রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আইটি ভারতের দখলে; প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে

ডিজিটালাইজেশনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে দেশি প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দেয়ার নির্দেশ রয়েছে সরকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চান দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশ ঘটুক। অথচ সেই নির্দেশ উপেক্ষিতই থাকছে। এখনো অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বিপুল অর্থ খরচ করে বিদেশ থেকে সফটওয়্যার আমদানি করছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সত্তে¡ও যুগের পর যুগ বিদেশি কোম্পানির সফটওয়্যার ব্যবহার করছে ব্যাংকসহ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান। দেশি সফটওয়্যার ব্যবহারে যেসব খাতে অনুৎসাহ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ব্যাংকিং। ব্যাংকগুলো ৪/৫ গুণ বেশি দাম দিয়ে ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে সফটওয়্যার কিনছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তার একটি সিন্ডিকেট নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ভারতীয় সফটওয়্যার কোম্পানির পক্ষে কাজ করছে। এতে বছরে শুধু ব্যাংক খাত থেকেই ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিদেশে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাতসহ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের তথ্য চলে যাচ্ছে ভারতের কাছে, যা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এছাড়া কর্মসংস্থানও যাচ্ছে ভারতের দখলে।

দেশে এখন ৬২টি ব্যাংকের মধ্যে ৬০ শতাংশেই বিদেশি কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়। দেশি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয় বাকি ৪০ শতাংশ ব্যাংকে। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকসহ সরকারি কেনাকাটায় দেশি সফটওয়্যারের ব্যবহারকে আরো বেশি প্রাধান্য দেয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। গত বছরের ১৭ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে যুগ্ম সচিব মো. রিজওয়ানুল হুদা স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দেশীয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়, যা পরবর্তীতে আবার গত বছরের ১০ জুলাই রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাস্তবায়নে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকসহ সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশনাটি দেয়া হয়। এই নির্দেশনা প্রতিপালনের মাধ্যমে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হয়। অথচ এই নির্দেশের পর এক বছর অতিবাহিত হলেও কৃষি ব্যাংক ছাড়া কেউই এই নির্দেশ এখনো বাস্তবায়ন করেনি। এটিকে গোড়ায় গলদ বলছেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই। কারণ নির্দেশনা প্রদানকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি খাতও ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানের দখলে।

যদিও এর আগে বিভিন্ন সময়ে চলমান বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছরেই দেশের সব ব্যাংকে ‘কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার’ (সিবিএস) ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছিলেন দেশের তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার থাকা সত্তে¡ও রাষ্ট্রায়ত্ত একাধিক ব্যাংক কেন বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে? বিদেশি সফটওয়্যারের ওপর কর বাড়ানোসহ সরকারের সহায়তা পেলে বাংলাদেশে তৈরি সফটওয়্যার স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি বিশ্ব জয় করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, যা বর্তমান করোনাকালীন সঙ্কটে থাকা আর্থিক খাতকে কিছুটা হলেও সক্ষমতা বাড়াবে। এছাড়া বাড়বে কর্মসংস্থান।

সূত্র মতে, বাংলাদেশে আইটি সেক্টর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধে এই সেক্টরকে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকার নিজেও আইটি সেক্টর নিয়ে আশাবাদী। এই সেক্টরের মাধ্যমে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে বলে বলা হচ্ছে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের আগেই দেশ পুরোপুরি আইটিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে উঠবে। সরকারের ভিশন ’২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বছরে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের টার্গেট নিয়েছে। আর ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে আইটি সেক্টরের বয়স খুব বেশিদিন নয়। এরপরও তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ আইটি সেক্টরে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। দেশের তরুণ-তরুণীরা আইটি সেক্টরে বড় অবদান রেখে যাচ্ছে। তারা নিজ উদ্যোগেই আউটসোর্সিং করে যাচ্ছে। এতে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। গত ১১ বছরে আইটি সেক্টরে বড় রকমের অগ্রগতি অর্জন করেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আইটি সেক্টর দিন দিন উন্নত হচ্ছে। দেশে গড়ে উঠেছে কয়েকশ’ সফটওয়্যার শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব সফটওয়্যার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার সরাসরি সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই বাংলাদেশ আইটি শিল্পে দিনকে দিন উন্নতি করছে। বর্তমানে প্রতি বছর বিদেশে সফটওয়্যার শিল্প থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত রফতানি পোশাক শিল্প খাতকে ছাড়িয়ে যাবে বলে বিভিন্ন সময়ে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। সে পথে অনেকটাই অগ্রসরমান দেশের আইটি খাত।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ২৫ কোটি টাকার যে সফটওয়্যার আমরা দু’টি মন্ত্রণালয়ে ব্যবহার করব, তাতে ১০০ কোটি টাকার ওপরে সরকারের সাশ্রয় হবে। যদি বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হতো তাহলে হয়তো প্রায় ১০০ কোটি টাকা লাগত আর মাসে মাসে বা বছরে বছরে লাইসেন্স ফি তো আছেই। সরকার থেকে দেশি কোম্পানিকে সহায়তা করছি, যা অব্যাহত থাকবে। সরকারি-বেসরকারি খাতের কোলাবরেশন যদি আরো জোরদার হয়, তাহলে আমাদের সফটওয়্যার খাতের কাজ দেশি কোম্পানিকে দিয়েই পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু সরকারের নানা উদ্যোগের পরও দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালীসহ অন্য ব্যাংকগুলো এখনও চলছে বিদেশি সফটওয়্যারের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সহযোগী অধ্যাপক ও ব্যাংক খাতের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান আলম ইনকিলাবকে বলেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো সুযোগ আছে। ব্যাংকগুলোর আইটি খাতে ব্যবহার করা সম্ভবও। কিন্তু দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সেভাবে সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে না। যদিও ইতোমধ্যে দেশে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে বিনিয়োগ সেভাবে বাড়ছে না। কারণ তারা বড় পরিসরে সেভাবে সুযোগ পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে তিনি সবাইকে মিলে একটি ইউনিটক সফটওয়্যার তৈরির আহ্বান জানান। এ ক্ষেত্রে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এগিয়ে আসার কথা বলেন। এটা করতে পারলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য কমবে। একই সঙ্গে দেশীয় যেসব প্রতিষ্ঠান একবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট হয়েছে তারা তা ছাড়তে পারছে না। তারা মনে করছে, এতে ঝুঁকিতে পড়তে পারে ব্যাংক। আর এ কারণে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সুযোগ পাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