লিখেছেন জান্নাতুল নাইম পিয়াল
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বর্তমান বিশ্ব যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবজীবনে সেটিকে অদৃষ্টপূর্বই বলা চলে। কিন্তু তাই বলে কি এমন পরিস্থিতির ব্যাপারে মানুষের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না? অবশ্যই ছিল। অনেক সৃজনশীল নির্মাতা তো এ ধরনের পরিস্থিতির ব্যাপারে তাদের আগাম চিন্তাভাবনার দৌড় এতটাই এগিয়ে রেখেছিলেন এবং সেগুলোকে উপস্থাপন করেছিলেন যে, তাদের কল্পনাই আজ অনেকাংশে বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে আমাদের চোখের সামনে।
বিভিন্ন মাধ্যমে বারবারই উঠে এসেছে এ ধরনের মহামারীর উল্লেখ কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী। সেসব মাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভবত হলিউডের চলচ্চিত্র। সেখানে তৈরি হয়েছে মহামারীকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ছবি। তার মধ্যে কয়েকটিতে দেখা গিয়েছে বিদ্যমান পরিস্থিতি জন্ম দিচ্ছে জোম্বি দলের। এ জাতীয় ছবি হিসেবে উল্লেখ করা যায় ‘দ্য ওমেগা ম্যান’, ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড’ এবং ‘প্যানডেমিক’-এর নাম।
আবার সামনে এসেছে অপেক্ষাকৃত সংযত ও বাস্তবসম্মত অনেক ছবিও, যেখানে দেখা গেছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নয়, বরং ক্ষুদ্র জীবাণুর কারণে ছড়িয়ে পড়ছে মহামারী। এ জাতীয় ছবির দৃষ্টান্ত হিসেবে শুরুতেই আসতে পারে ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত থ্রিলার ‘দ্য অ্যান্ড্রোমেডা স্ট্রেইন’-এর নাম।
এছাড়া ১৯৯৫ সালে, একই বছর মুক্তি পেয়েছিল দুইটি ছবি। ‘১২ মাংকিস’-এ দেখা গিয়েছিল টাইম-ট্র্যাভেল ব্যবহার করে মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলা ক্রমবর্ধনশীল প্লেগকে নির্মূল করা হচ্ছে। আর ‘আউটব্রেক’-এ দেখা গিয়েছিল আফ্রিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা হয়েছে একটি বায়ুবাহিত ভাইরাস, যার ফলে ডুবতে বসেছিল একটি গোটা শহরের ভবিষ্যৎ।
এ ধরনের কাহিনী কেবল কল্পনার জগতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এই তো গতবছরই, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক প্রচার করেছিল ‘দ্য হট জোন’ নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র, যেখানে দেখানো হয়েছিল ১৯৮৯ সালে কীভাবে উদ্ভব ঘটেছিল ইবোলা ভাইরাসের, এবং সেনাবাহিনীর বিজ্ঞানীরা ওয়াশিংটন ডিসির শহরতলীতে বসে আমদানি করা বানরের সাহায্যে প্রতিহত করতে চাইছিল ভাইরাসটিকে।
তবে হলিউড থেকে বেরোনো উপর্যুক্ত সকল কাল্পনিক চলচ্চিত্র কিংবা তথ্যচিত্রকে ছাপিয়ে বর্তমান সময়ের সাথে সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে বলে মনে হচ্ছে যে ছবিটিকে, সেটি হলো ‘কনটেজিয়ন’।
২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, স্কট জেড বার্নস রচিত ও স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত এ ছবিটি শুরু হয়েছিল এমন পটভূমিতে যে, এক নারী হংকং থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় ফিরেছে এক অদ্ভূত রোগ সাথে করে। এর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই নারীটি মারা যায়। মারা যায় তার ছোট ছেলেও।
কিন্তু এই দুই মৃত্যু কেবলই শুরু। পুরো ছবিজুড়ে দেখা যায়, কীভাবে ক্রমশ রোগটি সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, মহামারীতে রূপ নিচ্ছে, আর সেটি মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের ভূমিকাই বা কী হচ্ছে।
