চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরিয়েছেন পিকে হালদার ও তার ঘনিষ্ঠরা। কারসাজির মধ্যমে ঋণের নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে এসব অর্থ সরানো হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকজনসহ ২৫-৩০ ব্যক্তির সহায়তায় এ অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে। এদের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া এসব দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে পিকে হালদারসহ এ পর্যন্ত ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
দুদকে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যে চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা সরানো হয়েছে সেগুলো হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এফএএস) থেকে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সরানো হয়।
প্রশান্ত কুমার হালদার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে অর্থ সরিয়ে আত্মসাৎ ও দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। এর দায়িত্বে রয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।
সূত্র জানায়, পিকে হালদার ২০০৯ সালে রিলায়েন্সের এমডি থাকাকালীন কারসাজির মধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অর্থ সরানো শুরু করেন। পরোক্ষভাবে পিকে হালদারই চারটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ২০১৪ সালে এনআরবি গ্লোবালের এমডি ছিলেন পিকে হালদার। তখন এ প্রতিষ্ঠানে ডিমএমডির দায়িত্ব পালনকারী রাশিদুল হক পরবর্তীতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হন। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে ওই চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সরানো ও পাচারের বিষয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন রাশিদুল হক।
সূত্র আরও জানায়, উল্লিখিত অর্থের একটি বড় অংশ কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে পাচার করা হয়। পাচার করা এ অর্থের পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়েছে। বাকি অর্থ বেনামি প্রতিষ্ঠান, কাগুজে ও ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও স্বজনদের নামে সরিয়ে নিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগ করেন।
পিকে হালদারের বিষয়ে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত রিলায়েন্সের এমডি থাকাকালীন ব্যাংক এশিয়ায় তার ব্যক্তিগত হিসাবে ১৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা ও উত্তোলন করা হয়। যা একজন ব্যাংকারের জন্য স্বাভাবিক লেনদেন নয় বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা জানান, ওই সময় থেকেই পিকে হালদারের নজর পড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে।
চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সরানোর বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পিকে হালদারের বন্ধু মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক একেএম শাহেদ রেজার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৫টি প্রতিষ্ঠানে ১০৪ কোটি টাকা এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ৭টি ঋণ হিসাব থেকে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে ৭৪ কোটি টাকা সরানো হয়। এ টাকা ওয়ান ব্যাংকের চট্টগ্রামের স্টেশন রোড শাখার গ্রাহক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান আহমেদ খানের জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে পরিচালিত একটি হিসাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রশান্ত কুমার হালদার এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৪টি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে একটি হল- ‘৫৬ পুরানা পল্টন লেন’। কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে কারসাজি ও নানা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্যাপিটাল মার্কেটে টাকা সরিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, যেসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে, সেসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেও চলে। ফলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ৫৬ পুরানা পল্টন লেনে এমটিবি মেরিন লিমিটেডের চেয়ারম্যান স্বপন কুমার মিস্ত্রির স্ত্রী পূর্ণিমা রানী হালদার ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের নামে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নিলেও এমটিবি মেরিন লিমিটেডের নামে পরিচালিত কোনো হিসাবে এ অর্থ জমা হয়নি।
ঋণের নামে নেয়া অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে কিভাবে সরিয়ে নেয়া হয়, সে ব্যাপারে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক একেএম শাহেদ রেজার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেড, পদ্মা ব্লিচিং লিমিটেড, ফ্যাশান প্লাস লিমিটেডের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে পরিচালিত হিসাবে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা সরিয়ে নেয়া হয়।
