লিখেছেন ড: মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী, মন্ট্রিয়ল থেকে
কোভিড-১৯ মহামারিতে গোটা বিশ্ব এখন চরম আতংকগ্রস্ত কারন এ প্রানঘাতি রোগটির প্রতিরোধি কোন কার্যকর ভ্যাক্সিন নেই বা রোগ হলে মোকাবেলা করার মত কোন কার্যকরি ড্রাগ নেই। আজ পর্যন্ত গোটা বিশ্বের ৬,৪৪০,০৫০ লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুবরন করেছে ৩৮০,২২৮ জন। আরো ভয়ংকর হল রোগটির ছোঁয়াচে প্রকৃতি ও রোগ সংক্রমনের হার। আশার কথা হল বিশ্বের মোটামুটি বেশীরভাগ দেশই বর্তমান জরুরী পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটি কার্যকর ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের জন্য একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও একটি কার্যকরি ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করে নানা ধাপে এর কার্যকারিতা ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করে বানিজ্যিক উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্ধারন ও রেগুলেটরি বডি কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যাপকভাবে জনগোষ্ঠির কাছে পৌছাতে গড়ে ১০ বছরের বেশী পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতায় বিশ্বের দেশগুলো এক অভুতপূর্ন সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রবলভাবে চেষ্টা করছে একটি নিরাপদ ও কার্যকরি ভ্যাক্সিন আবিষ্কার, ট্রায়াল, উৎপাদন ও অনুমোদনের পুরো প্রক্রিয়াটিকে কোনভাবে ত্বরান্বিত করা যায় কিনা, যাতে ১২-১৮ মাস বা তারো কম সময়ে বিশ্বের ব্যাপক জনগোষ্ঠিতে ভ্যাক্সিনটি প্রয়োগ করা যায়। বর্তমানে বিশ্বের ৮০ টি কোম্পানি/শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯ এর মোট ১১৯ টি সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ চলছে- এর মধ্যে ১ টি ভ্যাক্সিন ক্লিনিকাল ট্রায়াল এর Phase-2, ৭ টি ভ্যাক্সিন Phase-1 এবং ১১১ টি ভ্যাক্সিন প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ প্রবেশ করেছে।
কোভিড–১৯ করোনা ভাইরাস:
কোভিড-১৯ এর সংক্রমনকারি ভাইরাসটি এবং নিকট অতীতের দুটো মহামারী -সার্স ও মার্স এর সংক্রমনকারী ভাইরাসগুলো একই করোনা ভাইরাস পরিবারের সদস্য, যদিও সামান্য জিনগত ভিন্নতা আছে তাদের। কোভিড-১৯ সংক্রমনকারি ভাইরাস এর সাথে সার্স করোনা ভাইরাসের জিনগত মিল ৮০-৯০% বলে একে SARS-CoV-2 নামে অবহিত করা হয়।
করোনা ভাইরাস একটি RNA ভাইরাস যা মানুষের রেসপিটরি সিষ্টেম কে আক্রান্ত করে। ভাইরাসটিতে এক টুকরা RNA ফিতা কুন্ডলিকৃত আকারে একটি গোলাকার চর্বি শেল এর ভেতরে থাকে এবং এই গোলাকার চর্বিশেল ভেদ করে মুকুটের মত অসংখ্য স্পাইক প্রোটিন বাইরের দিকে বের হয়ে থাকে। তাই এই ভাইরাসের নাম করোনা ভাইরাস( Corona = Crown) ।এই স্পাইক প্রোটিন এর মাধ্যমেই ভাইরাস ফুসফুসের কোষগুলোর পর্দায় অবস্থিত রিসেপ্টরে আটকায় এবং পরে কোষের পর্দা ভেদ করে কোষের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ফুসফুসের বা কোষের ভিতরে ঢুকে ভাইরাসটির RNA তন্তুটি তখন কোষের নিজস্ব প্রোটিন তৈরীর মেশিনারি ব্যবহার করে ভাইরাল প্রোটিন ও অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরীর মাধ্যমে ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।এই নতুন ভাইরাসগুলো আবার কোষ হতে বের হয়ে এসে এই প্রক্রিয়ায় ঐ কোষকে এবং নতুন করে অন্যান্য কোষকে আক্রান্ত করে বা ইনফেকশন সৃষ্টি করে। শরীরের ইমিউন সিষ্টেম দুর্বল থাকলে এই ভাইরাস ফুসফুস ও গলার কোষকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে ( Infection), প্রচন্ড শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করে, রোগীর নিউমোনিয়া হয় এবং চরম ইনফেকশন হলে রোগী প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে মারা যায়।
