মাহবুবুর রহমান রিপন, সিলেট
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ১০ বছরে ৫টি হত্যাকাণ্ড দেখেছে সিলেট নগরীর টিলাগড়ের মানুষ। নানা অপকর্মের পর সবশেষ শুক্রবার যুক্ত হল গণধর্ষণের ঘটনা। এসব অপকর্মের প্রায় সবই হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে, ছাত্রলীগে তাদের অনুসারীদের হাতে।
তারা হলেন- ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ এবং ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক, সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি রঞ্জিত সরকার। এমসি ও সরকারি কলেজ এবং টিলাগড় ছাত্রলীগ এখনও তাদের ইশারায় চলে।
দু’জনকেই সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে প্রস্তাব করে কেন্দ্রে নতুন কমিটির তালিকা পাঠানো হয়েছে। এদিকে সোমবার আজাদ ও রঞ্জিত যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, তারা এখন ছাত্রলীগ করেন না, তাই এ সময়ের অপরাধের দায় তাদের নয়। তবে দুজনেরই গ্রুপ আছে বলে স্বীকার করেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ দুই গডফাদারই সন্ত্রাসী তৈরি করেছেন নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য। নিজ প্রয়োজনে কর্মী নামধারী এসব সন্ত্রাসীকে নানা অপরাধে ঠেলে দিয়েছেন তারা। তাই এসব বন্ধ করতে হলে দ্রুত দুই পৃষ্ঠপোষককে থামাতে হবে। এ দুই নেতাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। এটা করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির খান বলেন, টিলাগড়ে একের পর এক ঘৃণ্য অপরাধে আমরাও বিব্রত। এখানে রাজনীতির সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এসব ঘটনার গডফাদারদের তথ্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। আশা করি, আগামী কমিটিতেই এর প্রতিফলন মিলবে। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন যুগান্তরকে জানান, যারা রাজনীতিকে ব্যবসা বানিয়েছেন, নিজেদের স্বার্থে টিলাগড়কে অপরাধের ঘাঁটি বানিয়েছেন, তাদেরকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য কেন্দ্রে বার্তা পাঠানো হবে।
২০১০ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ দুই পৃষ্ঠপোষক হত্যার রাজনীতি শুরু হয়। ওই বছর টিলাগড়ে রঞ্জিত অনুসারীদের হাতে আজাদ বাহিনীর উদয়েন্দু সিংহ পলাশ (এমসি কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী) খুন হন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ছোট ভাইকে জিম্মি করে ‘সুরমা গ্রুপের’ ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুমকে শিবগঞ্জে ডেকে এনে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় অভিযুক্তদের রঞ্জিত গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া হলে তারা আজাদ বাহিনীতে যোগ দেয়। ওই বছর আজাদ অনুসারীদের হাতে প্রাণ যায় রঞ্জিত অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী ওমর মিয়াদের। একইভাবে ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খান।
এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পূজার চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে রঞ্জিত অনুসারীরা নিজেদের কর্মী দ্বীপকে টিলাগড় পয়েন্টেই খুন করে। শুক্রবার রাতে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে রঞ্জিত সরকারের আশীর্বাদপুষ্টরা।
২০১২ সালের ৮ জুলাই রাতে ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্তরা রঞ্জিত সরকারের ডান হাত বলে পরিচিত। এ বছরের ১১ মে সিলেট প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে ফাও পাঁঠা (খাসি) চেয়ে পাঠান রঞ্জিত সরকার, না দেয়ায় দলবল নিয়ে হামলা চালান বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. আমিনুল ইসলামের ওপর। আমিনুল এ নিয়ে মামলাও করেন। তিনি বলেন, সেই মামলায় আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভার্চুয়াল কোর্ট থেকে জামিন নেন রঞ্জিত সরকারসহ অন্য আসামিরা।
২০১৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সিপিবির সমাবেশে হামলা চালায় রঞ্জিত সরকারের অনুসারী তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিরণ মাহমুদ। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আহত হলে বিলুপ্ত করা হয় জেলা ছাত্রলীগের কমিটি। ২০১৭ সালে ওমর মিয়াদকে আজাদের কার্যালয়ের সামনে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি আজাদ অনুসারী তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রায়হান মিয়াদ। এ ঘটনায় ওই বছরের ১৯ অক্টোবর সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আজাদুর রহমান আজাদ বলেন, আগে কী ঘটেছে, এসব টানলে বর্তমান গণধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা গুরুত্ব হারাবে। পেছনের সব বাদ দিয়ে কীভাবে সামনের দিনে এসব অপরাধ আর না হয়, তা নিয়ে ভাবা উচিত। তিনি বলেন, রঞ্জিত গ্রুপের জন্য তার অনুসারীরা চার বছর ধরে এমসি কলেজে ঢুকতে পারে না। সংঘর্ষ এড়াতেই তিনি তাদের সেখানে যেতে বারণ করেছেন।
রঞ্জিত সরকার বলেন, ছাত্রলীগের রাজনীতি ছেড়েছি অনেক আগে, এখন কেন এসবের দায় নেব। তিনি বলেন, আমার বাসা টিলাগড়ে বলেই এত আলোচনা। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানকার বাসা ছেড়ে দেব। আর ধর্ষকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই এদের সঙ্গে আমার নানা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছে।