কর্নেল ওলি আহমেদ বাংলাদেশের একসময়ের তুখর একজন রাজনিতীবিদ। যিনি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনিতীর সাথে জড়িত। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল বিএনপির সাথে তিনি একেবারেই ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন পরিচিত এবং ভালো মানুষ হিসেবে নিজ দল এবং বিরোধী দল সবখানেই তার সমান গুরুত্ব ছিল। সম্প্রতি এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম দাবি করেছেন, তিনি একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। তখন তিনি বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতা। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে তিনি ওই প্রস্তাব পান। সম্প্রতি দেশের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকার ফেসবুকে লাইভে অলি আহমদ এ তথ্য প্রকাশ করেন।
আরো পড়ুন
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দু’ জন নেতা গিয়েছিলেন তখনকার মিন্টু রোডের শেখ রাজ্জাক আলীর বাসায়। ওই বাসার কাছাকাছি আমার বাসাও ছিল। তখন শেখ রাজ্জাক আলী ওই দু’ জনকে আমার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন উনি বলেছিলেন অলি আহমেদ ছাড়া কারো পক্ষে বিএনপিতে বিদ্রোহ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব না।
ওই দু’ জন আমার বাসায় আসলেন এবং আমাকে প্রস্তাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। তখন তারা বলল, আওয়ামী লীগের ১৪৩ জন এবং বিএনপির ৪০ জন দস্তখত করেছে। পার্লামেন্টারি ক্যু হবে আমি যেন প্রধানমন্ত্রী হই। প্রথম দিন রাত ১টা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত আলোচনা হল। দ্বিতীয় দিন আলোচনা হল। তৃতীয় দিনে তারা আসলো।
আমি চিন্তা করলাম, আমি হয়তো প্রধানমন্ত্রী হব কিন্তু এটা বেঈমানি করা হবে বেগম জিয়ার সঙ্গে। যেটা করা আমার পক্ষে ঠিক হবে না। হয়তো আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে জয়লাভ করলে বিএনপি আমাকে দোষারোপ করবে। আর বিএনপি জয়লাভ করলে আওয়ামী লীগ আমাকে দোষারোপ করবে। আর আমি দালাল হিসেবে চিহ্নিত হব। ঐদিন রাত একটার সময় আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমি ওনাকে অনুরোধ করি যে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন আমার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ নেয়া সম্ভব না। আমি বেগম জিয়ার সাথে বেঈমানি করবোনা।
অলি আহমদ বলেন, এর কয়েকদিন পরে বেগম জিয়ার কানে একটা সংবাদ গেল বিএনপির কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী হতে চায়। কিন্তু কে হতে চায় তিনি জানেন না। তারপর বেগম জিয়ার অফিসে আমাদের ডাকা হল। তখন আমরা ১৬ জন সিনিয়র মন্ত্রী উপস্থিত ছিলাম। তখন বেগম জিয়া বলেন, আপনাদের মধ্যে কেউ যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি রিজাইন করব। আপনারা প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু আমাকে বেইজ্জতি করবেন না। তখন আমি ওনাকে নিশ্চিত করে বলেছিলাম, আমি যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন পর্যন্ত আপনাকে কেউ বাইর করবে না। এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে আমার একটা আলোচনা হয়েছে ওই বিষয়টা আমি ঐদিন প্রকাশ করিনি। কারণ এটার কোন প্রয়োজন ছিল না।