কোভিড–১৯ ভ্যাক্সিন গবেষনা ও টেকনোলজি:
করোনা ভাইরাসজনিত কোষের ইনফেকশনকে প্রতিহত করতে হলে যা প্রয়োজন তা হল কোনভাবেই ঐ ভাইরাসকে ফুসফুসের কোষের রিসেপ্টরে সংযুক্ত হতে না দেয়া, যাতে কোষের পর্দা ভেদ করে সে ভিতরে ঢুকতে না পারে এবং বংশবৃদ্ধি করতে না পারে। আমাদের দেহে সাধারনত যখন কোন ভাইরাস প্রবেশ করে তখন আমাদের শরীরের নিজস্ব ইমিউন সিষ্টেম সজাগ হয়ে উঠে অসংখ্য প্রতিরোধি এ্ন্টিবডি তৈরী করে। এই এন্টিবডিগুলো Y আকৃতির প্রোটিন অনু-যা কোন ভাইরাস বা তার কোন ক্ষতিকর অংশের (এন্টিজেন) সাথে যুক্ত হয়ে ঐ ভাইরাসটির কোষের রিসেপ্টরে সংযুক্ত হওয়া বা কোষে প্রবেশ করাকে প্রতিহত করতে পারে।
ভ্যাক্সিন এর মাধ্যমে মুলত শরীরে ওই ভাইরাসেরই কোন দুর্বল বা মৃত রূপ, বা ভাইরাসের কোন নির্দিষ্ট অংশকে মানব শরীরে অল্প ডোজে প্রবেশ করিয়ে ইমিউনসিষ্টেমকে সজাগ করে তোলা হয় যাতে সে নির্দিষ্ট এন্টিবডি তৈরী করতে পারে।এই এন্টিবডিগুলো ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রয়োগককৃত ভাইরাস বা তার ক্ষতিকর অংশের সাথে যুক্ত হয়ে এই দুর্বলভাইরাস এর আক্রমনকে প্রশমিত করে। এ ঘটনার স্মৃতি শরীরের ইমিউন সিষ্টেমে থেকে যায়- তাই ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরে ঢোকা কোন ভাইরাস এর উপস্থিতিতে সে আবার ঐ নির্দিষ্ট এন্টিবডি তৈরী করে। এন্টিবডিগুলোও তখন তার পূর্ব পরিচিত ভাইরাস বা তার ক্ষতিকর অংশের (এন্টিজেন-করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে তার স্পাইক-প্রোটিন) এর সাথে নিজেকে যুক্ত করে ভাইরাস এর আক্রমন হতে কোষকে রক্ষা করে।ভ্যাক্সিনগুলো এভাবেই কোন ভাইরাসজনিত রোগ হতে মানুষকে রক্ষা করে।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত চিন করোনা ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স এই বছরের জানুয়ারীতে পৃথিবীর সামনে প্রকাশ করে। সংগে সংগে এই জিন সিকোয়েন্স ব্যবহার করে সারা পৃথিবীর রিসার্চ গ্রুপগুলো সচেষ্ট হয় লাইভ ভাইরাস গ্রো করে তার উপর পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালাতে। এই প্রক্রিয়ায় আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, চিন, যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ বিশ্বের ৮০ টি কোম্পানি/শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোটামুটি ১১৯ টি সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন এর নাম উঠে এসেছে।