এছাড়া ৯টি চেকের মাধ্যমে অলোক কুমার দাস ও অনিতা দাসের মালিকানাধীন প্যারামাউন্ট এগ্রো লিমিটেড এবং তাদের পুত্র রঙ্গন দাসের ব্যাংক হিসাবে ১৪ কোটি টাকা সরিয়ে মেঘনা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় ৮টি এফডিআর খোলা হয়। ঋণের অর্থ বেনামি প্রতিষ্ঠান ‘ওকায়ামা লিমিটেড’র নামে আইএফআইসি ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা সরিয়ে নেয়। ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের স্টেশন রোড চট্টগ্রাম শাখায় ইরফান আহমেদ খানের জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ৭টি চেকের মাধ্যমে ১১ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। ৫৮/১০, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট-এ কাগুজে প্রতিষ্ঠান ‘কোলাসিন লিমিটেডের’ চেয়ারম্যান অতশী মৃধা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে নেন। কিন্তু পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ‘ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ’র অনুকূলে ইস্যু করে তা থেকে ২৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে সরিয়ে নেয়া হয়। ওই অর্থ দিয়ে ন্যাচার এন্টারপ্রাইজের একটি ঋণ সমন্বয় করা হয়। ঋণের অর্থ থেকে চারটি চেকের মাধ্যমে ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক মতিঝিল শাখায় পরিচালিত ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
এভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সিকিউরিটিজ লিমিটেড, প্যারামাউন্ট স্পিনিং লিমিটেড, প্যারামাউন্ট হোল্ডিং লিমিটেড, তাসমিহা বুক বাইন্ডিং এবং নুর এন্টারপ্রাইজ; জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে আরও বিপুল অর্থ স্থানান্তর করা হয়।
৩০ গুলশান এভিনিউর ঠিকানায় মুন এন্টারপ্রাইজের মালিক শঙ্খ বেপারি ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৮৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ঋণের নামে বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তর করেন। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক মো. নওশের-উল ইসলামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘মার্কো ট্রেড’র হিসাবে ২১ কোটি ২৪ লাখ টাকা সমন্বয় করা হয়। একইভাবে সিগমা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের হিসাবে ১৫ কোটি টাকা, ‘হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’র হিসাবে ৬ কোটি টাকা সরানো হয়। ৬টি চেকের মাধ্যমে অলোক কুমার দাস ও অনিতা দাসের মালিকানাধীন প্যারামাউন্ট স্পিনিংয়ের হিসাবে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা সরিয়ে নেয়া হয়। ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের ধানমণ্ডি শাখায় মুন এন্টারপ্রাইজের হিসাবে ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা সরিয়ে ওই হিসাব থেকে ১৫ কোটি টাকা হাল ইন্টারন্যাশনাল ও সিগমা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিডেটের হিসাবে সরিয়ে নেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অমিতাভ অধিকারী হলেন পিকে হালদারের আপন খালাতো ভাই এবং উজ্জ্বল কুমার নন্দী হলেন পিকে হালদারের পুরনো অফিসের সহকর্মী। উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী পিপলস লিজিং পরিচালক হিসেবে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। অর্থাৎ বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সে টাকা দিয়ে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন তারা। পরে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন।
অপরদিকে রেপটাইল ফার্মের নামে এমডি রাজিব সোম ৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ওই টাকা উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও অমিতাভ অধিকারীর ব্যক্তিগত হিসাবে সরিয়ে নেয়া হয়। পরে সেই টাকা প্রশান্ত কুমার হালদারের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। রেপটাইল ফার্ম এর ৯৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কাগুজে প্রতিষ্ঠান পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে। আর এই প্রতিষ্ঠানের নামে ৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হলেও তা এসএ এন্টারপ্রাইজ, রেপটাইল ফার্মের নামে টাকা সরিয়ে নেয়া হয়। ব্যাংক এশিয়া লি.র গ্রাহক পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের হিসাবে (হিসাব নং-৪০০৭১১১০০০১১৫৭৮) ৭০৮ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে। যা দুদকের অনুসন্ধানে এটি মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ। হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক স্বপন কুমার মিস্ত্রি তার প্রতিষ্ঠানের নামে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নিলেও বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের ধানমণ্ডি শাখায় হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে পরিচালিত হিসাবে ৬২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে ওই হিসাব থেকে পিকে হালদারের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে ওই অর্থ সরিয়ে নেয়া হয়।