শহীদ আসাদ আন্দোলন আর সংগ্রামের প্রেরণার উৎস

ড. জসীম উদ্দিন আহমদ

ঊনসত্তরের মহান গণআন্দোলন যার আত্মত্যাগের মাধ্যমে বেগবান হয়েছিলো ও সফল হয়েছিলো, তিনি এ দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী শহীদ আসাদুজ্জামান। আসাদ ভাই আমাদের অহংকার, আমাদের চেতনার পরতে পরতে সংগ্রামের দৃপ্ত অঙ্গীকার রূপে চির ভাস্বর হয়ে আছেন।
আসাদ ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ আন্দোলনের মশাল জ্বালানোর প্রথম স্ফুলিঙ্গ। তাঁর শহীদ হওয়ার পরই ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং আয়ুব শাহীর পতন ঘটে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন আর ঊনসত্তরের পথ ধরেই ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিঝরা দিনণ্ডলোতে শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ অনেকেরই প্রেরণার উৎস ছিলো। আসাদ ভাই সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলেই গৌরব আর অহংকারে যেমন একদিকে হৃদয় ভরে ওঠে, ঠিক একইভাবে বেদনায়ও ভারাক্রান্ত হয়। গৌরব আর অহংকার হয় আসাদ ভাইয়ের আন্দোলন ও সংগ্রামের সাথী হওয়ার জন্য। আর প্রিয় সহযোদ্ধাকে চিরদিনের জন্য হারানোর ফলে হৃদয়ে বেদনার অনুরণন। আসাদ ভাই ও আমি উভয়েই শিবপুরের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম ধানুয়ার ছেলে। এ দেশের কৃষক আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে শিবপুরের গৌরবোজ্জ্বল অবদান সকলেরই জানা। আমরা শিবপুর স্কুলে একই সাথে পড়াশোনা করেছি। আসাদ ভাই আমার তিন ক্লাস উপরে পড়তেন। ১৯৬২-র শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই আমাদের এক সাথে কাজ করা শুরু।
আমাদের চিন্তা চেতনাও ছিলো একই ধরনের অর্থাৎ প্রগতিশীল। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ সে সময়কালে সংগ্রামরত ও বেশ সোচ্চার ছিলো। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই, আসাদ ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তদানীন্তন পূর্ব পািকস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)- এর সক্রিয় নেতাকর্মী হিসেবে ঢাকা ছাড়াও শিবপুরে সংগঠনকে বিস্তৃত করার জন্য আমাদেরকে অনেক কাজ করতে হয়েছে।
আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব) আমাদের রাজনৈতিক চেতনাকে শাণিত করার পেছনে বেশ ণ্ডরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরই নেতৃত্বে আসাদ ভাই, তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন খান, আবুল হারিছ রিকাবদার (কালা মিঞা), ঝিনুক খান, মান্নান খান, সাফদার, আব্দুল আলী মৃধা, আওলাদ হোসেন ও আমি চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে সুদৃঢ় থেকে একই সাথে কাজ করেছি। ৬৫-এর আন্দোলন থেকে ৬৯-এর গণআন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে আমরা শিবপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সংগঠনকে বেশ মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হই।
মান্নান ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরই নির্দেশে শিবপুর অঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র যুবকর্মী হিসেবে আমরা সবাই মান্নান ভাইয়ের সাথে সংগঠনের কাজে এগিয়ে আসি। এছাড়াও শিবপুরের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তখন আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেরই আজ আমাদের মাঝে নেই। এদের ভেতর মরহুম রব খাঁ, মরহুম রায়হান উদ্দিন, মরহুম বশির উদ্দিন খাঁ, মোজাম্মেল হোসেন, বজলুর রহমান রিকাবদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। আসাদ ভাইসহ আমরা বেশ কয়েকজ ছাত্র যুবকর্মী গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দাবি দাওয়া আদায়ে কৃষকদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকি। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন গ্রামে কৃষক সমিতির সংগঠন ও শিবপুরে কৃষক সমিতির একটি স্থায়ী অফিস প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই।
