সাহিত্য নিয়ে যাদের কিছুটা জানাশোনা আছে তারা মার্ক টোয়েনের নাম নিশ্চয়ই শুনেছে। অ্যাডভেঞ্চার অব হাকেলবেরি ফিন আর অ্যাডভেঞ্চার অব টম সায়ার নামক উপন্যাস লিখে কিংবদন্তী লেখকদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন। এদের পাশাপাশি তার আরো অনেক অনেক কালজয়ী লেখা আছে।সেসব নিয়ে হয়ে আসছে আলোচনা ও বিশ্লেষণ। এক ডজনেরও বেশি উপন্যাস তো লিখেছেনই পাশাপাশি লিখেছেন অসংখ্য ছোট গল্প ও প্রবন্ধ। ১৮৩৫ সালে ফ্লোরিডায় জন্ম নেওয়া এই স্যাটায়ার লেখকের বেশ কিছু অজানা দিক নিয়ে এখানের আয়োজন।
ছদ্মনামের আদ্যোপান্ত
অন্যান্য অনেক লেখকের মতো মার্ক টোয়েনের আসল নাম আদতে এটি নয়। মার্ক টোয়েন ছদ্মনামে লেখালেখি করা এই প্রতিভাবান লেখকের আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লেমেন্স। লেখালেখিতে প্রবেশের আগে বেশ কিছু নাম ব্যবহার করেছিলেন। থমাস জেফারসন, সার্জেন্ট ফ্যাথম, জশ ইত্যাদি ছিল তার নামের নমুনা। তবে কোনোটিই বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। শেষমেশ মার্ক টোয়েন নামটিই পছন্দ ও স্থায়ী হয় তার।
মার্ক টোয়েন অর্থ হচ্ছে ১২ ফুট গভীর জল। স্টিমবোট পাইলট হিসেবে কাজ করার সময় এই নামটি মাথায় আসে তার। এই নাম সম্বন্ধে আরেকটি ধারণা আছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি তিনি পেয়েছেন এক পানশালায় গিয়ে। বিয়ারের জন্য বারটেন্ডার তাকে চক দিয়ে বোর্ডে দুটি দাগ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেই ভাষায় যা শুনতে অনেকটা ‘মার্ক টোয়েন‘ এর মতো উচ্চারিত হয়েছিল। সেই থেকে তিনি মার্ক টোয়েনকেই ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন।
খনিজীবী মার্ক টোয়েন
কর্মক্ষেত্রে শুরুতে স্টিমবোট পাইলট থাকলেও ১৮৬১ সালে বেসামরিক যুদ্ধ শুরু হলে সেই কাজ ছেড়ে ভার্জিনিয়া শহরে খনিজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তবে তার ভাগ্য ভালো যে তাকে বেশিদিন এই কাজ করতে হয়নি। ১৮৬২ সালেই ভার্জিনিয়ার একটি সংবাদপত্রে লেখালেখির কাজ পেয়ে যান।
ব্যাঙ লাফের গল্প
১৮৬৪ সালে একটি কাজের সূত্র ধরে ক্যালিফোর্নিয়ায় গমন করেন মার্ক টোয়েন। সেখানের একটি বারে বারটেন্ডারের কাছে একটি গাঁজাখুরি গল্প শোনেন। ব্যাঙ লাফ নিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি প্রতিযোগিতা নিয়ে গল্পটির আবহ। পরে হোটেলে ফিরে এসে সেই কাহিনীটি নিজের মতো করে একটি ছোটগল্প রূপদান করেন। নাম দেন ‘দ্য সেলিব্রেটেড জাম্পিং ফ্রগ অব ক্যালাভারাস কান্ট্রি’। ১৮৬৫ সালে নিউইয়র্ক স্যাটারডে প্রেসে সেই গল্পটি ছাপা হয়। আর তাতেই দুনিয়া জোড়া খ্যাতি পেয়ে যান টোয়েন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই ছোটগল্পটি জাতীয় পুরষ্কারও পেয়েছিল।
লিখতেই চাননি সেরা উপন্যাসটি
অ্যাডভেঞ্চার অব হাকেলবেরি ফিন বইটির জন্য দুনিয়াজোড়া খ্যাতি ও সম্মান পেয়েছিলেন মার্ক টোয়েন। অথচ সেই বইটি লিখতেই চাননি তিনি। এডভেঞ্চার অব টম স্যায়ার বইটি লেখার পর তার পরবর্তী অধ্যায় নিয়ে টোয়েন লেখা শুরু করেন ১৮৭৬ সালে। ৪০০ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি লেখার পর নিজের কাছেই সেটি পছন্দ হয়নি তার। এক বন্ধুকে পাণ্ডুলিপিটি পুড়িয়ে ফেলার অভিপ্রায়ের কথাও জানিয়েছিলেন। কী মনে করে সেটি আবার রেখে দেন। কয়েক বছর ফেলে রাখার পর বিভিন্নজনের উৎসাহে আবার লেখা শুরু করেন এবং ১৮৮৩ সালে বইটি শেষ করেন।
