প্রায় ১০ বছর আগে বলিউডে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ওই ছবিটির নাম ছিল ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’। দিল্লির একটি পানশালায় মডেল জেসিকা লালকে সবার সামনে গুলি করে খুন করার পরও অভিযুক্তরা প্রথমে যেভাবে সবাই কোর্টে রেহাই পেয়ে গিয়েছিল, সেই সত্যি ঘটনার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল সেই সিনেমা।
ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনার প্রায় তিন দশক পর যেভাবে বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিশেষ আদালতের রায়ে মূল অভিযুক্তরা সবাই রেহাই পেয়ে গেলেন, তার সূত্র ধরে সেই সিনেমার প্রসঙ্গ তুললেন হায়দ্রাবাদের নালসার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইন বিশারদ ড. ফায়জান মুস্তাফা
বলেন, ‘ভারতের বিচারবিভাগের ইতিহাসে আজকের রায় সবচেয়ে বড় কলঙ্ক বললেও বোধহয় কিছুই বলা হয় না। যেভাবে একদিন সারা দেশ প্রশ্ন তুলেছিল, জেসিকা লালকে তাহলে কি কেউই মারেনি, ঠিক সেভাবেই আজ এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য বাবরি মসজিদও তাহলে কি কেউ ভাঙেনি?’
লখনৌতে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত বুধবার তাদের রায়ে বলেছে, মসজিদ ভেঙে ফেলার এই ঘটনা আদৌ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার দিন লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলীমনোহর জোশী বা উমা ভারতীর মতো বিজেপি নেতারা উন্মত্ত করসেবকদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন বলেও আদালত মন্তব্য করেছে, তবে তারা তাদের আটকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেও জানানো হয়েছে।
ফায়জান মুস্তাফাফায়জান মুস্তাফা কিন্তু বলছিলেন, ‘চার্জশিটে কোথাও বলা হয়নি এই নেতা-নেত্রীরা শাবল-গাঁইতি দিয়ে মসজিদের কাঠামো ভেঙেছিলেন। কিন্তু মসজিদ ভাঙাতে তাদের যে স্পষ্ট প্ররোচনা বা উসকানি ছিল, তার কিন্তু অজস্র অডিও ভিস্যুয়াল প্রমাণ আছে, অনেকে সে ব্যাপারে সাক্ষ্যও দিয়েছেন।’
অনেকটা একই সুরে হায়দ্রাবাদের এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসিও এ মামলার রায়ের পর প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আদভানি-জোশীরা নির্দোষ হলে মসজিদটা তাহলে সেদিন ভাঙল কে?’
হায়দ্রাবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সবাই দেখেছে সেদিন উমা ভারতী আওয়াজ তুলেছিলেন— এক ধাক্কা অওর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো!’
‘মঞ্চের ওপর হাসিমুখে আদভানি-জোশীরা মিষ্টি বিলি করছিলেন, তারও ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।’
‘এরপরও কীভাবে আদালত বলতে পারে, তারা করসেবকদের ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন?’, প্রশ্ন আসাদউদ্দিন ওয়াইসির।
বলা হয়ে থাকে, বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা সম্ভবত স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মাইলফলক – যা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে অন্য খাতে প্রবাহিত করতে শুরু করে। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পরই ভারতে হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান শুরু হয় দ্রুত, দেশের ক্ষমতাও তাদের হাতে আসে অচিরেই।
কিন্তু সেই ‘যুগান্তকারী অপরাধে’র ঘটনায় একজনও সাজা পেলেন না, এটা ভারতের মুসলিম সমাজের পক্ষে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন হচ্ছে।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য ও সিনিয়র আইনজীবী কামাল ফারুকি জানাচ্ছেন, তারা এদিনের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করবেন।
নো ওয়ান কিলড জেসিকার পোস্টারকিন্তু বাংলা ট্রিবিউনের কাছে তিনি একইসঙ্গে স্বীকার করলেন, ‘গত বছর রামমন্দিরের পক্ষে রায় এবং আজ বাবরি ভাঙার ঘটনায় সবাইকে নির্দোষ ঘোষণার পর বিচারবিভাগের ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারছি— সেটা কিন্তু আর বলা যাচ্ছে না!’
প্রসঙ্গত, বুধবার সিবিআই’র বিশেষ আদালতে যিনি রায় ঘোষণা করেন, সেই বিচারক এস কে যাদবের চাকরি জীবনের আজই ছিল শেষ দিন। বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলায় তিনি যাতে অবসরের আগে রায় দিয়ে যেতে পারেন, সে জন্যই তার চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে বিশেষ এক্সটেনশন দেওয়া হয়েছিল।
বিচারক যাদব তার রায়ে জানিয়েছেন, তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে সে দিনের ঘটনার যেসব ভিস্যুয়াল পেশ করেছিল, সেগুলোর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এমনকি নেতা-নেত্রীদের ‘জ্বালাময়ী’ ও ‘উসকানিমূলক’ ভাষণের যেসব অডিও জমা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও একেবারেই অস্পষ্ট ছিল, ফলে পরিষ্কার কিছু শোনা যায়নি বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
সুতরাং, প্রমাণাভাবেই অভিযুক্তরা সবাই খালাস পেয়েছেন। আর ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়কে এটাই মেনে নিতে হচ্ছে, বাবরি মসজিদ তাহলে কেউই ভাঙেননি!