১৯৬৮-এর শেষ দিকে মওলানা ভাসানী আইয়ুব মোনেম শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্রতর করার আহ্বান জানান। লাট ভবন ঘেরাও ও পরদিন ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতাল থেকে এ পর্যায়ের আন্দোলন বেগবান হয়। এরপর মওলানা ২৯শে ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার সর্বত্র হাটবাজার হরতালের ডাক দেন। তিনি তহশিল অফিস ঘেরাও ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যও আহ্বান জানান। এই আহ্বানে শিবপুর অঞ্চলের কৃষকদের সাধারণ জনগণ বেশ উদ্বুদ্ধ হয়। ইতোমধ্যেই মান্নান ভাইয়ের নেতৃত্বে আসাদ ভাইসহ আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিবপুর ও পাশের বিরাট অঞ্চল জুড়ে কৃষক সমিতির জংগী সংগঠন গড়ে উঠে। ২৯শে ডিসেম্বর, ১৯৬৮ শিবপুর অঞ্চলে হাতিরদিয়ায় হাটবার ছিলো (রোববারে হাতিরদিয়া হাট। শিবপুর থেকে প্রায় ৪ মাইল উত্তরে) বলে ওখানে হরতাল ডাকা হয়েছিলো। আসাদ ভাই শিবপুর থেকে বেশ কয়েকজন কর্মী নিয়ে হাতিরদিয়া বাজারে যান, তখন ঐ এলাকার আরও ছাত্র কৃষক কর্মী এসে যোগ দেয়। আসাদ ভাই ও কর্মীদের পিকেটিং-এর ফলে হাতিরদিয়ায় অত্যন্ত সফলভাবে হরতাল পালিত হয়। এর ফলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও টাউট গোষ্ঠী আতংকিত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশ বাহিনী বিনা উস্কানিতে বর্বরোচিতভাবে নিরীহ জনগনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তোফাজ্জলসহ বেশ কয়েকজন কর্মীকে গ্রেফতার করে। এর ফলে জনসাধারণ দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং আয়ুব মোনেমের পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবিতে অবিচল থাকে। তখন পুলিশ নির্বিচারে ণ্ডলি বর্ষণ শুরু করে। পুলিশের ণ্ডলিতে সিদ্দিকুর রহমান, মিয়াচান, চেরাগ আলী ও হাসান এই চারজন কৃষক শহীদ হন এবং নৃশংস কৃষক হত্যার খবর ঢাকা পৌঁছানোর জন্য আহত অবস্থায়ই আসাদ ভাই পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রথমে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে, পরে সাইকেল, লঞ্চ ও বাসে করে ঢাকা এসে পৌঁছেন। ঢাকায় পৌঁছেই তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে হাতিরদিয়ার ঘটনা অবহিত করেন এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রের অফিসে খবর পৌঁছে দেন। সাখাওয়াত ভাই (বর্তমানে আসাদ, পরিষদের সভাপতি) ও হালিম ভাই তখন দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিক, তাঁদের সহযোগিতায় হাতিরদিয়া খবরের শিরোনামে চলে আসে, দেশব্যাপী বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হাতিরদিয়ার ঘটনার পরই আসাদ ভাইকে প্রধান অভিযুক্ত করে পুলিম মামলা রজু করে তাঁর গ্রেপ্তারের জন্য হুলিয়া জারি করা হয়। ঐ অঞ্চলের কৃষকসহ সাধারণ জনসাধারণের ওপর চলতে থাকে পুলিশি নির্যাতন। আসাদ ভাই কর্মীদের সাথে গোপন যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন- এতে কর্মীদের মনোবল আরও বৃদ্ধি পায়। হাতিরদিয়ায় কৃষক হত্যা ও
পরবর্তী পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে হাতিরদিয়া ও শিবপুরে জনসভার ঘোষণা দেন মওলানা ভাসানী। সভার দিন শিবপুরে ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। সভাস্থলের চারদিকে পুলিশি বেষ্টনী গড়ে তোলা হয় আর প্রতিবাদী জনসাধারণ যাতে সভায় না আসতে পারে সে জন্য বিভিন্ন স্থানে বাধা দেয়া হয়। মজলুম জননেতা নেতা মওলানা ভাসানী পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে সভাস্থলে পৌঁছেই মোনাজাত ও জালিম শাহীর বিরুদ্ধে তার স্বভাবসুলভ জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করেন। চারদিক থেকে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত জনস্রোত আসতে থাকে। অল্প কিছুক্ষণের ভেতর পুরো মাঠ ভরে যায়। মওলানা জনগণকে স্বৈরাচার ও জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও তীব্রতর করার আহ্বান জানান। সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তিনি পুলিশকে হুশিয়ার করে দেন। হুলিয়া থাকা সত্ত্বেও আসাদ ভাই হঠাৎ করে সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করেন এবং সব ধরনের জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করার জন্য সহযোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানান। হাতিরদিয়ার ঘটনায় সারাদেশেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় এবং আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ হঠাৎ করেই ফেটে পড়তে থাকে।
গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য আসাদ ভাই প্রথমে কিছু দিন ঢাকায় আত্মগোপন করে থাকেন। পরে কৌশলগত কারণে ঢাকার বাইরে এক স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন।
