গোলাম মাওলা রনি
আমার জীবনে একটা সময় ছিল যখন মনে করতাম, ২৯ ডিসেম্বর দিনটি আমার জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। তারিখটি নিয়ে আমার দুর্বলতার প্রধান এবং প্রথম কারণ ছিল, এদিন আমার একমাত্র মেয়ে নন্দিতার জন্ম হয়েছিল। পরে আরো অনেক প্রাপ্তি-সফলতা, ঘটনা-অনুঘটনার সাথে যোগ হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। তারিখটি যেদিন আমি জীবনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। ফলে ডিসেম্বর এলেই আমার মনের মধ্যে এক ধরনের ফুর্তি ফুর্তি ভাব এসে যেত। দু’হাতে খরচ করতাম- পেটপুরে ভালোমন্দ খেতাম এবং বেশি বেশি ভালো কাজ ও ইবাদত বন্দেগি করার চেষ্টা করতাম।
২০১৮ সালে যখন ডিসেম্বর মাস এলো তখন আমার মনের ফুর্তি ফুর্তি ভাব টইটুম্বুর হয়ে উপচে পড়ার জোগাড় হলো। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমি ব্যক্তিগত কারণে মনোয়ন চাইনি। পরবর্তী সময়ে মনে হয়েছিল, আমি আর নির্বাচন করব না। ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-সংসার, লেখালেখি এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্যেই নিজেকে ব্যস্ত রাখব। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে আমার মনে আবার রাজনীতির চুলবুলানি শুরু হয়ে গেল- আবার আরো অনেকের সাথে পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগ করা শুরু করলাম। আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করে দলের তাঁবেদারি-তোষামোদ ছাড়াও দলের এবং সরকারের ইতিবাচক বিষয়গুলো লেখালেখি, টকশো, সভা-সমিতি, সেমিনার এবং তৃণমূলে গণসংযোগের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রচার করতে শুরু করলাম। জনগণের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক- এলাকার জনপ্রিয়তা এবং ঊর্ধ্বতন নেতাদের সাথে সুসম্পর্কের কারণে আমি মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু মনোনয়ন না পেলে দল ত্যাগ করব এমন চিন্তা কোনো দিন স্বপ্নেও করিনি। ফলে আমি যেদিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলাম না, সেদিন একটুও বিচলিত বা ব্যথিত হইনি। বরং নিজের কাছে এক ধরনের স্বাধীনতা অনুভব হতে লাগল। ভাবলাম, আলহামদুলিল্লাহ! এরপর আমার প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল- সপরিবারে ওমরাহ করে এসে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমে যাওয়া। ধারণা ছিল, নির্বাচনটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক হবে এবং সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই আমার সাহায্য দরকার পড়বে। আমার পরিবর্তে যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল তিনি সাঙ্গপাঙ্গ এবং ফুলের তোড়া নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমি তাকে আন্তরিকতাসহকারে অভ্যর্থনা জানালাম এবং সম্ভাব্য সব সহযোগিতার আশ্বাস দিলাম। তিনি আমার অফিস থেকে চলে যাওয়ার পর শুরু হলো বিপত্তি।
নির্বাচন কমিশন যখন একাদশ সংসদ নির্বাচনের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর বলে ঘোষণা করল, তখন কিছুটা হলেও হোঁচট খেলাম। কারণ তারিখটি ছিল আমার বোধ-বুদ্ধি, মন-মনন আচ্ছন্ন করা ২৯ ডিসেম্বর থেকে একদিন পরে। তবু মনে মনে ভাবলাম- আল্লাহ যা করেন তা হয়তো ভালোর জন্যই করেন। কারণ ২৯ তারিখ মেয়ের জন্মদিনে টেনশন না থাকাই ভালো। তার চেয়ে বরং ৩০ তারিখে জন্মদিন এবং বিজয় উৎসব দু’টো একসাথে পালন করা যাবে।
১২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে সপরিবারে এবং বন্ধু-পরিজন সহকারে আমার নির্বাচনী এলাকা পটুয়াখালীর গলাচিপা-দশমিনার পথে রওনা হলাম। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত যাত্রাটি বেশ উপভোগ্য হলো এবং কোথাও কোনো সমস্যার নামগন্ধ টের পেলাম না। আমার মনে হতে লাগল- এবার বোধহয় ২৯ ডিসেম্বরের সাথে আরো একটি সৌভাগ্যের দিবস যুক্ত হবে।
