‘স্থাপত্য প্রকৃতিকে সংস্কৃতিতে রূপান্তর করে’

Museum, California, USA

বিশ্ববিখ্যাত ইতালিয়ান-সুইস স্থপতি মারিও বোত্তার ঝোলায় আছে জাতীয় আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কার। ৬৫ বছর বয়সী বোত্তা কাজ করেছেন কিংবদন্তি স্থপতি লে করবাইজার এবং লুই কানের সঙ্গে। নির্মাণ করেছেন অসংখ্য সৌধ, ডজনেরও বেশি জাদুঘর এবং চার্চ। তার বিশ্বনন্দিত স্থাপত্যকর্মের মধ্যে সানফ্রান্সিসকোর মোমা, বাসলসের জিন টিংগুইলি, টোকিওর ওয়াটারিয়াম কন্টেম্পোরারি আর্ট গ্যালারি। চার্চ তৈরি করেছেন ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং ইতালিতে। এ বয়সেও নিষ্ঠার সঙ্গে সৃষ্টি করে যাচ্ছেন একের পর এক স্থাপত্যকর্ম। এমিরেটস-এর ওপেন স্কাইজ (অক্টোবর ২০০৮ সংখ্যা)-এ দেয়া মারিও বোত্তার সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন সুদীপ্ত সালাম।

প্রশ্ন : নির্মাণের পেছনে আপনার দশর্নটা কী?
উত্তর : যেকোনো কিছুই নির্মাণ করা একটি পবিত্র কাজ বলে আমি মনে করি। নির্মাণ করতে পারা এমন একটি ক্ষমতা, যা প্রকৃতিকে সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করে, একটি শূন্যস্থানে আধ্যাত্মিকতার সমাবেশ ঘটায়। আমার তো মনে হয়, একটি জাদুঘর কিংবা শিল্পশালা নতুন জীবন এবং নতুন ইতিহাসের রচয়িতা।

প্রশ্ন : নির্মাণের সময় আপনি কীভাবে কাঁচামাল নির্বাচন করেন?
উত্তর : স্থাপনা নির্মাণের উপাদান সব সময় এক থাকে না। পাড় বাঁধতে, বিভিন্ন ভবন ও বাড়িঘর নির্মাণে গ্রানাইট ব্যবহৃত হয়। গ্রানাইট বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে মানায়। তেমনি ভাবে লাল ইট, মার্বেল অথবা পাথর ব্যবহৃত হয় অন্যান্য কাজে। স্থপতিরা হলেন কালের সাক্ষী এবং স্থাপনার দেয়ালগুলো হলো ইতিহাস-শিল্পকলা-প্রযুক্তির আয়না। নির্মাণ উপাদান হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের ফ্যাশন, যা কি না যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়। নির্মাণ উপাদান শুধু একটি নামই নয়, এর ওপর নির্ভর করে একজন স্থপতির স্টাইল ও ভাবনা।

প্রশ্ন : স্থাপনার জন্য প্রাকৃতিক আলো কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : খুবই জরুরি। কৃত্রিম আলোর চেয়ে উপাসনালয়গুলোতের প্রাকৃতিক আলো বেশি মানায় । কৃত্রিম আলো যান্ত্রিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। রঙিন আলো আমাদের শহরকে নষ্ট করছে। জাদুঘর এবং বিশেষ স্থাপনাগুলোতে প্রাকৃতিক আলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রাকৃতিক আলো শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করে না, তাছাড়া এ আলো স্বাধীন, মুক্ত।

প্রশ্ন : আপনার স্থাপনাগুলোতে কী প্রতীকী ব্যাপার থাকে?
উত্তর : হ্যাঁ থাকে। আমি বারবার বেলনাকৃতির ফর্ম ব্যবহার করি, যা যান্ত্রিকতাকে প্রাকৃতিক শক্তির মুখোমুখি দাঁড় করানোর মতো। বেলনাকৃতির ফর্মে উঁচুনিচু করে কাটা পাতলা গ্লাসের ছাদ- আকাশ ও মাটির এক হয়ে যাওয়ার প্রতীক বহন করে। শক্ত সিমেন্টের ব্লক ও রেখা স্থাপনায় শৃঙ্খলা সংযোজন করে। রেনেসাঁ সময়কালে এ নির্মাণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো।


