অধ্যাপক যতীন সরকার। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে এক অন্যতম পুরোধা। তাঁর মার্ক্সীয় সাম্যবাদী মৌলিক চিন্তা ঋদ্ধ করেছে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে। ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা চন্দপাড়া গ্রামে যতীন সরকারের জন্ম। দীর্ঘদিন ময়ময়নসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। ২০০২ সাল থেকে নেত্রকোনা শহরের ‘বানপ্রস্থ’ নিজ বাড়িতে তিনি অবসরজীবন যাপন করছেন। আজীবন মফস্বলবাসী এ লেখক তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্যা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যতীন সরকারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে কবি আল্লামা ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ, লালন, উকিল মুন্সি, জালাল খাঁ ও লৌকিক ধর্মের নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন শিশির রাজন।
প্রশ্ন : ‘ইকবাল আমাদের’ এমন একটি প্রবন্ধ আছে আপনার। যতটুকু জানি, তা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। ইকবালকে নিয়ে লেখা ও প্রকাশের পরের অভিজ্ঞতা বলবেন কি?
যতীন সরকার : হ্যাঁ, আছে। এটি পাঠকপ্রিয়ও হয়েছিল। আমি ফারসি বা উর্দু কিছুই জানি না। মনীরউদ্দিন ইউসুফের ‘ইকবালের কাব্য সঞ্চয়ন’ ইকবালকে নিয়ে লিখতে এটাই আমার প্রধান সম্বল ছিল। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে অনেক লেখা পড়েছি। এ প্রবন্ধটি ১৯৭৮ সালে জেলে বসে লেখা, যা ‘গণসাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভারতেও পর্যন্ত প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা হয়ছে। মনীর সাহেবের সাথে একদিন বাংলা একাডেমিতে দেখা, তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনি অসাধারণ লিখেছেন। কোথায় পেলেন এগুলো? আমি বললাম, আপনার বই থেকেই। তিনি অবাক। তিনি বললেন, আমি তো কখনো ইকবালকে নিয়ে এভাবে ভাবিনি। আর একবার, আবুগিফারী কলেজের দর্শনের অধ্যাপক দেওয়ান আজরফ, তিনি সিলেটের ছিলেন। ইকবাল নিয়ে বহু কাজ করেছেন। এক অনুষ্ঠানে সিলেটি ভাষায় তিনি আমার প্রশংসা করা শুরু করলেন। আসলে কি জানো, আমি বস্তুবাদী দর্শনের দৃষ্টি দিয়ে ইকবালকে দেখেছি। তার কারণে আমার লেখায় অনেকের কাছেই ইকবালকে নতুন মনে হয়েছে। যাদের বই পড়ে লিখেছি, তাদের কাছেও। এমন নতুন ভাবনার জন্যই প্রবন্ধটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।
প্রশ্ন : ইকবাল তো ভাববাদী…
যতীন সরকার : ইকবাল কেন! রবীন্দ্রনাথও ভাববাদী। তাতে কিছু যায়-আসে না। একজন বস্তুবাদী হলেই তিনি পৃথিবীর মহান ব্যক্তি হয়ে গেলেন আর ভাববাদী হলে তার বিপরীত হলেন, তা তো নয়। পৃথিবীর বহু মহান কবি-সাহিত্যক-শিল্পী ভাববাদী। বস্তুবাদী কজন? খুবই কম। কিন্তু তারা যে সত্য প্রকাশ করেন, তা ভাববাদী ও বস্তুবাদী সকল মানুষের জন্য। যেমন ইকবাল। তার যে খুদি তথ্য-আসরে খুদি, রমোজে বে খুদি। আত্মজ্ঞানের রহস্য আর আত্মলয়ের রহস্য। সরল কথা হলো, একজন ব্যক্তিমানুষের চিন্তাভাবনা এক। কিন্তু সেই ব্যক্তি মানুষ কখনোই সম্পূর্ণ হয় না, তার সমষ্টির সাথে যুক্ত না হলে। ব্যক্তির সংযোগ জাতির সাথে ঘটলে আল্লাহর অনুগ্রহ ঘটে এবং ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা ঘটে। যেমন ইকবালের কথা, মহানবীর মহান বাণী শুনরে দিয়ে মন..সঙ্গ থেকে শয়তান পালায় ছেড়ে দিয়ে তার অসৎ…। কাজেই সঙ্গের সাথে নিজেকে যুক্ত না করলে সে কিছুই করতে পারবে না। এ ব্যাপারটা কি বস্তুবাদীরা অস্বীকার করবে? করবে না। কাজেই একজন ভাববাদী বা বস্তুবাদী কি না, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা তিনি সত্যের সন্ধান করছেন কি না। একজন ভাববাদী দৃষ্টিতে দেখেন, অন্যজন বস্তুবাদী দৃষ্টিতে। কিন্তু সত্য যখন হয়, তখন একই হয়।
প্রশ্ন : ইকবালের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কেমন ছিল?