আমরা যখন পটুয়াখালী পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় ২টা বেজে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে মামাশ্বশুর শাহজাহান খান যিনি এর আগে আমার আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন- জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে বিএনপিদলীয় প্রার্থী ছিলেন, তাকে বিষণ্ন দেখলাম। আমার শ্যালক শিপলু খানকেও বিচলিত দেখলাম। তারা জানালেন, প্রশাসনের সহায়তায় দুষ্কৃতকারীরা আমার গাড়িবহরে হামলা করে আমাকে আহত করে ঢাকা ফেরত পাঠানোর ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা সদলবলে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পুরো নির্বাচনী এলাকায় মহড়া দিচ্ছে এবং এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘর থেকে বেরুতে সাহস পাচ্ছেন না। মামাশ্বশুরের কথা শুনে আমি প্রমাদ গুনলাম। কেননা তিনি পুরো পটুয়াখালী জেলার রাজনীতিতে গত ৪০ বছর ধরে নিজেকে শীর্ষ অবস্থানে টিকিয়ে রেখেছেন। গলাচিপা দশমিনা ছাড়াও পটুয়াখালী শহরে তার রয়েছে শত শত পরীক্ষিত বিশ্বস্ত এবং সাহসী নেতাকর্মী। বিগত দিনগুলোতে তিনি কোনো রকম সঙ্ঘাত ছাড়াই এলাকায় নিজ আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। সুতরাং সেই তিনি যখন ভয়ার্ত হয়ে পড়লেন, তখন আমি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করলাম।
আমি মামাশ্বশুরকে পুরো ঘটনা গোপন রাখতে বললাম এবং আমার সঙ্গী সাথীদের ঝটপট খাবার খেতে বললাম। খাবার শেষে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সবাইকে সেই ভোররাতে গলাচিপা পাঠালাম এবং আমি থেকে গেলাম পটুয়াখালী। উদ্দেশ্য হলো- তারা তো আমার ওপর হামলা করার জন্য ওৎ পেতে থাকবে। সুতরাং তাদের হামলার মধ্যে স্ত্রী পুত্র- পরিজনদের জড়িয়ে পরিবেশ ভারী করার মানে হয় না। পটুয়াখালী থেকে গলাচিপাতে আমার গ্রামের বাড়ি যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। আমি পরিবারের লোকজনদের বিদায় জানিয়ে ভোর ৫টা পর্যন্ত নির্ঘুম রাত কাটালাম। যখন শুনলাম, তারা আক্রমণকারীদের ফাঁকি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, তখন আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম ভাঙল জোহরের আজানের শব্দে। অজু গোসল-নামাজ-কালাম এবং খানাপিনা শেষে মোটরসাইকেলযোগে গলাচিপার পথে রওনা হলাম অনেকটা নির্লিপ্তভাবে। আমার সঙ্গী হিসেবে মামাশ্বশুর, শ্যালক এবং আরো দুই-তিনজন বিএনপির বিশ্বস্ত কর্মী। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বকুলবাড়িয়া নামকস্থানে গিয়ে দেখতে পেলাম এক-দেড়শ’ মোটরসাইকেলে সশস্ত্র গুন্ডারা পথ আগলে রয়েছে এবং অকথ্য ভাষায় স্লোগান দিচ্ছে। তারা অস্ত্র উঁচিয়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছে এবং তাদের দলীয় স্লোগানে মুখে ফেনা তুলে নিজেদের আত্মবিশ্বাস অটুট রাখার চেষ্টা করছে।
আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে বহু খারাপ সময় অতিবাহিত করেছি। হুন্ডা-গুন্ডা মোকাবেলা করেই টিকে থেকেছি এবং পরিস্থিতি সবসময় নিজের অনুকূলে রেখেছি। আমি সন্ত্রাসীদের দেখে একটুও ভয় পেলাম না। আমার যে শ্যালক মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল তাকে বললাম, মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে সোজা সন্ত্রাসীদের ওপর উঠিয়ে দেয়ার জন্য। ওরা যখন দেখল আমার মোটরসাইকেল একাকী ওদের দিকে ধেয়ে আসছে তখন ওরা চিন্তাভাবনার জন্য এক সেকেন্ড সময় ব্যয় করতে সুযোগ পেল না। ওদের সব প্রস্তুতি-পরিকল্পনা-চক্রান্ত ভেস্তে গেল। তারা অনেকটা আর্তচিৎকার দিয়ে নিজেদের মোটরসাইকেলে টান মেরে ভৌঁ দৌড় দিলো- আর সেই সুযোগে আমরা ঢুকে গেলাম আমাদের রাস্তায় যেখানে নিরস্ত্র বিএনপি কর্মীরা দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। বকুলবাড়িয়া থেকে উলানিয়া বন্দরে আমার বাড়িতে পৌঁছতে রাত ৮টা বেজে গেল। পুরো রাস্তায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ নেমে এলেন এবং অবস্থা দেখে মনে হলো তারা বিজয় দিবসের আনন্দে মেতে উঠেছে। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।