১৯৬৯-এর জানুয়ারি। দেশের ছাত্র-সমাজ আইয়ুবের স্বৈরশাসন উৎখাতের জন্য আন্দোলনকে দিন দিনই বেগবান ও বিস্তৃত করছে। আসাদ ভাই কিছু দিনের জন্য তার গোপন আস্তানা থেকে ঢাকায় এসেছেন। প্রতিদিনই মধুর ক্যান্টিনে বা ষ্টেডিয়ামের কোন চায়ের দোকানে মান্নান ভাই, আসাদ ভাই ও আমরা ক’জন আন্দোলনের গতিধারা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। আন্দোলনের সফলতা সম্পর্কে গভীর প্রত্যয় ও আশাবাদ ছিলো আসাদ ভাইয়ের।
১৯৬৯-এর ১৯শে জানুয়ারি। আমরা সন্ধ্যার পর পাবলিক লাইব্রেরি থেকে রমনার ভেতর দিয়ে হেঁটে স্টেডিয়ামে যাই। পরদিন সকালেই বিশেষ প্রয়োজনে আসাদ ভাইয়ের ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার কথা। স্টেডিয়ামের চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় আমরা আসাদ ভাইকে বললাম- ‘‘আগামীকাল আমরা ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবো, ঢাকায় আন্দোলনের এখন এত ব্যাপকতা, এ সময় আপনি ঢাকা ছেড়ে যাবেন?’’ আসাদ ভাই কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, যেতে তো মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। তবুও বিশেষ প্রয়োজনে যেতেই হবে। রাতে ওখান থেকে আসাদ ভাই ও আমি এই রিকশায় ফিরি- আসাদ ভাই আজিমপুরের বাসায় যান। আমি পথে নেমে মহসীন হলে যাই।
২০শে জানুয়ারি পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বটতলার সভা শেষে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আমরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সলিমুল্লাহ হলের পূর্বপাশ দিয়ে ফুলার রোড ধরে শহীদ মিনারের রাস্তায় উঠছি। কাঁধে কারও স্নেহ-স্পর্শ। পেছনে ফিরে দেখি আসাদ ভাই। আমি বললাম- ‘‘আসাদ ভাই, আপনি এখানে? আজ সকালে তো আপনার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা।’’
তিনি বললেন, ‘‘তোমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় মিছিল করবে আর আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাবো তা কেমন করে হয়? মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না।’’ চির সংগ্রামী আসাদ ভাই এমনি করে সব ভিরুতা আর কাপুরুষতা জয় করেছিলেন। এর পর আমরা হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে স্লোগান দিতে দিতে মেডিকেল কলেজের মোড় পর্যন্ত যাই। ওখানেই পুলিশ হঠাৎ করে মিছিলের মাঝখানে আক্রমণ করে। আমি মিছিলের অগ্রভাগের সাথে নাজিমউদ্দিন রোড হয়ে বাহাদুরশাহ পার্ক পর্যন্ত যাই। সেখানে মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ওখান থেকে ক্যাম্পাসে ফিরেই শুনি আমাদের প্রিয় আসাদ ভাই শহীদ হয়েছেন। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবে অল্পক্ষণের ভেতরই সব সন্দেহের অবসান হলো।
২০শে জানুয়ারি আসাদ ভাই ঢাকা ছেড়ে চলে যাবেন বলে আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিলো। শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে যার সংগ্রাম তিনি কিছুতেই রাজপথের উত্তাপ ছাত্র জনতার উদ্দাম মিছিল ছেড়ে যেতে পারেননি বলেই চিরদিনের মত তাকে চলে যেতে হলো। আসাদ ভাই ছিলেন এক আপোষহীন সংগ্রামী নেতা। তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিলো এদেশের কৃষক, শ্রমিক সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন করা। কৃষক সমিতির মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করে একটি শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েমের স্বপ্ন তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন। তাই আসাদের রক্তে ভেজা শার্ট আমাদের সকলেরই প্রাণের পতাকা।
আসাদ ভাই এদেশের খুব সম্ভবত একমাত্র সচেতন রাজনৈতিক কর্মী যিনি আত্মহুতি দিতে পিছপা হননি। আসাদ ভাইয়ের শহীদ হওয়ার ৪ দিন পর শহীদ হন মতিউর। আর ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়, পতন ঘটে আইয়ুব শাহীর। এজন্যই একথা বলতে হয় যে, শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণতা লাভ এত দ্রুত কোনভাবেই সম্ভব ছিলো না।
