আমিনুল ইসলাম
এক সরকারি বড় কর্তা’র (বিসিএস ক্যাডারের) স্ত্রী আমাকে বলেছে- “আপনি তো আমার স্বামীর পায়ের নখের সমানও হবেন না!”
তো, এই ভদ্রমহিলা এই কথা কেন বলেছেন আমাকে?
তার সাথে কথা হচ্ছিলো। কথা প্রসঙ্গে তিনি তার স্বামীকে নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন- তার স্বামী একজন সৎ মানুষ। আচার-আচরণে খুবই ভালো। তার মতো মানুষ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। এরপর তিনি বলেছেন- আমার স্বামী ফেরেস্তার মতো মানুষ।
আমি তার কথা মনোযোগ দিয়েই শুনছিলাম। একজন স্ত্রী তার তার স্বামীকে ফেরেশতা মনে করছে; এতে আমার কোন আপত্তি নেই। সে মনে করতেই পারে। কিন্তু একজন মানুষের কোন সমস্যা নেই। তার কোন দোষ নেই; এমন তো হওয়া সম্ভব না। তাই আমি তাকে বলেছি
-সকল মানুষই তো দোষে-গুণে মিলিয়ে। আপনার স্বামীরও নিশ্চয় কোথাও না কোথাও সমস্যা আছে। নইলে তো তিনি আর মানুষ থাকেন না; সতি সত্যি ফেরেশতা হয়ে যাবেন!
সে আমার কথা শুনে রেগে-মেগে আমাকে বলেছে- “আপনি তো আমার স্বামীর পায়ের নখের সমানও হবেন না! আমার স্বামীকে নিয়ে কথা বলার এতো বড় সাহস হয় কি করে আপনার!”
এই কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়! এটা বুঝার জন্য তো সামাজিক মনোবিজ্ঞানে একটা পিএইচডি ডিগ্রি নেবার দরকার হয় না। কলেজে পড়া একটা ছেলেও বলতে পারবে- কোন মানুষই দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কেন তার স্বামীকে অতিমানব কিংবা ফেরেশতা ভাবছেন?
এর একটা কারণ হচ্ছে এইসব সরকারি কর্তা কিংবা বিসিএস ক্যাডারদের অনেকেই হয়ত পুরো একটা পরিবারে একাই শিক্ষিত কিংবা এমন একটা বড় চাকরি পেয়েছেন। যার কারণে তার পরিবারের অন্য মানুষজন, আত্মীয়-স্বজন উঠতে-বসতে এদেরকে এতোটাই তৈলমর্দন করে বেড়ায় যে একটা সময় এরা নিজদের ফেরেশতা ভাবতে শুরু করে।
অন্য একটা কারণ হতে পারে- এরা এদের গ্রামের নানান মানুষজন কিংবা পরিচিত অনেককে চাকরি-বাকরি পাইয়ে দিতে সাহায্য করে কিংবা নিজের চাকরির সুবাদে সরকারি যে কোন কাজ সহজে করে দেয় বা এই টাইপ কোন কিছু হয়ত করে বেড়ায়। যার কারণে এদের এলাকার লোকজন কিংবা আত্মীয়-স্বজন দিনরাত এদের প্রশংসা করে বেড়ায়। কখনো কখনো ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনাও দেয় (বিশ্বাস না করতে চাইলেও, এটা কিন্তু সত্যি!) তাই এক সময় এরা ভাবতে শুরু করে- আমি তো খুব ভালো মানুষ! সবাই তো তেমনই বলছে!
নিজের পরিচিত একজন মানুষকে চাকরি পাইয়ে দিয়ে সে হয়ত ভাবছে ওই লোকটার সে উপকার করেছে। ওই লোক কিংবা তার পরিবারের মানুষজনও হয়ত তাকে বিরাট ভালো বলছে অথচ এরা বুঝতেও পারছে না- এই কাজের জন্য সে হয়ত হাজার হাজার মানুষের অপকার করে ফেলেছে। কারণ ওই চাকরিটা হয়ত অন্য কারো প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সে ওই সুযোগটাই পায়নি। এটি যে কোন উপকার নয়, বরং অন্যায়; এটা বুঝার সামর্থ্যও এদের নেই!
