বাংলা ভাষা

লিখেছেন ইয়াকুব সিদ্দিকী, টরোন্টো থেকে

বাংলা ভাষা। মধুর চেয়েও মিষ্ট, দুধের চেয়েও পুষ্টিকর এই বাংলা ভাষা। এ ভাষা আমার মায়ের ভাষা, এ ভাষা আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাষা, এ ভাষা আমার জন্ম জন্মান্তরের ভাষা। মাতৃগর্ভ থেকে মর্তের মাটিতে পদার্পণ করেই যে সুললিত ভাষা শুনেছি এ সেই বাংলা ভাষা। এ ভাষা আমার জীবনের – আমার বাঁচার ভাষা। এ ভাষাতেই প্রকাশ করি আমার মনের আকুলি বিকুলি, হর্ষ-বিষাদ। এ ভাষার প্রভাব আমার শিরায় শিরায় আমার প্রতি অণূ-পরমাণূতে। তাই –

 

                                     এ ভাষাতেই হাসি কাঁদি, এ ভাষাতেই লিখন লিখি

                                     এ ভাষাতেই চলি ফিরি, এ ভাষাতেই গাইরে গান;

                                     এ ভাষাতেই স্বপন দেখি, এ ভাষাতেই চাইতে শিখি

                                     এ ভাষাতেই বেঁচে থাকি, এ ভাষাতেই মহীয়ান।

  এ ভাষা অবহেলা করে বড় হওয়ার আশায় যিনি অন্য ভাষায় সাধনা করেছেন, বড় হতে পারেননি তিনি কখনও। নিজের অবচেতন মনের আকুলি বিকুলি প্রকাশ করতে পারেননি তিনি প্রাণভরে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত চেয়েছিলেন ইংরেজী সাহিত্যে মহাকবি হতে। তাই তাঁর মনস্কামনা পূরণার্থে তিনি বাংলাদেশ  ত্যাগ করে চলে গেলেন বিলেতে। এমন কি ধর্মান্তর গ্রহণ করেও। কিন্তু পূর্ণ হলো না তাঁর মনস্কামনা। বুঝতে  পারলেন তিনি নিজের ভ্রান্তি। তাই তাঁর মুখ থেকে স্বতঃই বেরিয়ে এলো রামনিধি গুপ্তের ভাষায় –

                                                     নানান দেশের নানান ভাষা,

                                                বিনে স্বদেশী ভাষা পূরে কি আশা?

     ফিরে এলেন তিনি দেশে। মাতৃভাষা সাধনায় নিয়োজিত করলেন নিজেকে। পরবর্তিকালে তাঁর স্বপ্ন সার্থক হলো। বাংলা সাহিত্য তাঁকে মহাকবি সম্মানে ভূষিত করলো। তাঁকে মহাকবি করার ভাষা কি অবহেলার   ভাষা হতে পারে?

     রবি ঠাকুরের মত বিশ্বকবি, নজরুল ইসলামের মত বিদ্রোহী কবি, আলাওলের মত মহাকবি, সত্যেন্দ্রনাথের মত ছন্দের যাদুকর, বঙ্কিমের মত সাহিত্য সম্রাট, শরতের মত কথাশিল্পী, জসীম উদ দীনের মত পল্লীকবি ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মত নাট্য সম্রাটকে যে ভাষা সম্মানের উচ্চ শিখরে তুলেছে, সে ভাষা কি গরীব ভাষা হতে পারে? এ ভাষা ভাষীর দেশে জন্ম লভেছি বলে আমি কত না ধন্য!