Mogno Chapel, Switzerland

প্রশ্ন : প্রাচীন স্থাপনাগুলোকে তো সংরক্ষণ করা উচিত, আপনার কী অভিমত?
উত্তর : এতে কোনো সন্দেহ নেই যে স্থাপনা একটি স্থানের স্মৃতিকে ধরে রাখবে। স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে হলে প্রাচীনকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং নতুনের উচিত পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শনের প্রতি সম্মান দেখানো।

প্রশ্ন : একটি স্থাপনা ডিজাইন শেষে আপনার কেমন অনুভূতি হয়?
উত্তর : স্থাপত্যকলা একটি যৌথকর্ম, এই শিল্পকলাকে কেউ একা অনুভব করতে পারে না। এটি একা একা করার মতো কোনো শিল্প নয়। এটি দলীয়ভাবে প্রকাশ পায়।

প্রশ্ন : এমন কি কখনো হয়েছে, যখন আপনি নিজের কোনো একটি কাজ শেষে খুশি হতে পারেননি?
উত্তর : আমরা স্থপতিরা আমাদের নিজের সৃষ্টির সমালোচনা করতে পারি না। এমনকি ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও। শিল্পীরা বাবা-মা’র মতো। তারা তাদের বিকলাঙ্গ সন্তানটিকেও ভালবাসে।

প্রশ্ন : আপনি কী কোনো একটি বিশেষ ধরনের স্থাপনা নির্মাণেই আগ্রহী?
উত্তর : আমি অনেক চার্চ ডিজাইন করেছি, বিশেষ করে জাদুঘর। এ জন্য নয় যে, আমি তা করতে বেশি পছন্দ করি। করতে হয়েছে কেননা এর চাহিদা রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে পৃথিবীতে প্রায় ৮শ জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। আমি নিশ্চিত ভাবে জানি না কেন? সম্ভবত, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ক্ষতিপূরণের প্রচেষ্টায় শিল্প ও ইতিহাসকে মানুষের সামনে অতীতের সনদ রূপে তুলে ধরতেই জাদুঘরের প্রসার।

প্রশ্ন : আপনি একটি আধুনিক জাদুঘরকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
উত্তর : একটি আধুনিক জাদুঘরের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয়। এক. দর্শক যখন একটি জাদুঘরের বিশাল এবং ঐশ্বর্যপূর্ণ হলে প্রবেশ করবে তখন সে যেন অভিনব কিছু অনুভব করে। দুই. জাদুঘরের প্রদর্শন। যখন কোনো আলোচনা, বক্তৃতা, ক্যাফে অথবা অস্থায়ী চিত্রকর্ম প্রদর্শনী চলবে তখন যাতে জাদুঘরটিকে প্রাণবন্ত মনে হয়। দর্শক এবং জাদুঘরের মাঝে চলমান যোগাযোগ থাকা জরুরি। একটি সনাতনী, নোংরা জাদুঘরের মৃত্যু অনিবার্য।

প্রশ্ন : এখন কী নিয়ে কাজ করছেন?
উত্তর : অনেকগুলো কাজ করছি। সেগুলোর মধ্যে মিলানের ক্যাম্পরি মিউজিয়াম, বেইজিংয়ের সিংগুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর ও চিত্রশালা, ইতালির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও টাউন হল, টিচিনোর মিউজিয়াম অব আর্কিটেকচার, যেখানে আমি লেকচার দিই। আরও করছিÑহায়দরাবাদের একটি অফিস ব্লক এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেচলার মিউজিয়াম অব আর্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