যা হোক, ভদ্রমহিলা আমাকে যখন বলছিল- “আমি তার স্বামীর পায়ের নখের সমানও হবো না!” তখন তার ছেলে-মেয়েরা তার সামনেই ছিল। এর মানে দাঁড়াচ্ছে তার সন্তানরা নিশ্চয় এইসব শুনেই বড় হয়েছে কিংবা হচ্ছে।
চিন্তা করে দেখুন অবস্থা! আমার মতো মানুষকে (আমি অতি অবশ্যই কোন বড় মানুষ নই। হবার কোন ইচ্ছে কোন দিন ছিলও না এবং হতেও চাই না। স্রেফ বুঝানোর জন্য বলছি) যদি এরা বলে বসতে পারে- “পায়ের নখের সমানও হবার যোগ্য নই!”; তাহলে দেশের সাধারণ মানুষকে এরা কোন চোখে দেখে সেটা নিশ্চয় সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের ছেলে-মেয়েরাও নিশ্চয় এমন ধারণা নিয়েই বড় হতে থাকে।
অথচ আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় এরা বেতন পায়। গাড়ি-বাড়ি পায়। আর নিজেদের অতি মানব ভাবতে শুরু করে। তো, এদের ছেলে-মেয়েরাও হয়ত একদিন ডাক্তার-জজ-ব্যারিস্টার হবে। কিন্তু মানুষ কি হতে পারবে?
এই যে মাঝেই মাঝেই পত্রিকা খুললে পড়তে হয়- বাবা-মাকে দেখছে না অমুকের সন্তান। কিংবা বৃদ্ধা আশ্রমে স্থান হয়েছে অনেকের। এদের মতো অতি মানব, ফেরেশতা রুপি মানুষগুলোরও হয়ত শেষ পরিণতি এমনই হয়।
এই যে আজকাল সবাই বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। কেন চায়? কারণ এরাও সবাই অতি মানব কিংবা ফেরেশতা হতে চায়। আর আমাদের পত্রিকাগুলোও এদেরকে হিরো বানায়!
দোষ আমার-আপনার সবারই আছে। আমরাই এদের হিরো বানাই। তবে মূল দোষটা এদেরই। কারণ, এদের যদি আপনি হুজুর হুজুর না করেন; হিরো হিসেবে স্বীকার না করেন; তাহলে শুনতে হবে- “কতো বড় সাহস! পায়ের নখের সমান হবার যোগ্য না, আবার বড় বড় কথা বলে!”
এখন যে আমরা সবাই সাহেদের মতো মানুষগুলোর সমালোচনা করছি। এইসব সাহেদ কিভাবে সমাজে তৈরি হয় জানেন? এইসব বড় বড় সরকারি কর্তাদের জন্যই। এরাই সাহেদের মতো মানুষদের সুযোগ দেয় টাকা খেয়ে কিংবা নানান সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে।
আজইতো পত্রিকায় পড়লাম কৃষিকাজ শিখতে সরকারি ৪০ কর্তা ইউরোপে যাচ্ছেন! বুঝেন অবস্থা! অবশ্য ধরা পড়ে গেলে এরাই আবার বিচার করে সাহেদের মতো মানুষদের!
অথচ আগে বিচার করা উচিত এদের মতো বিচারকদের। যারা নিজেদের মানুষ না- ফেরেশতা মনে করে। যারা মনে করে সমাজের আর সবাই তাদের “পায়ের নখেরও সমান হবার যোগ্যতা রাখে না!”
এদের মুখোশ যত দিন উন্মোচন করা না যাচ্ছে; তত দিন পর্যন্ত এই সমাজ এদের বিষে বিষাক্ত হতেই থাকবে।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)