করোনা ভাইরাস এর ভ্যাক্সিন ডেভেলপের পথে অন্যতম চ্যালেন্জ হতে পারে এর মিউটেশন ক্ষমতা-যা স্থান, আবহাওয়া ও জনগোষ্ঠিভেদে বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে। চিনের উহানে প্রাপ্ত ভাইরাসের সাথে ইতালিতে আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রাপ্ত ভাইরাসের জিনগত পার্থক্য রয়েছে।যার ফলে একটি ভ্যাক্সিন কোন জনগোষ্ঠির জন্য কার্যকরি হলেও অন্য জনগোষ্ঠির জন্য সেরকম কার্যকরি নাও হতে পারে। তাই প্রত্যেক দেশেরই উচিত ভাইরাসটির জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষন করে কার্যকরি ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে মনোনিবেশ করা।এছাড়া আরেকটি চ্যালেন্জ হল এই অনন্য ভাইরাসটির জন্য একটি কার্যকরী ভ্যাক্সিন ব্যাংকের অভাব। এর আগের দুটি করোনা ভাইরাসের ( সার্স, মার্স) ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের জন্য কিছু গবেষনা শুরু হলেও পরবর্তিতে মহামারি দুটোর প্রকোপ প্রাকৃতিকভাবে কমে যাওয়ায় এই গবেষনা আর বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেনি।
যাই হোক এখন পর্যন্ত যে সম্ভাব্য ভ্যাক্সিনগুলো গড়ে উঠেছে বা উঠছে তাদেরকে মোটামুটি ৮ টি প্রধান টাইপ বা টেকনোলজিতে ভাগ করা করা যায়। প্রতিটা টেকনোলজির কিছু সুবিধা ও অসুবিধা আছে:
১) দুর্বল কিন্তু জীবন্ত ভাইরাস( Live Attenuated) ভিত্তিক ভ্যাক্সিন যা দেহের ইমিউন সিষ্টেমকে সজাগ করতে সক্ষম কিন্তু দেহে কোন ইনফেকশন বা রোগ সৃষ্টি করতে পারবেনা।
এধরনের ভ্যাক্সিন বহুল প্রচলিত এবং অন্যান্য কিছু ভাইরাসজনিত রোগের ক্ষেত্রে এদের উচ্চতর কার্যকারিতাও প্রমানিত। কিন্তু করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে তার ভয়ংকর ইনফেকশন সৃষ্টিকারি ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে সরাসরি দুর্বল কিন্তু জীবন্ত ভাইরাসকে ভ্যাক্সিন হিসেবে ব্যবহার করা কিছুটা বিপদজনক। তাই এইপদ্ধতিতে ভ্যাক্সিন ডেভেলপ করতে হলে ডোজ অ্যামাউন্ট কমানো বা ভাইরাসকে যথাযত দুর্বল করে ফেলাটা নিশ্চিত করতে হবে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর একটা গ্রুপ এইধরনের ভ্যাক্সিনের ডেভেলপ করছে। এখন পর্যন্ত এই টেকনোলজিতে ২টি ভ্যাক্সিন ডেভেলপ করা হয়েছে বা হচ্ছে।
২) অসক্রিয় বা মৃত ভাইরাস ( Inactivated) ভিত্তিক ভ্যাক্সিন-যাকে অসক্রিয় করা হয় কেমিকেল বা তাপ প্রয়োগে, যদিও অসক্রিয় ভাইরাসটি ইমিউন সিষ্টেমকে সজাগ করতে সক্ষম।
এধরনের ভ্যাক্সিনও বহুল ব্যবহৃত-বিশেষ করে রোগের ভাইরাসটি যদি অতি সক্রিয় হয় সেক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিবেচনায় এধরনের ভ্যাক্সিন ব্যবহার সুবিধাজনক। কিন্তু উচ্চতর বা পুন:পুন: ডোজ এর প্রয়োজন হয় যথাযথ প্রোটেকশনের পাবার জন্য। ৩টা কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন এই টেকনোলজি ব্যবহার করেছে।
৩) প্রোটিন সাব–ইউনিট ভ্যাক্সিনে ভাইরাসটির শুধুমাত্র সেই অংশবিশেষ ব্যবহৃত হয় যা ইমিউন সিষ্টেম কে তাড়িত করে- যেমন করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন।
‘রিকম্বিনেন্ট’ টেকনোলজিতে করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন-যা আমাদের ইমিউন রিয়েকশান কে তাড়িত করে বলে ধারনা করা হয়-তার জেনেটিক কোড এক্সট্রাক্ট (Extract) করে কোন ব্যাকটেরিয়া বা ঈষ্ট জিনম এ পেইস্ট করে ভাইরাল প্রোটিন এর প্রোডাকশন ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়। এই ধরনের ভাইরাল প্রোটিন ভিত্তিক ভ্যাক্সিন যদিও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, সবার ব্যবহারেপযোগী, উচ্চতর ইমিউনো সাড়া প্রদানে সক্ষম কিন্তু মেডিকেল গ্রেড সম্পন্ন বড় স্কেলে বিশুদ্ধ ভাইরাল প্রোটিন উৎপাদনে কখনো কয়েক বছর সময় লেগে যায়। বর্তমানে ৩৩ টি সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন এ টেকনলজিতে গড়ে উঠেছে বা উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের Novavax কোম্পানি তাদের উদ্ভাবিত সম্ভাব্য ভ্যাক্সিনে এ টেকনোলজি ব্যবহার করছে।
