সংসার জীবন থেকে বহু দূরে তাদের অবস্থান। তাদের নেই বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কিংবা স্ত্রী-সন্তান। এভাবেই দিন পার করে যাচ্ছেন একদল ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীরা। বলছি, নাগা সাধুদের কথা। তারা সবসময়ই সাধনার উদ্দেশ্যে ধ্যানমগ্ন থাকেন। ভারতীয় উপমহাদেশে সানাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন তীর্থস্থানে নাগা সাধুদের দেখা মেলে।
নাগাদের বিবরণ
নগ্ন একদল মানুষ তারা। সারা শরীরে কোনো বস্ত্র থাকে না তাদের। স্বাভাবিকভাবেই আমরা এমন মানুষদের পাগল বলে আখ্যায়িত করে থাকি, তবে নাগারা পাগল নন। তারা দুনিয়ার লোভ-লালসা ভুলে এক আধ্যাত্মিক জীবন পাওয়ার আশায় ধ্যানরত থাকেন। তবে একজন নাগাকে অত্যন্ত কঠোর নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এরপর চরম দীক্ষা শেষে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তার সন্ন্যাসী বনে যান
নগ্ন শরীরে নিত্যদিন ছাই মাখেন তারা। গোসল কিংবা পরিষ্কারের বালাই তাদের মধ্যে নেই। গ্রীষ্ম, শীত, বর্ষা কোনো ঋতুতেই শরীরে কাপড় পরেন না তারা। সাবান বা কোনো প্রসাধনীও কখনো তারা শরীরে ব্যবহার করেন না। মাথার চুলগুলো দীর্ঘকাল যত্নের অভাবে লম্বা হয়ে জট পাকানো তাদের, দাড়িরও একই দশা।
তাদের গলায় ও কোমরে থাকে মোটা অসংখ্য রুদ্রাক্ষের মালা। তবে সব নাগা সাধুদের একটি বিষয় মিল আছে তা হলো প্রত্যেকেই নগ্ন। নাগা সাধুদের কাছে অগ্নি মহা পবিত্র দর্শনের বস্তু। এজন্য নিজেদের অবস্থানের কাছাকাছি আগুন জালিয়ে রাখেন তারা। এমনকি তারা যেখানেই থাকুক না কেন পাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখে।
নাগা সাধুদের উৎপত্তি
সংস্কৃত ভাষায় নাগা অর্থ পর্বত। পাহাড় এবং আশেপাশে বসবাসকারীরা পাহাড়ি বা নাগা নামে পরিচিত। তবে নাগা সাধুদের দ্বারা বিশেষ শ্রেণির মানুষদেরকে বোঝায়। নাগা সাধুদের ইতিহাস অনেক পুরাতন। প্রাচীন মহেঞ্জাদারো জনপদের মুদ্রার চিত্রে নাগা সাধুদের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। এই চিত্রগুলোতে দেখা যায়, নাগা সাধুরা পশুপতিনাথ রূপে ভগবান শিবের উপাসনা করছে।
আলেকজান্ডার এবং তার সৈন্যরাও নাগা সাধুদের মুখোমুখি হয়েছিল। বুদ্ধ এবং মহাবীর নাগাদের তপস্যা, মানুষ এবং মাতৃভূমির প্রতি নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। জানা যায়, ভারতে যখন বকধার্মিকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিল তখন গুরু শংকরাচার্য তাদের রুখতে একটি খারু গঠন করেন। এই সঙ্ঘের মাধ্যমেই নাগা সাধুদের বর্তমান ধারার উৎপত্তি ঘটে। নাগারা বরাবরই শাস্ত্রজ্ঞান ও অস্ত্রজ্ঞান উভয় বিষয়েই সমান দক্ষ ছিল।
একসময় তারা এ দুটির সমন্বয়ে সনাতন ধর্ম রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল। জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রচলিত হওয়ার পর বিভিন্ন সময় নাগা সাধুরা স্ব-ধর্ম রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তারা অনেক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এর মধ্যে ১৭৬০ এর দশকে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। অনেক জমিদারের পক্ষ নিয়েও তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
নাগা সাধু হওয়ার প্রক্রিয়া
দীর্ঘ এবং কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন নাগা সন্ন্যাসীতে পরিণত হন। খুব ছোট বয়স থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। নাগা সাধু তৈরির প্রক্রিয়া খুব গোপনীয়। প্রাথমিক অবস্থায় ১২ বছর কঠোর প্রশিক্ষণ চলে। এই সময় খাদ্যের অনেক বিধি-নিষেধ থাকে। তারা নিজেরাই খাদ্য তৈরি করে খায়। প্রাথমিক এই স্তরে নিজের গুরু সেবা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
একজন প্রকৃত নাগা সাধু হওয়ার পথে ভুল হওয়ার সুযোগ খুবই কম থাকে। যদি কেউ প্রশিক্ষণ চলাকালীন কোনো ভুল করে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। একজন নাগা সন্ন্যাসী প্রস্তুত হতে ২০ বছর সময় লাগে। আট বছর বয়সে নাগা সাধু হতে ইচ্ছুকদের কঠিন পরীক্ষা নেয়া হয়।