যতীন সরকার : সে সময়ে পৃথিবীর মহান কবি-সাহিত্যকের সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথ লাহোর গেলেন, ইকবালের সাথে দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু ইকবাল লাহোর ছেড়ে চলে গেলেন। বললেন, এক শহরে দুই কবি থাকতে পারে না। তাঁদের দেখা হয়নি ঠিকই, তবে তাঁরা দুজনই দুজনকে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে পারি। ইকবাল মারা গেলেন ১৯৩৮ সালে। তাঁর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ শোকের বাণী লিখলেন।
প্রশ্ন : স্যার, সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-সৃষ্টি ভারতবর্ষে ও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু ইকবাল এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েননি কেন?
যতীন সরকার : সত্য দুজনের সৃষ্টিতেই প্রবলভাবে আছে। ইকবাল রবীন্দ্রনাথের মতো এত ছড়িয়ে না পড়লেও তিনি সারা পৃথিবীতেই বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। সোভিয়েত রাশিয়াতেও ইকবালকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড় তো আর কেউ ছিল না। কিন্তু সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক দু-একজনের নাম বললে ইকবাল একজন।
প্রশ্ন : যতটুকু জানি, ইকবাল নিয়ে আপনি অনেক পড়েছেন এবং প্রায়ই আপনি বলেন তাঁর থেকে আপনি অনেক নিয়েছেন। কিন্তু ইকবালকে নিয়ে আপনার আলাদা বা স্বতন্ত্র বই নেই কেন?
যতীন সরকার : আগেই বললাম ইকবালকে নিয়ে কী পড়েছি। খুব বেশি তো পড়িনি। তবে তাঁর থেকে আমি অনেক বিষয় নিয়েছি। ইকবালকে নিয়ে আরও বিস্তৃত লেখার ইচ্ছা ছিল। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে ইকবাল, বিবেকান্দ আর নজরুল। মানসিক প্রস্তুতিও ছিল আমার। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতায় এখন আর পারছি না। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটা বয়সে মানুষকে থামতেই হয়। আমার ৮০ বছরের ওপরে হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর বেঁচে ছিলেন। আমি আরও তিন বছর বেশি…(হাসি)।
প্রশ্ন : স্যার, মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য আলোচনায় কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কি? থাকলে সেটা কী?
যতীন সরকার : হ্যাঁ। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য অলোচনায় আমার মনে হয় সীমাবদ্ধতা আছে। যে জন্য মার্ক্সবাদী সাহিত্য আলোচনা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না। তার কারণ সাহিত্য সৃষ্টি করে মানুষ, মানুষের মন। মানুষের মনকে আগে জানতে হবে।
প্রশ্ন : হুম, আপনার একটি প্রবন্ধে আছে, পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান…
যতীন সরকার: বিষয়টা আমি ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। এ বিষয়ে আরও পড়াশোনা আছে। আমার ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ বইয়ে প্রবন্ধটা আছে, যা ‘মানবমন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমি শুধু মার্ক্সবাদী নয়, পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে সাহ্যিতকে বিশ্লেষণ করে থাকি। সেই মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টি ছাড়া আমার মতে, সাহিত্যে মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ অসম্ভব।
প্রশ্ন : লালনের জীবন, প্রথাগত ধর্মের সাথে লালনের দর্শনের দিকগুলোকে কীভাবে দেখেন? এই যে লালন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলেন…তাকে ভাসিয়ে দিল…সমাজে ঠাঁই হলো না…
যতীন সরকার : লালন সম্পর্কে এ সমস্ত ঘটনার একটা পর্যায় ছিল। আর একটা পর্যায়ে একটা শ্রেণি বলল, লালন মুসলমান, তারা বিভিন্নভাবে প্রমাণও করতে চাইছিল। কিন্তু লালন এ সমস্তের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তার কথা, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কী হয় বিধান/ বামুন চিনি পৈতা প্রমাণ,/ বামনি চিনি কিসে রে।।’
আসলে হিন্দু-মাসুলমানের মানে প্রথাগত ধর্মের ঊর্ধ্বে তার অবস্থান। তার এ অবস্থান বিভিন্ন লৌকিক ধর্মের বৈশিষ্ট্য। বাউল, মতুয়া, ঠাকুরবাণী তাদের দর্শন প্রকৃত প্রস্তাবে লৌকিক ধর্ম। ধ্রুপদি বা ক্ল্যাসিকেল হিন্দু বা ইসলাম ধর্মের সাথে তাদের মিল নেই। লৌকিক ধর্মের লোকেরা নিজেদের পাগল বলে ঘোষণা দেয়। যেমন ধরো, পাগল দ্বিজ দাসের কথা…