৪) RNA ভ্যাক্সিন-ভাইরাল প্রোটিন এর বদলে m-RNA এর নিয়ন্ত্রিত জেনেটিক কোড ব্যবহার করে মানব শরীরেই ভাইরাল প্রোটিন উৎপন্ন করে ইমিউন সিষ্টেমকে তাড়িত করা হয়। এই অধুনা টেকনোলজিও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, সহজ, সবার ব্যবহারোপযোগী ও ভ্যাক্সিনের ব্যবহারে উচ্চতর ইমিউনো রেসপন্স পাওয়া যেতে পারে। বাড়তি সুবিধা হল আলাদা করে বড় স্কেলে মেডিকেল-গ্রেড সম্পন্ন বিশুদ্ধ ভাইরাল প্রোটিন উৎপাদনের ঝামেলা নেই এবং রয়েছে দ্রুততম সময়ে বাজারজাত করার সম্ভাবনা। বর্তমানে সর্বমোট ১৪ টি RNA ভ্যাক্সিন এ টেকনোলজিতে গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের Moderna এবং জার্মানির CureVac কোম্পানি m-RNA ভিত্তিক ভ্যাক্সিন ডেভেলপ এর কাজে ভালোই অগ্রসর হয়েছে।
এছাড়া ১০টি DNA ভিত্তিক ভ্যাক্সিন এর কাজ চলছে যার সুবিধা RNA ভিত্তিক ভ্যাক্সিনের মতই।
১২টি নন-রেপ্লিকেটিং ভাইরাল ভেক্টর, ৯টি রেপ্লিকেটিং ভাইরাল ভেক্টর ভিত্তিক ভ্যাক্সিনগুলোও যথেষ্ট সম্ভাবনাময় এদের দীর্ঘস্থায়িত্ব, শক্তিশালি ইমিউন রেসপন্স এবং ইতিমধ্যেই লাইসেন্সকৃত বলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত উৎপাদনে নামার সুবিধায়।
এছাড়া আরো ৩৩টি অন্যান্য টাইপের বিশেষ ভ্যাক্সিনও পাইপলাইনে আছে এমুহুর্তে যাদের কার্যকারিতাও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
কোভিড–১৯ ভ্যাক্সিন ট্রায়াল ও চ্যালেন্জ:
একটা সম্ভাব্য ভ্যাক্সিনকে সাধারনত ল্যাবরেটরিতে তৈরী করে ব্যাপক জনগোষ্ঠিতে ব্যবহার করার জন্য অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রথম ধাপে ঐ ভ্যাক্সিনকে মানুষব্যতিত কোন প্রানীদেহে প্রয়োগ করে দেখা হয় ভ্যাক্সিনটি নিরাপদ কিনা এবং তা প্রানীদেহে কোন প্রতিরোধি সাড়া (Immuno Response) দেয় কিনা। এ প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়ালে সফল হলে সম্ভাব্য ভ্যাক্সিনটিকে আবার কয়েকটি ধাপে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে দেখা হয় তা কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া মুক্ত কিনা এবং রোগের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধে সক্ষম কিনা-এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্লিনিকাল ট্রায়াল। এই ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপে (Phase-1) কয়েক ডজন সুস্থ মানুষের ছোট গ্রুপে ভ্যাক্সিনটি প্রয়োগ করে দেখা হয় এটি মানব শরীরে কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে কিনা। এ ধাপে সফল হলে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের দ্বিতীয় ধাপে (Phase-2) ভ্যাক্সিনটিকে পরীক্ষা করা হয় কোন সংক্রমিত এলাকার কয়েকশ বা হাজার খানেক মানুষের উপর-দেখা হয় ভ্যাক্সিনটি কার্যকরী কিনা অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধে সক্ষম কিনা। দ্বিতীয়ধাপে সফল হলে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে (Phase-3) ভ্যাক্সিনটিকে মহামারী আক্রান্ত এলাকার কয়েক হাজার মানুষের উপর প্রয়োগ করে দেখা হয় এর কার্যকারিতা। এ দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চালানোর পাশাপাশি বানিজ্যিকভাবে উৎপাদনের সক্ষমতাও পরীক্ষা করতে হয়।