১৯৭১ সনে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি তবে আজও আসাদ ভাইয়ের কাঙ্খিত শোষণহীন গণতান্ত্রিক দেশ কায়েম হয়নি, আজও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন হয়নি। স্বাধীনতার পরও আমরা স্বৈরাচার, রাজনৈতিক নির্যাতন ও অর্থনৈতিক শোষণে নিগৃহীত ও পিষ্ট হয়েছি। স্বাধীনতার পর কৃষকদের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি বরং জুলুম আর বঞ্চনা বাড়তে থাকে। তাই কৃষকদের দুঃখ-বঞ্চনার অবসানের জন্য মওলানা ভাসানী তাঁর হৃদয়ের ধন শহীদ আমাদের শিবপুরে কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন ১৯৭২ সনে। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মরহুম রব খাঁ ও অন্যান্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে শিবপুরে দু’লক্ষাধিক কৃষকের এক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শিবপুর মুখরিত হয়ে উঠেছিলো সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী কৃষকদের পদচারণায়। এই সম্মেলন থেকে সারাদেশের কৃষকরা সংগ্রামের অভয় বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়। অনুপ্রাণিত হয়। এর পর ৭২-৭৫ এর দুঃসময়ের পর ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের পর দেশ গড়ার মহান দায়িত্ব এসে পড়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ওপর। শিবপুরের কৃষক সমাজ ও জনগণ স্বাধীনতার ঘোষক প্রিয় নেতা জিয়াকে দেশ গড়ার কাজে দিয়েছে অকুন্ঠ সমর্থন। বাংলাদেশে স্ব-নির্ভর ও আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সনে শিবপুরে আবার অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট কৃষক সমাবেশ। কয়েক লাখ কৃষক জনতার ওই সমাবেশ থেকে দেশকে স্ব-নির্ভর করার ও প্রতিটি হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি প্রেসিডেন্ট জিয়া।
দেশীবিদেশী ষড়যন্ত্রের ফলে জিয়াউর রহমান শহীন হন। তার আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিনের সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরশাসন। ১৯৯১ সনের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পর দেশ পরিচালনার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন দেশনেত্রী বেগ খালেদা জিয়া। তাঁর আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হয়। কিন্তু আধিপত্যবাদীদের মদদে এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দেশীয় দোসররা বহু কর্মসূচী দিয়েছে- দেশের সার্বিক কর্মকান্ডকে স্থবির করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে। এরপর ১৯৯৬ সনের নীলনকশার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী সরকার। এই সরকারের আমলে বিগত আড়াই বছরেই দেশের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন অসম চুক্তির ফলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভোমত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন।
তাই আজ আসাদ ভাইয়ের আদর্শের কথা, চেতনার কথা বার বার আমাদের চেতনাকেও গভীরভাবে নাড়া দেয়। ১৯৯৭-এর ৩০শে এপ্রিল শহীদ আসাদ কলেজের মাঠে কয়েক লাখ মানুষের জনসভায় দাঁড়িয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কন্ঠ থেকে কৃষক বাঁচানোর অভয় বাণী ভেসে আসে, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান আসে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, প্রেসিডেন্ট জিয়া আর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সকলেরই কন্ঠে আমাদের বিশ্বাসকে জাগরুক রাখান আহ্বান শুনে আশ্বস্ত হয়েছে মানুষ।
দেশ আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশনেত্রী বেগম জিয়া স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার জন্য দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে শোষণ-বঞ্চনার অবসানের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি’র মহাসচিব জনাব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া শহীদ আসাদের সহযোদ্ধা, শিবপুরের কৃষক আন্দোলনের নায়ক, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শিবপুর অঞ্চলের প্রতিরোধের বীর সেনানী। মুক্তিযোদ্ধা নেতা দেশের এই দুর্যোগে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবেন- দেশনেত্রীর আহ্বানকে সারাদেশে সফলভাবে ছড়িয়ে দিতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এর ফলে একটি শোষণ-বঞ্চনাহীন গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হলেই শহীদ আসাদের আত্মা শান্তি পাবে।

ড. জসীম উদ্দিন আহমদ, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