     বাংলা ভাষা বর্তমান জগতের উন্নত ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইংরেজী ও উর্দূর পরেই বাংলার স্থান। এমন একদিন আসবে সেদিন পৃথিবীর উন্নত ভাষাগুলোর কাতারের প্রথমে দাঁড়াবে আমার মাতৃভাষা এই বাংলা ভাষা।

    বিশ্বের পুরোনো ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা একটি। কোন সালে কার দ্বারা বাংলা ভাষা আবিস্কৃত হয়েছিল ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মত ভাষাতত্ববিদও নিশ্চয় করে বলতে পারেননি; তবে অনুমান করেছেন হয়ত পঞ্চম শতাব্দীতে এর জন্ম। বাংলার প্রাচীন যুগে রাজার পৃষ্টপোষকতার অভাবে বাংলার বাইরে এক হিন্দুর গৃহে একে দেয়া হয় নির্বাসন। সেখানে দীর্ঘদিন নির্বাসন দণ্ড ভোগের পর স্বদেশে আবার ফিরে আসে। বাংলার শাহী বংশের শাসনামলে বাংলা ভাষার যে উন্নতি হয় নবাব আমলে তার ভাটা পড়ে। মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের পর থেকেই পারসী রাজভাষার পদ মর্যাদা লাভ করে। এ জন্য বাংলা ভাষায় অনেক পারসী শব্দের অনুপ্রবেশ অবলোকন করা যায়। বৃটিশ আমলে বাংলার আদর আরো কমে যায়। বৃটিশ শাসনের শেষার্ধে কতিপয় শক্তিমান সাহিত্যিকের করস্পর্শে বাংলা ভাষা আবার নব জীবন লাভ করে।

   অনেকে বলে থাকেন, বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকেই উৎপত্তি। কিন্তু তা মোটেই ঠিক নয়। বাংলা ভাষা একক ও মৌলিক ভাষা। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বংশের শাসনামলে বিভিন্ন ভাষার প্রভাব এতে অনুপ্রবেশ করেছে। অসমীয়া, তিব্বতী, পারসী, উর্দূ ও হিন্দী ভাষা থেকেই বেশী শব্দ বাংলায় প্রবেশ লাভ করেছে। আবার অনেক বাংলা শব্দ উপরোক্ত ভাষাগুলোকে অলংকৃত করেছে বহুল পরিমানে। যদি সংস্কৃত থেকেই বাংলার উৎপত্তি হতো, তবে এক সময় সংস্কৃত পণ্ডিতগণ বাংলাকে ‘যবনের ভাষা’ বলে সম্বোধন করতেন  না।

    উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় নানা ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা বর্ধিত হয়েছে। এ তো গেল প্রাক-স্বাধীনতা আমলের কথা। পাকিস্তান আমলেও বাংলার গায়ে কম আঘাত লাগেনি। কায়েদে আজমের অমর বাণীকে উপেক্ষা করে ষড়যন্ত্র চলছিলো এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার আসন থেকে  পদচ্যূত করতে। কিন্তু দেশব্যাপী আন্দোলনের দরুণ তা সম্ভব হয়নি। সে আন্দোলন আবার বড় সহজে হয়নি – বরকত, জব্বার, সালাম, রফিকের মত কতজন শহীদ হয়ে গেছেন দেশের নানা স্থানে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে যা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নামে পরিচিত।

    কষ্টলব্ধ বস্তু মাত্রেই মধুর; তাই বাংলা ভাষা আমাদের কাছে অমৃত সুধা। যে ভাষাতে শ্যামা, দোয়েল, কোয়েল, বুলবুলি গায় গান, যে ভাষাতে আমার বাবামা বলেন কথা তার চাইতে প্রিয় ভাষা আর কি হতে পারে! তাছাড়াও শিশুর জন্মের পরেই তার অধর ফুটে প্রথম যে অর্থযুক্ত কথাটি বের হয় তা হলো মা,  সেহেতু মায়ের মুখের ভাষাটাই তার সহজবোধ্য ও সহজলভ্য। যে জাতির ভাষা যতো উন্নত, সে জাতি ততো  উন্নত। কারণ সাহিত্যের মধ্যেই রয়েছে মানুষের কর্মের প্রেরণা। কোন জাতির ভাষা দেখেই সে জাতির মন যাচাই করা যায় – কেননা জাতির মন প্রতিফলিত হয় সে জাতির ভাষার মুকুরে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