এধাপগুলোর কোনটিতে কাংখিত ফলাফল না পেলে আবার নতুন করে ভ্যাক্সিনটিকে নিয়ে গবেষনা করার প্রয়োজন হয়। যাই হোক এভাবে সমস্ত প্রি-ক্লিনিকাল এবং ক্লিনিকাল ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন করার পর প্রয়োজন হয় ব্যাপক জনগোষ্ঠিতে ব্যবহার করার জন্য রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক রেগুলেটরি সংস্থার অনুমোদন-যা অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি নানা বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়।এভাবে প্রি-ক্লিনিকাল ও ক্লিনিকাল ট্রায়ালের নানা ধাপের সফলতা, রেগুলেটরি বডির অনুমোদন, লাইসেন্স, ও বানিজ্যিকভাবে বড় স্কেল এ উৎপাদন ব্যবস্থা বা ফ্যাসিলিটি নির্ধারন করে ব্যাপক জনগোষ্ঠির ব্যবহারোপযোগী একটি কার্যকর ভ্যাক্সিন বাজারে আসতে প্রায় অনেক সময় ১০-২০ বছর সময় পর্যন্ত লেগে যায়। কিন্তু বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতায় অনেক দেশই চাইছে এই ধাপগুলোকে কোনভাবে ত্বরান্বিত করা যায় কিনা, কোন কোন ধাপকে পাশাপাশি সম্পন্ন করা যায় কিনা, কোন ধাপকে বাদ দিয়ে অন্যকোন ধাপকে প্রায়োরিটি দেয়া যায় কিনা, অথবা ব্যাপক জনগোষ্ঠির পরিবর্তে কোন নির্দিষ্ট বয়স গ্রুপ বা পেশাজীবি গ্রুপকে টার্গেট করে স্বল্পসময়ে পরীক্ষামুলক কোন ভ্যাক্সিন বাজারজাত করা যায় কিনা।
এখন এক নজরে দেখি সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্ট এর প্রধান হালচিত্র:
- কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন ডেভেলপার: ৩৬-নর্থ আমেরিকা (৪৬%), ১৪- চিন (১৮%), ১৪- এশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়া (চিন বাদে-১৮%), ১৪-ইউরোপ (১৮%). লিড ডেভেলপারগুলো সারা বিশ্বের মোট ১৯টি দেশে বিস্তৃত।
- বিশ্বের ৮০ টি কোম্পানী/শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯ এর মোট ১১৯ টি সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ চলছে- এর মধ্যে ১ টি ভ্যাক্সিন Phase-2 ক্লিনিকাল ট্রায়াল, ৭ টি ভ্যাক্সিন Phase-1 ক্লিনিকাল ট্রায়াল, এবং ১১১ টি ভ্যাক্সিন প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ প্রবেশ করেছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের ২টি, চিন এর ৪ টি, যুক্তরাজ্যের ১টি ভ্যাক্সিন এই মুহুর্তে ভ্যাক্সিন রেইসে অগ্রগামী: Phase-1 ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ ছোট ও মাঝারি গ্রুপে মানুষের উপর ভ্যাক্সিনগুলোর কার্যকারিতা ও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা হচ্ছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনস্থ বায়োটেক কোম্পানি ‘Moderna’ এবং NIAID এর যৌথ উদ্যেগে তৈরী RNA ভিত্তিক ভ্যাক্সিন (m-RNA 1273) টি এখন Phase-1 ক্লিনিকাল ট্রায়ালে রয়েছে। এ ভ্যাক্সিনটি মুলত পুর্ববর্তী MERS ভ্যাক্সিন এর উপর ভিত্তি করে ডেভেলপ করা হয় এবং সিয়াটলের কয়েকজন ভলান্টিয়ার এর উপর সর্বপ্রথম প্রয়োগ করা হয় ১৬ মার্চ, ২০২০ এ। NIAID প্রধান ড. ফাউচি বলেছেন এখন পর্যন্ত সবকিছুই প্লানমত আগাচ্ছে এবং বড় আকারের টেষ্টিং এই জুনেই করা সম্ভব হবে।সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২১ এর জানুয়ারী-এপ্রিলের মধ্যে ভ্যাক্সিনটি হাতে আসতে পারে।
- যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভিনিয়াস্থ Inovio Pharmaceuticals এর DNA ভিত্তিক ভ্যাক্সিন (INO-4800) টির Phase-1 ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে।
- চিনের SinoVac Biotech Ltd. এর উদ্ভাবিত Inactivated Vaccine টিও এখন Phase-1 ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ রয়েছে।
- চিনের Shenzhen Geno-Immuno Madical Institute আরো দুটি ভ্যাক্সিন (aAPC vaccine, LV-SMENP-DC vaccine) ডেভেলপ করেছে যা এখন Phase-1 ক্লিনিকাল ট্রায়ালে রয়েছে।
- চীনের CanSino Biologics তাদের Non-replicative Viral Vector ভিত্তিক ভ্যাক্সিন (Ad5-nCoV) ডেভেলপ করেছে Ebola ভ্যাকসিনের এর আলোকে। বর্তমানে ভ্যাক্সিনটির Phase-1 এবং Phase-2 ক্লিনিকাল ট্রায়াল একই সময়ে চলছে।
- যুক্তরাজ্যের University of Oxford একটি রিসার্চ গ্রুপ Non-replicative Viral Vector ভিত্তিক একটি ভ্যাক্সিন (ChAdOx1) ডেভেলপ করেছে যা এখন Phase-1 ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ রয়েছে। তারা বলছে সেপ্টেম্বর এর মধ্যেই ১ মিলিয়ন ডোজ প্রস্তুত হচ্ছে তবে বড় আকারের প্রস্তুতির জন্য এবছরের শেষ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
- অসলোভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন CEPI ঘোষনা দিয়েছে যে তাদের হাতে প্রায় ৮ টি সম্ভাবনাময় ভ্যাক্সিন রয়েছে যার মধ্যে হতে ১টি ভ্যাক্সিনকে আগামি মে মাসের মধ্যেই ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত করা হবে।
- WHO এর তথ্যানুযায়ী ১১১টি ভ্যাক্সিন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে বা প্রি-ক্লিনিকাল স্টেইজ এ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি অচিরেই ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ প্রবেশ করবে।
- কানাডার University of Western Ontario এর MERS এর ভ্যাকসিন এর উপর গবেষনার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটি রিসার্চগ্রুপ এমুহুর্তে ৬ টি সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করছে এবং আশা করছে আগামী জুলাই- অগাষ্ট এর মধ্যেই মানুষের উপর ট্রায়াল করতে পারবে।
- কানাডার কুইবেকস্থ কোম্পানি Medicavo উদ্ভিজ্জাত একটি সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন এর Phase-1 এবং Phase-2 ক্লিনিকাল ট্রায়াল সম্পন্ন করে ২০২১ এর জুনের মধ্যেই ভ্যাক্সিনটিকে বাজারজাত করতে সক্ষম হবে বলে আশা ব্যক্ত করছে।
- ফার্মাসিউটিকাল জায়েন্ট Sanofi (ফ্রান্স) এবং GSK(যুক্তরাজ্য) সম্প্রতি ঘোষনা করেছে তারা যৌথভাবে ‘রিকম্বিনেন্ট’ টেকনোলজি ব্যবহার করে একটি ভ্যাকসিন ডেভেলপ করবে যা ক্লিনিকাল ট্রায়াল এর জন্য প্রস্তুত হবে এই জুনে, এবং এতে সফল হলে আশা করছে আগামী ২০২১ এর জুনের মধ্যে ভ্যাক্সিনটি হাতে আসবে।
- অষ্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা দুটি সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন কে পশুদেহে প্রয়োগ করে একটি বিশাল প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করেছে সম্প্রতি এবং আশা করছে এই এপ্রিল মাসের শেষে Phase-1 ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করবে।
- যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড এ অবস্থিত Novavax কোম্পানিও তাদের ভ্যাক্সিন কে ডেভেলপ করছে পূর্বতন SERS ভাইরাস নিয়ে গবেষনা কাজের উপর ভিত্তি করে। তারা বলছে একাধিক ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট নিয়ে এই এপ্রিলের মধ্যেই মানুষের উপর ট্রায়াল করতে পারবে।
আশার কথা হল বিশ্বের বড় বড়দেশগুলোসহ অনেকদেশই করোনা ভাইরাস এর কারনে বড় রকমের প্রানহানিসহ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় একযোগে কাজ করে যাচ্ছে-দ্রুত একটি নিরাপদ ও কার্যকরি ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের প্রত্যাশায়-হয়তো সম্ভব। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করছেন যে সবধরনের প্রি-ক্লিনিকাল এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালকে ত্বরান্বিত করেও একটি নিরাপদ ও কার্যকরি ভ্যাকসিন ২০২১ সালের জুনের আগে হাতে আসা সম্ভব হবেনা।এবং ওটাও বিলম্বিত হতে পারে যদি ট্রায়ালের কোন পর্যায়ে কাংক্ষিত ফলাফল না আসে।তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর একটি বড় চিন্তার কারন হতে পারে যে ১২-১৮ মাস পরে ভ্যাক্সিনটি হাতে আসলেও উন্নত দেশগুলো হয়তো চাইবে উৎপাদিত ভ্যাক্সিন দিয়ে আগে নিজের জনগোষ্ঠির চাহিদা পুরন করতে- তারপর আসবে অন্য কোথাও সরবরাহ! মোটামুটি বিশ্বের বেশীর ভাগ দেশই আক্রান্ত হওয়ায় বন্ধুদেশগুলোর পক্ষেও সহসা এগিয়ে আসার সম্ভাবনা কম।ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ভ্যাকসিন আসার আগেই বড়সময় জুড়ে ব্যাপক প্রানহানির একটা বড় সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর আমাদের মত বিশাল জনগোষ্ঠি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার একটি দেশে এই সম্ভাবনা তো আরো প্রবল! আমাদের নীতিনির্ধারকরা এ নিয়ে কিছু ভাবছেন? বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো দরকার করোনা ভাইরাসটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষন-জানা দরকার আমাদের স্পেসিফিক জলবায়ু ও জনগোষ্ঠিতে ভাইরাসটির মিউটেশন ট্রেন্ড, জনস্বাস্থ্যে তার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদিলপ্রভাব। আমরা কি তা করছি? এছাড়া অতি শীঘ্রই ভ্যাক্সিনটি হাতে আসার সম্ভাবনা না থাকায় বিশ্ব মোটামুটি প্রস্তুতি নিচ্ছে একটা লম্বা সময় জুড়ে নিরাপদ শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থবিধি কঠোর ভাবে মেনে চলার-যাতে একটি কার্যকর ভ্যাক্সিন হাতে আসার আগে ভাইরাসটির কারনে কোন ব্যাপক প্রানহানি না ঘটে! আমাদেরও যথাসম্ভব তা মানতে হবে-অন্তত একটি কার্যকরি ভ্যাক্সিন না আসা পর্যন্ত! আশাবাদি।
লেখক : ডঃ মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে রসায়নে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী-NXP Semiconductor Inc. এ External Quality Engineer হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রসায়ন বিভাগ হতে বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি সম্পন্ন করে প্রায় তিন বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা করেন।