বোর্ড গেমের আবিষ্কার
অ্যাডভেঞ্চার অব হাকেলবেরি ফিন লেখার বিরতির মাঝে টোয়েন ব্যস্ত ছিলেন একটি বোর্ড গেম তৈরি করা নিয়ে। মূলত গেমটির লক্ষ্য ছিল এটি খেলে যেন ইংল্যান্ডের বাচ্চারা তাদের রাজাদের সম্পর্কে জানতে পারে। দুই বছর ধরে কাজ করে করে গেমটিকে অনেক জটিল করে বানান। খেলতে হলে ঐতিহাসিক তারিখসহ ইতিহাসেও বেশ ভালো দক্ষতার প্রয়োজন। আর নিজের নামে সেই খেলার পেটেন্টও করে নিয়েছিলেন তিনি।
শুধু বোর্ড গেমই নয়, মার্ক টোয়েন আরো দুটি জিনিস উদ্ভাবন করেছিলেন। স্ক্র্যাপবুক করতে ভালোবাসতেন, তাই এটি নিয়ে একটি উদ্ভাবন করেন। মোজা আটকানোর জন্য একধরনের বিশেষ ফিতাও উদ্ভাবন করেন।
নিকোলা টেসলার সাহায্য
টেসলা এবং টোয়েন দুজনই খুব কাছের মানুষ ছিলেন। টেসলা বিজ্ঞানী আর টোয়েন সাহিত্যিক। সাহিত্যিক টোয়েনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে আগে থেকেই বেশ আগ্রহ ছিল। অন্যদিকে বিজ্ঞানী টেসলা ছোটবেলায় টোয়েনের কিছু বই পড়ে নিজের অসুস্থতা কাটিয়েছিলেন।
কথিত আছে, একবার তিনি টেসলার ল্যাবে গিয়েছিলেন। সেখানে সে সময় টেসলা একটি পরীক্ষা করছিলেন। পরীক্ষণের জন্য তৈরি ইলেকট্রোমেকানিক্যাল অসিলেটরে দাঁড়ানোর ৯০ সেকেন্ডের মাথায় বাথরুমের বেগ ধরে টোয়েনের। উল্লেখ্য, কয়েক দিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছিলেন টোয়েন।
টোয়েনের ভিডিও
মার্ক টোয়েনের একটি মাত্র ভিডিও এখন পর্যন্ত টিকে আছে। সেটি করেছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু থমাস এডিসন। লেখকের মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯০৯ সালে ভিডিওটি ধারণ করা হয়। সেই ভিডিওতে কানেকটিকাটের বাড়িতে টোয়েনের পরনে ছিল হালকা রঙয়ের স্যুট। অন্য একটি দৃশ্যে টোয়েনকে তার দুই মেয়ে ক্লারা ও জিনের সাথেও দেখা যায়।
অন্য আরেক ঘটনায় এডিসন ফোনোগ্রাফে মার্ক টোয়েনের কণ্ঠস্বরও রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার কোনো কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়নি।
বিড়ালপ্রিয় টোয়েন
মার্ক টোয়েন খুব বিড়ালপ্রেমী ছিলেন। একটা সময় তার বাড়িতে একইসাথে ১৯টি বিড়াল ছিল। এমনকি কোথাও গেলে সঙ্গী হিসেবে জন্য নিজের সাথে ভাড়া করা বিড়াল নিয়ে যেতেন। নিজের বিড়ালগুলোর নামও দিয়েছিলেন তিনি। তার দেওয়া বিড়ালের নামগুলো বর্তমানে অনেকে ব্যবহার করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম হলো বিলজিবাব, ব্লেথারস্কাইট, বাফেলো বিল, সোর ম্যাস, জোরোস্টার, সোপি সাল, পেস্টিলেন্স, বাম্বিনো ইত্যাদি।
নিজের মৃত্যুর ভবিষদ্বাণী
১৮৩৫ সালের নভেম্বরের ৩০ তারিখ তার জন্ম। সে বছরেই আকাশে দেখা যায় হ্যালির ধূমকেতু, যেটি প্রতি ৭৫ বছর পর পর আবির্ভূত হয়। ১৯০৯ সালে মার্ক টোয়েন বলেন,
আমি পৃথিবীতে এসেছি হ্যালির ধূমকেতুর সাথে। সামনে এটি আবার আসছে। আমার মনে হয় আমি এই ধূমকেতু আসার বছরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেব। আর তা না হলে সেটি আমার জন্যই হবে সবচেয়ে বড় হতাশার। ঈশ্বরও হয়তো তা-ই চান। ঈশ্বরের এই দুই খামখেয়ালি সৃষ্টি একইসাথে এসেছে, আবার একইসাথে চলে যাবে।
নিজের ভবিষদ্বাণীকে সত্য প্রমাণ করে ১৯১০ সালের ২১ এপ্রিল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন কালজয়ী সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন। কাকতালীয়ভাবে তার মৃত্যুর একদিন আগেই আকাশে দেখা দিয়েছিল হ্যালির সেই বিখ্যাত ধূমকেতু।