ভোরের আলো ডেষ্ক: বাংলাদেশের কালো টাকার পরিমাণ ঠিক কতো তার কোনো আনুষ্ঠানিক হিসেব নেই বা সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় না।
তবে রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ বিভাগের নানা সূত্র থেকে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য এসেছে তাতে দেখা যায় এ পর্যন্ত দেশে ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে।
ওই দুই অর্থ বছরে প্রায় ৩২ হাজার ব্যক্তি ওই সুযোগ নিয়ে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা বৈধ করেছিলো।
আর এ যাবতকাল মোট সাদা হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং তার বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।
বর্তমান সরকারের আমলেই ২০১২-১৩ সালে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটা স্থায়ী নিয়ম তেরি করা হয়েছে।
পাশাপাশি আয়কর আইনে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা ও কর দিয়ে পুঁজি বাজার ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ আছে।
এমনকী পুরনো একাধিক বছরের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আছে।
প্রতি বছরেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া নিয়ে বিতর্ক হয় বাংলাদেশে
কী কী উপায়ে কালো টাকা তৈরি হয়
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি এই কালো টাকা নিয়ে আনুষ্ঠানিক গবেষণা করেছিলো ২০১১ সালে এবং এরপর থেকে প্রতিবছরই কালো টাকা সাদা করার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার বক্তব্য দিচ্ছে।
সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন প্রধানত কয়েকটি উপায়ে বাংলাদেশে কালো টাকা তৈরি হয়।
১. পেশাজীবীদের অপ্রদর্শিত আয়- চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, এনজিও খাত কিংবা এমন অনেক পেশায় চাকুরির বাইরেও পেশাগত চর্চার মাধ্যমে অর্থ আয়ের সুযোগ আছে। যেমন চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্রাকটিস করেন। এখন কোনো চিকিৎসক যদি এ থেকে পাওয়া অর্থ আয়কর রিটার্নে না দেখান তা হলে সেটি কালো টাকায় পরিণত হয় বলে বলছেন মিস্টার ইফতেখারুজ্জামান।
২. ঘুষ দুর্নীতি- সেবা খাত, ক্রয় খাতে কেউ যদি ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন তাহলে সেটি তার বৈধ আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এভাবে অনেকে নগদ অর্থ উপার্জন করেন যেগুলো বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে বা অর্থনীতিতে আসে না। এ অর্থই কালো টাকা, যদিও বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে এ ধরণের অর্থ সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন অনেকে।
৩. অর্থ পাচার – পাচার করা অর্থই বাংলাদেশের কালো টাকার একটি বড় অংশ বলে মনে করা হয়। দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে আবার সেই অর্থ দেশে আনার খবরও শোনা যায়। বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের মতো পাচার হয় বলে ধারণা করেন গবেষকরা।
৪. নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা- কালোবাজারি, চোরাকারবারি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার বাজার বেশ বড় বাংলাদেশে। এসব কাজে জড়িত অর্থের পুরোটাই কালো টাকা মনে করা হয়। কারণ এগুলো বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কেউ যদি মাদক বিক্রি করে অর্থ আয় করেন তবে সেটি কালো টাকা, কারণ এগুলো আয়কর বিবরণীতে উল্লেখের সুযোগই নেই।
৫. আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং – ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা তৈরি হয় এই প্রক্রিয়ায়। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে কাগজপত্রে অনিয়ম করে দাম বেশি বা কম দেখিয়ে করের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। এর মাধ্যমে যে অর্থ সরানো হয় সেটিই কালো টাকা। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলেছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
৬. জমি ক্রয় বিক্রয় – বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে জমির মূল্য সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে এসব জমি ক্রয় বা বিক্রয়ের সময় সরকার বাজার মূল্য অনুযায়ী বা সত্যিকার অর্থে যে দামে ক্রয় বিক্রয় হয় সে দাম অনুযায়ী রাজস্ব পায় না। এভাবেই এ প্রক্রিয়াটি প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকাকে কালো তালিকায় নিয়ে যায়।
৭. বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী পেশাজীবীরা – টিআইবিরই এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের ত্রিশভাগও এখানে যা আয় করে কাগজপত্রে তা দেখায়না। ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন তারা যে ঘোষণা দেয় সেটি তাদের আয়ের চেয়ে অনেক কম। ফলে এখানেও কালো টাকা তৈরি হচ্ছে।
কালো টাকার ব্যপ্তি কত বড়?
বিশ্বব্যাংকের ২০০৫ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩৭.৭ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করার মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা।
আর দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির করা অদৃশ্য অর্থনীতি শীর্ষক এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছিলো যে জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে এটি ওঠানামা করে।
সংস্থাটি তখন গবেষণার সময় যে তথ্য সংগ্রহ করেছিলো তাতে দেখা যাচ্ছিলো যে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা হয়েছে। তখন ১ হাজার ৯২৩ জন ব্যক্তি প্রায় এক হাজার ২১৩ কোটি টাকা সেবার সাদা করেছিলো।
গবেষণা রিপোর্টটি প্রকাশ করে তখন সংস্থাটি সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর থেকে অদৃশ্য অর্থনীতির ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে এগার দফা সুপারিশ করেছিলো।
এর মধ্যে প্রধান সুপারিশ ছিলো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করা।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মদ্যে কার্যকর অটোমেশন চালু করে কালো টাকা সাদা করার সব উৎস চিরতরে বন্ধ করে দেয়া।
কিন্তু বাস্তবতা হলো অটোমেশন অনেক জায়গায় চালু হলেও বন্ধ হয়নি কালো টাকা তৈরির প্রক্রিয়া আর এ টাকাকে সাদা করার জন্য প্রতি বছরই দেয়া হয় নানা সুযোগ।