীবনে ক্লাস টু পর্যন্ত নানার বাড়ির আবহে আমার বিভিন্ন পাঠ্যবই, নোট বই, ধর্মের বই আর গল্পের বইয়ের সাথে পরিচিতি।পরে ক্লাস থ্রিতে ঢাকায় আসার পর ক্লাসের ‘পাঠ্যবই’ এর বাইরেও নানারকম ‘গল্পের বই’ – ইন্দ্রজাল কমিক্স এর বেতাল (ফ্যান্টম), ম্যানড্রেক, বাহাদুর, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল, হাঁদাভোদা, চাচা চৌধুরী, টিনটিন, ফেলুদা, প্রফেসর শংকু, সুকুমার রায়, হুমায়ুন আহমেদ, আলিফ লায়লা, রামায়ন, মহাভারত, গ্রীক ট্রাজেডি, সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা, কুয়াশা, ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক, অনুবাদ, মাসুদ রানা, ওয়েষ্টার্ন , সাইন্স ফিকশন এগুলার পড়া শুরু হয়। সেই আলোচনা না হয় আরেকদিন।