এছাড়া ছবিটিতে আরো দেখা যায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভাইরাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে কীভাবে গুজব ও ভীতি সংক্রমিত হয়, আর ঝড় তুলে তছনছ করে দেয় মানবজাতির নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলিত জীবনধারাকে।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ‘কনটেজিয়ন’ ছবিটির সাথে বর্তমান করোনা-কবলিত বিশ্বের বিস্ময়কর মিল রয়েছে। কিন্তু সেই মিল ঠিক কতটা? আর অমিলও কি কিছু নেই? এসব প্রশ্নেরই জবাব মিলবে এই বিশ্লেষণ থেকে।
স্বাভাবিকভাবেই এই লেখায় ছোট-বড় বেশ কিছু স্পয়লার থাকবে। তাই কেউ যদি এখনো ছবিটি না দেখে থাকেন, এবং স্পয়লার পেতে ইচ্ছুক না হন, তাহলে তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে তারা যেন আগে ছবিটি দেখে আসেন, তারপরই বাকি লেখাটুকু পড়েন।
ভাইরাসের উৎপত্তি
‘কনটেজিয়ন’ ছবির শেষ দৃশ্যে উন্মোচিত হয় যে, কাল্পনিক ‘এমইভি-১’ ভাইরাসটির উৎপত্তি ঘটেছিল একটি শূকর থেকে, যেটি একটি বাদুরের ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট কলার টুকরো খেয়েছিল। ওই বাদুরটি আবার এর আগে চীনের একটি জঙ্গলে বৃক্ষনিধন শুরু হলে, নিজের বাসস্থান তথা একটি পাম গাছ থেকে পালিয়ে এসেছিল।
দেখা যায়, শূকরটিকে জবাই করা হয় এবং একজন রাঁধুনি সেটিকে রান্নার জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। কিন্তু মাঝপথেই তার ডাক পড়ে। সে শূকরটির মুখের ভেতর থেকে হাত বের করে, সেই হাত না ধুয়েই হ্যান্ডশেক করে বেথ এমহফ নামের সেই নারীর সাথে, যে পরবর্তীতে ভাইরাসটিকে প্লেনে করে বয়ে নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত। এভাবে বেথই পরিণত হয় ‘ইনডেক্স কেস’, অর্থাৎ চিহ্নিত প্রথম মানুষ, যে ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
বর্তমান পৃথিবীর নভেল করোনাভাইরাসের উৎপত্তি আসলে কী- তা এখনো বিজ্ঞানীদের জন্য একটি রহস্য। তারপরও ‘কনটেজিয়ন’ ছবির মতোই, বাদুরকেই করোনাভাইরাসের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিবেচনা করছেন কিছু এপিডেমিওলজিস্ট।
মানুষের দায়
যদি বাদুরই হয়ে থাকে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক উৎস, তারপরও কি এর পেছনে মানুষের কোনো দায় নেই? শতভাগ নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, অনেক প্রাণী ও বাস্তু বিশেষজ্ঞই মনে করেন, এ ধরনের রোগ সংক্রমণের পেছনে মানুষের কিছু আচরণের দায় থাকতে পারে, যেমন ধরুন পশু-পাখির প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস করা, কিংবা তাদেরকে প্রতিকূল পরিবেশে নিয়ে আসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাদুর যখন স্ট্রেসড বা মানসিকভাবে পীড়িত থাকে, তখন তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাদের পক্ষে এমন অনেক রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, যেসব রোগ-জীবাণুকে হয়তো সাধারণ অবস্থায় তারা অনায়াসে প্রতিহত করতে পারত। যেহেতু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, দুর্বলতর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দরুণ তারা আর তা পারে না, ফলে ওইসব রোগ-জীবাণু একটি ‘হোস্ট’ পেয়ে বংশবিস্তার করতে শুরু করে দেয়।
‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে আমরা দেখেছি, বাদুরটি প্রথমে তার বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। বাস্তুহারা হওয়ার পর তার মানসিকভাবে ভেঙে পড়া বা অস্থিরচিত্ত হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক, এবং সম্ভবত সে কারণেই তার শরীরে কাল্পনিক ভাইরাসটি বাসা বেঁধে বংশবিস্তার করতে পেরেছিল।