শিশুরা এই পরীক্ষায় পাশ করলে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়। এরপর একটা মন্ত্র দেয়া হয় অতঃপর ১২ বছর বয়সে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ছোট নাগাদের প্রশিক্ষণ অনেকটা সামরিক বাহিনীর মতো বললেও ভুল হবে না। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের অটল থাকার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দেশ এবং সমাজের প্রয়োজনে তাদের অস্ত্র ধারণের প্রশিক্ষণও দেয়া
নাগা সন্ন্যাসীদের নিজেদের কোনো সংসার থাকে না। তারা শুধু নিঃস্বার্থভাবে মাতৃভূমি এবং সমাজের সেবা করতে প্রস্তুত থাকে। কয়েকটি কঠিন ধাপ অতিক্রম করে নাগা সন্ন্যাসীদের মূল প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অনেকের বিশ্বাস, তাদের আধ্যাত্মিক জগতের ধারে কাছে অন্য কেউ পৌঁছতে পারে না।
চারটি কুম্ভের পর ব্রম্ভচারি বালকদের নাগা সন্ন্যাসের মূল দীক্ষা দেয়া হয়। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে শুধু কি পুরুষই নাগা সন্ন্যাসী হতে পারে? নাকি নারীরাও নাগা সাধু হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে নারীরাও নাগা সন্ন্যাসী হতে পারে। কোনো নারী নাগা সাধু হতে চাইলে, আগে তাকে ৬ থেকে ১২ বছর ধরে কঠিন ব্রহ্মচার্য অনুসরণ করতে হয়। এসময় তাকে ব্রাহ্মচর্যের যাবতীয় নিয়ম মেনে চলতে হয়।
নাগা হতে নারীরা যা করে
নারী নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য তার গুরুকে আশ্বস্ত করতে হয়। সে চাইলে নারী ব্রাহ্মচার্য অনুসরণ করতে পারেন। এরপর সেই নারী তার গুরু নাগার কাছ থেকে দীক্ষা নিতে পারে। গুরু একজন নারীকে নাগা সন্ন্যাসে দীক্ষা দেয়ার পূর্বে তার অতীত জীবন এবং পরিবার সম্পর্কে যাবতীয় খোঁজ খবর নিয়ে থাকেন।
নারী সাধু হিসেবে দীক্ষা নেয়ার পর তার মাথা ন্যাড়া করা হয় এবং নদীতে গোসল করানো হয়। নারী নাগা সাধুর পরিবারের মায়া ত্যাগ করার দীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের মায়া ত্যাগ করে সে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করে। সাধু হিসেবে দীক্ষা নেয়ার পর সবাই তাকে মা বলে ডাকে।
পুরুষ নাগা সাধু বস্ত্রহীন থাকলেও নারী নাগা সাধু এক টুকরো সেলাইহীন গেরুয়া-হলুদ রঙের কাপড় পরে থাকেন। এই একই পোষাক পরে তারা সমস্ত কাজ কর্ম করেন। পুরুষ এবং নারী নাগা সন্ন্যাসীদের মর্যাদা সমান। নারী নাগা সন্ন্যাসী কপালে টিকা লাগান।
শরীরে ছাই মাখার কারণ
তাদের শরীরে মাখা ছাইও একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি বলে জানা যায়। যজ্ঞের ভস্মের সঙ্গে গোবর, কলাপাতা, বেলপাতা, কাঁচা দুধ, কলা এবং ঘি দিয়ে এই মিশ্রেণ তৈরি করা হয়। এই ভস্ম গায়ে মাখলে বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, মশা কিছু কাছে আসে না বলে জানা যায়। পাহাড় কিংবা আশেপাশের অঞ্চলেই থাকে এরা সব সময়।
লোকালয়ে খুবই কম বের হয়। কুম্ভ মেলার সময়ই বেশি বের হয়। জীবন ধারণের মত সামান্য খাদ্য গ্রহণ করে বেঁচে থাকে তারা। প্রকৃতিতে অনেক খাদ্য আছে যা শরীর উত্তেজিত করে তোলে। নাগারা এই সব খাদ্য এড়িয়ে চলে। তারা সিদ্ধি লাভ করে কাম, ক্রোধ, লোভের উর্ধ্বে অবস্থান করে। একজন নাগা সাধু হয়ে ওঠেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃত সত্য সন্ধানী।
নগ্ন থাকার কারণ
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে নাগারা নগ্ন থাকেন, তাদের কি কামবাসনা নেই? নাগা সাধুদের প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্রহ্মমুহূর্তে তাদের মন্ত্রদান করা হয়। যে মন্ত্র এক কঠিন সাধনা লব্ধ। তারা কাম বাসনার উর্ধ্বে থাকার জন্য যৌন আকাঙ্ক্ষা মুক্ত হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাদের যৌনাঙ্গ নষ্ট করে দেয়া হয়।
যৌন কামনার প্রবল বেগকে সামলে একজন প্রকৃত নাগা হয়ে ওঠে। তাদের শরীর এবং মনে কোনো কাম বাসনা এবং জাগতিক চিন্তা ভাবনা থাকেনা। নাগা সাধুদের সাধনায় যাতে পার্থিব কোনো কিছু স্পর্শ না করে সেজন্য তারা বস্ত্রও পরিত্যাগ করে।