৯৬ সালে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকটের ব্যাপারে তিনি বলেন, পরবর্তীতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সরাসরি আলোচনা হয়েছিল কীভাবে নির্বাচন হবে এ প্রসঙ্গে। এটার মধ্যস্থতা করেছিলাম আমি। এ মধ্যস্থতায় আমাদের সিদ্ধান্ত হলো বেগম জিয়াই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। ওই দল থেকে (আওয়ামী লীগ) পাঁচ জন বিএনপি থেকে পাঁচ জন করে মন্ত্রিসভার সদস্য হবে। ৪০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে বেগম জিয়াকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে এই কথা বলতে হবে। আওয়ামী লীগ তাদের কথাগুলি বলার জন্য গুলিস্তানে মিটিং ঠিক করলেন। আমরা একদিন আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে উপস্থিত হলাম। আমরা প্রায় ১৫-১৭ জন মন্ত্রী ওইখানে সারাদিন অপেক্ষা করলাম। বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রোগ্রাম নিয়ে গাজীপুর চলে গেলেন। ওইদিন বিকাল চারটায় ঢাকায় ফিরে উনি বললেন আজকে আমি আর ঘোষণা দেবো না।
আপনারা কাল সকালে আসেন। পরের দিন সকালে আমরা আবার গেলাম পরে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত হল বেগম জিয়া কিছুক্ষণের মধ্যে জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণাটা দিবেন। কিন্তু কিছু সময় পর ওনার প্রাইভেট সেক্রেটারি এসে বলল, ওনার প্রাইভেট স্টাফরা কথা বলতে চান। তখন আমি বললাম ম্যাডামের প্রাইভেট স্টাফরা মন্ত্রিসভার সদস্যদের জ্ঞান দান করবেন। এটা ঠিক হবে না। আমি তখন বেগম জিয়ার উদ্দেশে বলেছিলাম, আপনি তাদের অফিসে যান তাদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তখন উপস্থিত কেউই আমার কথাকে সমর্থন করেনি। ওই সময় সেখানকার উপস্থিত অনেকেই বেগম জিয়াকে বললেন আপনার টেলিভিশনে ঘোষণা দেয়ার দরকার নাই। তখন বেগম জিয়া বললেন তিনি টেলিভিশন ঘোষণা দেবেন না।
তারপর আমি ওনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে ভুল করেছেন। আপনি এখন যাদের কথা শুনছেন তাদেরকে আপনার মন্ত্রিসভায় নেয়া উচিত ছিল। তখন তিনি বলে উঠলেন, এদের মধ্যে অনেকেই উপযুক্ত মন্ত্রিসভার। এর ঘন্টাখানেক পরে একটা প্রস্তাব আসলো যে, আওয়ামী লীগকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে নির্বাচনের আগে কোন ধর্মঘট দেয়া যাবে না। তখন আমি বলেছিলাম এটা হয় না। নির্বাচনে যখন আমরা যাচ্ছি তখন তো হরতালের কোন কথা আসার কথা না। কিন্তু সেদিন কেউই আমার কথার সাথে একমত হননি। এই শর্ত ঘিরেই পরে আলোচনা ভেস্তে যায়।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সস্ত্রীক বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে তারেক রহমানের তখনই রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে নিজের ভিন্নমত জানানোর কথাও উল্লেখ করেন অলি আহমদ। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরো বলেন, আমি তো আগে বলেছি যে ১৯৯৬ সালের যে প্রস্তাবটা দেয়া হয়েছিল দুই দল থেকে পাঁচজন পাঁচজন করে মন্ত্রিসভায় নিয়ে খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন দেয়ার জন্য। যদি ওইভাবে নির্বাচনটা হতো তাহলে আজকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারতো না। ইয়াজউদ্দিন আহমেদের মতো লোককে যদি বেগম জিয়া ক্ষমতায় না বসাতেন, রাষ্ট্রপতি না বানাতেন। তাহলে সেনাসদস্যরা কখনোই ক্ষমতা দখল করত না। কারণ দেশে যখন অরাজকতা শুরু হয়ে গেল তখন তো দেশকে রক্ষা করার জন্য সেনা বাহিনীর কাছে আর বিকল্প কোন পথ ছিল না। আমি আবারো বলছি বিএনপির তখন দূরদর্শিতার অভাব ছিল। বিএনপি নেতাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল সেদিন।
ওলি আহমেদ বাংলাদেশের শুধু একজন পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও বটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। আর এ কারনে তাকে ভুষীত করা হয়েছে বীর বিক্রম পদবিতে। তার বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিএনপির সাথে কাটিয়েছেন সব সময়। ছিলেন বিএনপির আমলে যোগাযোগ মন্ত্রী।