এবার যদি আমরা নভেল করোনাভাইরাসের দিকে দৃষ্টি ফেরাই, এটির প্রাথমিক উৎপত্তিস্থল হিসেবে অনেকেই বলছেন চীনের উহান শহরের একটি ওয়েট মার্কেটের কথা। চীনের এসব ওয়েট মার্কেটে বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু গাদাগাদি করে, জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় রাখা হয় বিক্রির জন্য।
যেহেতু জীবজন্তুগুলোকে গাদাগাদি করে, একটির গায়ের সাথে আরেকটি স্তূপ করে রেখে দেয়া হয়, তাই তাদের মধ্যে কোনো এক বা একাধিক জন্তুর শরীরে করোনাভাইরাস বাসা বাঁধা, এবং পরবর্তীতে ‘জুনোটিক স্পিলওভার’-এর মাধ্যমে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
ওয়েট মার্কেটের জীবজন্তুগুলোর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকাও স্বাভাবিক, যেহেতু তারা বিরূপ পরিবেশে বন্দি থাকায় মানসিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে তো পড়েই, পাশাপাশি নোংরা-আবর্জনার মধ্যে দীর্ঘ সময় অবস্থানের ফলেও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হতে থাকে।
উপসর্গ
‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে দেখা যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের শুরুতে জ্বর আসে ও প্রচণ্ড ঘাম ঝরে, মাথা ব্যথা করে, গলা শুকিয়ে আসে, কাশি হতে থাকে। এছাড়াও তাদের খিঁচুনি ওঠে, মাথা ঘোরায়, এবং মৃত্যুর প্রাক্কালে মুখ থেকে ফেনা বের হয়।
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগ, অর্থাৎ কোভিড-১৯ এর কারণেও প্রায় একই ধরনের উপসর্গই দেখা যায়, যদিও খিঁচুনি কিংবা মুখ থেকে ফেনা বের হওয়াটা ব্যতিক্রম। কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্তত ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার জ্বর হওয়া, কাশি কিংবা শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া ইত্যাদি।
সংক্রমণ
কোভিড-১৯ এর মতোই, ‘কনটেজিয়ন’ ছবির এমইভি-১ একটি রেসপিরেটরি ডিজিজ বা শ্বাসযন্ত্রীয় রোগ, যেটি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি কিংবা অন্য কোনোভাবে নিঃসৃত লালার মাধ্যমে ছড়ায়।
এটি মূলত সরাসরি এক ব্যক্তির থেকে আরেক ব্যক্তিতে সংক্রমিত হয়, যখন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে লালা বা ছিটে অনাক্রান্ত ব্যক্তির চোখ, নাক বা মুখে পৌঁছায়।
তবে সরাসরি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত না হয়ে পরোক্ষভাবেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। বিভিন্ন বস্তুর পৃষ্ঠ বা উপরিভাগে ভাইরাসটি দীর্ঘক্ষণ জীবিত থাকতে পারে, এবং সেখান থেকে কোনোভাবে এটি অনাক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে অনাক্রান্ত ব্যক্তির হাত ও মুখ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ছবিটিতে বলা হয়, একজন গড়পড়তা মানুষ দৈনিক দুই থেকে তিন হাজার বার সচেতনভাবে কিংবা নিজের অজান্তেই মুখে হাত দেয়। আর সজাগ থাকাকালীন সে বিভিন্ন বস্তু যেমন দরজার হাতল, লিফটের বোতাম প্রভৃতিও স্পর্শ করে, যেগুলোতে ভাইরাসটির উপস্থিতি থাকতে পারে।
এ সকল কারণেই ‘কনটেজিয়ন’ ছবির কলাকুশলীরা ছবিটির সাথে বর্তমান পরিস্থিতির যোগসূত্র স্থাপন করে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন নিয়মিত হাত ধুতে, বারবার মুখ স্পর্শ না করতে, এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে।
ভাইরাস প্রতিরোধিতা
কোনো ব্যক্তির পক্ষে কি ভাইরাস প্রতিরোধী হওয়া সম্ভব? অর্থাৎ এমনটি কি সম্ভব যে আশেপাশের অধিকাংশ ব্যক্তি ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত হলেও, দুই-একজন ব্যতিক্রম ব্যক্তি আক্রান্ত হচ্ছে না?
‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে কিন্তু এমন একজনকে দেখা গিয়েছে। ইনডেক্স কেস অর্থাৎ বেথের স্বামী মিচ এমহফ ছিল এমন একজন ব্যক্তি, যার স্ত্রী ও পুত্র ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত হলেও, এবং সে তাদের কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও, তাকে ভাইরাসটি কাবু করতে পারেনি। এজন্যই পরবর্তীতে দেখা গেছে রাস্তাঘাটে সব মানুষ মাস্ক পরে ঘোরেফেরা করলেও সে মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে পারছে, তবু তার কিছু হচ্ছে না।
এখন পর্যন্ত অবশ্য নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রের জৈবিকভাবে প্রতিরোধিতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু এমনটি কি সম্ভব যে, কোনো একজন ব্যক্তি আক্রান্ত হবার পর সেরে উঠেছে, এবং তারপর আর তার নভেল করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে না? এখন পর্যন্ত এমনটিও নিশ্চিত করা যায়নি বটে, তবে বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে কাজ অব্যাহত রেখেছেন।
আর ও
আর ও (RO) বা আর-নট বলতে বোঝায় একজন আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কয়জনকে আক্রান্ত করবে। ‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে কাল্পনিক এমইভি-১ ভাইরাসের আর ও ছিল ৪। সে তুলনায় আমাদেরকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে নভেল করোনাভাইরাসের আর ও ২ থেকে ২.৫ এর মধ্যে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের একটি গবেষণা অনুযায়ী, নভেল করোনাভাইরাসের আর ও ২.২।
মৃত্যুর হার
‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। নভেল করোনাভাইরাসের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কতজন মারা গেছে, তার কোনো নিশ্চিত ও আনুষ্ঠানিক তথ্য এখন অবধি পাওয়া না গেলেও, অনেক বেসরকারি কোভিড-১৯ ট্র্যাকারের মতে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার ৬.৪ শতাংশ (১৭ এপ্রিল পর্যন্ত)।
অপ্রমাণিত প্রতিষেধক
‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে দেখা যায়, ব্লগার অ্যালান ক্রামউইড ফরসিথিয়া নামক একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধকে ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে, যদিও কোনো গবেষণা দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।
অ্যালান যখন ভিডিওবার্তার মাধ্যমে প্রচার করে যে সে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ফরসিথিয়া সেবন করে সুস্থ হয়ে গেছে, এবং এ বিষয়ে নিয়মিত তার ব্লগে লেখালেখি করতে থাকে, তখন সাধারণ মানুষ সেটিকে বিশ্বাস করে ফার্মেসিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে শুরু করে। মাত্র অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে সে তার ব্লগে ১২ মিলিয়ন ফলোয়ার পেয়ে যায়, এবং সে সুবাদে একজন মিলিয়নিয়ারেও পরিণত হয়।
এদিকে বর্তমানেও কোভিড-১৯ রোগের কোনো নিশ্চিত প্রতিষেধক পাওয়া না গেলেও, বিভিন্ন মহল থেকে কয়েকদিন পরপরই নতুন একেকটি প্রতিষেধকের নাম শোনা যাচ্ছে। এমনকি বাদ যায়নি থানকুনি পাতা কিংবা গরুর মূত্রও। তবে বিশ্বব্যাপী যে নামটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে, সেটি হলো ক্লোরোকুইন কিংবা এর অ্যানালগ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। কারণ স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিকে আখ্যা দিয়েছেন ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে।