২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার মনে নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা সৃষ্টি হয়নি। সারা দেশে বিএনপির প্রার্থীদের ওপর যে মামলা হামলা হচ্ছিল তার কোনো কিছুই আমার নির্বাচনী এলাকায় হয়নি। বরং উল্টো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এক ধরনের অশ্বস্তি ও আতঙ্কের মধ্যে ছিল। তারা শত কৌশল করেও আমাকে দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদের মধ্যে নিতে পারেনি। বরং আমি প্রতিদিন সকালে ও বিকালে আমার বাসার সামনে যে অভিনব জনসভার আয়োজন করতে থাকলাম তাতে ৮-১০ হাজার লোক জড়ো হতো। পুরো নির্বাচনী এলাকার লোকজন শত শত মোটরসাইকেল, টেম্পো, অটোরিকশা, মাইক্রোবাসে করে যেভাবে আমার বাসায় আসতে আরম্ভ করল তাতে নির্বাচনী মাঠে ধানের শীষ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর নামগন্ধ রইল না। এ অবস্থায় আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রমাদ গুনলেন। তাদের গডফাদাররা বৈঠকে বসলেন এবং আমি সেই বৈঠকের খবর জেনে গেলাম। সাধ্যমতো সতর্কতা অবলম্বন করলাম। ফলে সঙ্ঘাত হলো না।
এ অবস্থায় নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করার জন্য বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হলো। ফলে প্রায় হাজারখানেক নেতাকর্মী গ্রেফতার এড়ানোর জন্য এলাকা ছাড়লেন। অনেকে হাইকোর্ট থেকে জামিনের জন্য ঢাকায় চলে এলেন। আমি আশাহত না হয়ে সেনাবাহিনী নামার দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু সেনাবাহিনী নামার পর ক্ষমতাসীন দলের লোকজন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল। আমি আমার অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বুঝলাম ৩০ তারিখে আসলে কী হবে। কিন্তু এ কথা কিছুতেই কল্পনা করতে পারলাম না যে, ৩০ তারিখ আসলে কিছুই হবে না, যা হবে তা ২৯ ডিসেম্বরের নিশুতি রাতেই হবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ২৯ ডিসেম্বরের মতো ভয়াল কালোরাতের কালো থাবা অন্য কোনো জাতি ধর্ম-বর্ণ কিংবা সম্প্রদায়ভুক্ত আদম সন্তানদের জীবনে এসেছিল কি না, বলতে পারব না। তবে ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশের শতকরা ৯০ জন যখন চরম উৎকণ্ঠা হতাশা ভয় এবং ঘৃণা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল অথবা আধো আধো ঘুমে পরবর্তী দিনের দুঃস্বপ্নের কথা কল্পনা করছিল, ঠিক তখনই মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ও কুখ্যাত ঘটনা বারুদের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই বারুদের আগুনে মানুষের ভোটাধিকার পুড়ে ছারখার হয়ে যায়- মানুষের গণতন্ত্রের চিন্তাস্থলে রক্তাক্ত বলাৎকারের ঘটনা ঘটতে থাকে উপর্যুপরি এবং গণহারে। শয়তানি তৎপরতা, প্রতারণা এবং দানবীয় দাম্ভিকতার বলবীর্যে ব্যালট বাক্স ভরতে থাকে ধর্ষিত গণতন্ত্রের আর্তচিৎকারের মাধ্যমে।
২৯ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা যখন আমি জানতে পারলাম তখন অন্তত এ কথা ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করলাম যে, আমার জীবনের সৌভাগ্যের তারকাখচিত দিবসটিতে কোনো সুসংবাদ না এলেও অনাচার- অত্যাচার জুলুম ও জাল-জালিয়াতির যে বীভৎস দুঃস্বপ্ন আমি শুয়ে শুয়ে তন্দ্রাবস্থায় চাক্ষুস করলাম তার স্মৃতি কোনো দিন, কোনো কালে বা কোনো ক্ষণে ভুলতে পারব না। আমি এ কথা ভেবে নিজেকে সান্ত¦না দিলাম, ২৯ ডিসেম্বরের সুখময় স্মৃতি হয়তো কেবল আমাকে আনন্দ দেয়- অন্য দিকে দিবসটির যে ভয়াল স্মৃতি ২০১৮ সালে আমার মানসপটে রক্তাক্ত ক্ষত হিসেবে অঙ্কিত হলো তা কেবল আমি নই, তামাম দুনিয়ার শতকোটি মানুষকে রক্তাক্ত এবং বেদনাহত করেছে। এতবড় বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে সমব্যথী হওয়া যে কতবড় মর্যাদার তা যদি ২৯ তারিখের বলাৎকারকারীরা বুঝত তাহলে পৃথিবী অনেক বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেত।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য