প্রশ্ন : এটা কি ধ্রুপদি ধর্ম থেকে নিজেদের আলাদা করার প্রয়াস…
যতীন সরকার : হুম, তা তো অবশ্যই। যা বলছিলাম, তো লালনকে হিন্দু-মুসলাম এভাবে ভাগ করার চেষ্টা লালনকে বিকৃত করার অপপ্রয়াস। লালনের বিশিষ্ট ধর্মমত বা বাউলদর্শন তা কুষ্টিয়া এলাকায় ছিল। প্রথাগত ধর্মের মানুষ তাদের বিরোধিতা করেছে, নানাভাবে হয়রানি করেছে। সারা দেশজুড়েই লৌকিক ধর্ম ছিল। তা হয়তো লালনের বাউল ধর্মমতের মতো নয়। যেমন ধরো, আমাদের পূর্ব ময়মনসিংহ, আমাদের এ এলাকা লৌকিক ধর্মের সাথে ধ্রুপদি ধর্মের মিলও নেই, আবার বিরোধও নেই। এমনকি এখানকার মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্ন করেও গান গেয়েছে। যেমন নেত্রকোনার উকিল মুন্সি। তিনি মুন্সি, নামাজ পড়াতেন, ধর্মীয় আচার শেখাতেন। আবার বাউলগানও করতেন। কোনো দিনও তো তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ তোলেনি। উকিল মুন্সি, রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ-তাঁরা কুষ্টিয়া অঞ্চলের মতো আলাদা লৌকিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। এ সমাজে থেকেই তাঁরা কাজ করেছেন। ‘মানুষ থুয়া খুদা ভজ এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে।। মানুষ ভজ কোরান খোঁজো পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।।’
দেখো, এমন কথার পরও তার সাথে ধ্রুপদি ধর্মের কোনো বিরোধ তৈরি হয়নি। জালাল খাঁর গানে রক্ষণশীল ধর্মের বিরুদ্ধে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও আছে। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র দেশ বলে খ্যাত নেত্রকোনায় এমনটা ছিল। এখানে আরেকটা বিষয়, কবিয়ালদের কবিগান আর বাউলদের ধরাট গান প্রায় একই মতো। দুইটার মধ্যেই আছে প্রচ- যুক্তি। সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তির কোনো ব্যাপার নেই বলে প্রচলিত তা এখানে ভুল। সংস্কৃতে একটি কথা আছে, ‘বাদে বাদে জায়তে তথ্য বোধত’, অর্থাৎ বাদ ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে সত্যিকারের তথ্যটা বেরিয়ে আসে, যা কবিগান ও বাউলগানে আছে, যা আমাদের ধ্রুপদি ধর্ম বা রক্ষশীল ধর্ম হতে আলাদা। কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউলরা যেমন একটা বিশেষ লৌকিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন কিন্তু নেত্রকোনা বা ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাউলরা তেমনটা না।
প্রশ্ন : মানে এখানে তারা ধ্রুপদি ধর্মের পাশাপাশি ছিল কিন্তু বিরোধ ছিল না…কিন্তু স্যার লালনের ধারা ধরে জালাল খাঁর কথা যদি ধরি…
যতীন সরকার : ধারাটা এক অর্থে একই কিন্তু লালনদের যেমন বিশেষ লৌকিক ধর্ম ছিল, জালাল খাঁদের তা ছিল না।
প্রশ্ন : স্যার, বৈষ্ণব ধর্মও তো লৌকিক ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্মের সাথে কি বাউলদের কোনো মিল আছে?
যতীন সরকার : শোনো, এটা অনেক বিস্তারিত বিষয়। তবু অল্প করে বলি। শ্রীচৈতন্য দেব বৈষ্ণব ধর্ম প্রবর্তন করেছেন। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ রক্ষণশীলদের চাপে অনেক হিন্দু নিম্নবর্ণের মানুষ মুসলমান হয়ে যাচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে চৈতন্য দেব প্রচার করলেন, সব মানুষ সমান, সেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদের কোনো স্থান নেই। সকলে মিলে হরি নাম করবে। কলিযুগে তা ছাড়া মুক্তি নেই। চৈতন্য দেবের মৃত্যুর পর বৈষ্ণব ধর্ম বিভক্ত হলো। এ পর্যায়ে লৌকিক বৈষ্ণব ধর্মের ধারা এল। সেই লৌকিক ধারার সাথে বাউল ধর্ম ও সুফিবাদেরও মিল আছে।
প্রশ্ন : স্যার, বৈষ্ণব ধর্মে কি অন্য ধ্রুপদি ধর্মের মানুষ প্রবেশ করতে পারত?
যতীন সরকার : হ্যাঁ, এটাই তো সে সময়ের বড় ব্যাপার। অনেক মুসলমানও বৈষ্ণব হয়েছে। যেমন যবন হরিদাস, সে মুসলিম ছিল, বৈষ্ণব হয়েছে। আসলে লৌকিক ধর্মে মানুষে মানুষে বিভেদ কম ছিল। যে বিভেদগুলো আমরা শাস্ত্রীয় ধর্মগুলোতে দেখি।
প্রশ্ন : স্যার, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
যতীন সরকার : তোমাকেও ধন্যবাদ।