আসলেই ক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ নির্মূলে কতটা কার্যকর, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে জানিয়ে রাখা ভালো, ‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে উপস্থাপিত ফরসিথিয়া কিন্তু আদতে একটি ধাপ্পা ছিল।
ভ্যাকসিনের পথ
‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে সিডিসির গবেষক ও বিজ্ঞানী ড. অ্যালি হেক্সটাল বলেছিলেন যে ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করা থেকে শুরু করে পরীক্ষা, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, বড় পরিসরে উৎপাদন ও বণ্টনের কাজে বেশ কয়েক মাস, এমনকি পুরো এক বছরও লাগতে পারে। পরে অবশ্য তিনি ভ্যাকসিনটি দিয়ে নিজের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে সম্ভাব্য সময়কাল খানিকটা কমিয়ে আনতে পেরেছিলেন।
এদিকে বাস্তবের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এ ধরনের একটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জোর প্রচেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আশাজনক সময়কালটি হলো এক বছর থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত।
পরিবর্তিত জীবনাচরণ
একটি মহামারী বিশ্বব্যাপী জীবনাচরণে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে ‘কনটেজিয়ন’-এ। সেখানে দেখা গেছে, একটি ভাইরাস গোটা সমাজব্যবস্থার স্বরূপ বদলে দেয়। বাঁচার তাগিদে মানুষ পশুর মতো হিংস্র ও নির্মম হয়ে ওঠে।
ফার্মেসি, ব্যাংক, দোকানপাট তছরুপ করতে থাকে তারা। পুলিশের পক্ষে এ ধরনের সন্ত্রাসবাদ রুখে দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, আর এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়া আটকাতে সামরিক আইন জারি করা হয়।
আমাদের বাস্তবজীবন এখনো অতটাও দুর্বিষহ হয়ে পড়েনি বটে, কিন্তু সেরকমটি হতে আর কত দেরি, সে প্রশ্নও কিন্তু থেকেই যায়। ‘কনটেজিয়ন’ ছবিতে আমরা দেখেছিলাম প্যানিক বায়িং, যা ইতোমধ্যেই আমরা বিশ্বব্যাপী দেখেছি। আবার খাবারের জন্য ভাঙচুরের মতো ঘটনা উন্নত বিশ্বে এখনো দেখা না দিলেও, আমাদের দেশে কিন্তু ইতোমধ্যেই ত্রাণের গাড়িতে ভাঙচুর ও ছিনতাই শুরু হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের স্বার্থপরতার যে চিত্র ‘কনটেজিয়ন’-এ ফুটে উঠেছিল, আমাদের সমাজেও ধীরে ধীরে তা প্রকট হচ্ছে। আশেপাশে অজস্র দুঃস্থ মানুষ থাকা সত্ত্বেও অনেকে ত্রাণের খাদ্যদ্রব্য চুরিতে মেতে উঠেছে। এছাড়া এমন পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমে ভুয়া সংবাদ প্রচারের ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেটিও আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
আর সবকিছু যদি বাদও দিই, ‘কনটেজিয়ন’ ছবির মতো বাস্তবেও যে কোয়ারেন্টিন নামক শব্দটি এত বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে, দিনের পর দিন মানুষকে গৃহবন্দি থাকতে হবে, কে ভাবতে পেরেছিল তা!