শেখ হাসিনা একা। এটা অনেকেই মানতে চান না। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলি, সবাইকে ডাকেন না কেন। আপনিতো ওই চেয়ারে আছেনই। আমাদের না হয় এক
কাপ চা খাওয়াবেন। রাজধানীর নগর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেয়া সাক্ষাতকারে এমনটাই বলেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
তিনি বলেন, এই দেশটাকে পরিবর্তন করতে হবে। সবাইকে ভালো থাকতে হবে। একলা কখনো ভালো থাকা যায় না। আমাদের স্বার্থপরতা পরিহার করতে হবে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কিংবদন্তি যোদ্ধা। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার। জাতির যেসব সূর্যসন্তান আজকের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন তাদের অন্যতম তিনি। ১৯৪১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম নেয়া ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকায় গড়ে তুলেছেন নগর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, করোনা কিছু না। এটা হচ্ছে পুঁজিবাদের কাউন্টার। পুঁজিবাদ যেভাবে বাড়ছে সেটা কেউ ঠেকাতে পারছিল না। আজকে আমাদের উল্টোভাবে চিন্তা করতে হবে। যে আমরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম। তবে এটার ফল আমরা পাই কিনা সেটা দেখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেখ সাহেবের দল আমি কখনো করিনি। ওনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ঝগড়ার আবার ভালোবাসার। ওনার সময় ওনি কৃষিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই যে কিছুদিন আগে একটা বাজেট হলো। এই বাজেট তো হওয়ার কথা ছিল করোনাকে ঘিরে। সেটা হয়নি। দুই কোটি মানুষকে তো খাবার দিতে হবে ছয় মাসের জন্য। কিন্তু সেটার কথাই ভাবা হচ্ছে না। কিছুদিন আগে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করবেন। কিন্তু এটা না করে দরকার কৃষিতে বিনিয়োগ করা। কৃষিতে যদি বিনিয়োগ করা হতো তাহলে ছয় মাস পরে সোনার ফসল আমাদের ঘরে আসতো।
আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে যতো শিক্ষিত বেকার আছে তাদের কথা আমরা কখনো চিন্তা করছি না। তাদের আমরা কেন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে পারছি না। আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে নতুন বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশের স্বপ্নটাই আমি দেখাতে চাই। এই স্বপ্ন দেখাতে হলে আমি একলা কাজ করে পারবো না। এর জন্য সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। আমি এই স্বপ্নের গল্প লিখতে চাই। শুনতে চাই আগামীর প্রজন্মের কাছ থেকে, তারা কীভাবে এই দেশটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কীভাবে দেশটাকে বাঁচাতে চায়।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সাধারণ মুসলিম পরিবার থেকে এসেছি। আমাদের সময় এই দেশে বেশি সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল না। আমাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ছিল। আমার বাপ দাদাদের মধ্যে যারা একটু লেখাপড়া শিখেছে তারা কিছু করার চেষ্টা করেছে। তবে এই পরিবর্তনটা বেশি যুগের না। যখন এ কে ফজলুল হক লেখাপড়ার দিকে এলেন তখন থেকে মুসলমানরা পড়ালেখার প্রতি ঝুঁকতে শুরু করলো। আমাদের রাজনীতি শিখিয়েছেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যে, মওলানা ভাসানীর মতো আমাদের জাফর, মেননদের সেই ধৈর্য ছিল না। কেউ তার রাজনীতিও বুঝলো না। এর ফলে আমরা রাজনীতিতে বেশি সুযোগ সুবিধা করতে পারলাম না। মাঝখান দিয়ে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে গেলেন। হি ডিজার্ভ ইট।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমি তো এ দেশে বড় হয়েছি। এই দেশে রাজনীতি করেছি। আমাদের সময় আমরা অনেক কিছু করেছি। ড. মাহফুজুল্লাহ কিছু লিখে গেছেন। আমি সব সময় বলে আসছি, আমরা যদি দেশটাকে পরিবর্তন না করতে পারি তাহলে মানুষ পাবেটা কি। এই যে আজকে মানুষ সেবা পাচ্ছে না, এটাই আমার ব্যর্থতা। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা তারা দেশে সত্যিকারের রাজনীতি আনতে পারেনি।
নিজের তরুণ সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত ছেলে হিসেবে আমার কিছু মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল। আমার পছন্দ ছিল আয়েশি জীবন। আমার বিলাতের জীবন ছিল বিলাসি। প্রিন্স ফিলিপের যে টেইলার্স স্যুট বানাতো আমার স্যুটও সেই বানাতো। এটা ছিল আমার ছেলে মানুষি। এখন এগুলো মনে হলে খুব হাসি পায়। আমি কখনো তৈরি পোশাক পরিনি। আমার কোনো তৈরি শার্ট নেই। আমি কঠিন পরিশ্রম করতে পারতাম। পাকিস্তান আমলে সেনা সরকারের সময় আজম খান যখন ঢাকা মেডিকেলে এসেছিলেন আমি তাকে আটকে দিয়েছিলাম। আমি সব সময় সত্যের পথে ছিলাম। এখনো আছি। আমি যেটা বিশ্বাস করতাম সেটাই বলতাম আর সেটাই করতাম। বিলাতে কঠিন পরিশ্রম করে কাজ শিখেছি। বিলেতের মানুষের একটা বড় গুণ হচ্ছে তারা যেখানেই থাকুক চিকিৎসা পায়। লন্ডন শহরে মানুষটা যে চিকিৎসা পেতো ওয়েলস শহরের মানুষও সেই চিকিৎসাই পেতো। বিষয়টা আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগতো। তখন আমি ঠিক করলাম এই প্রথাটাই আমার দেশে নিয়ে যেতে হবে। তখন তো পাকিস্তান ছিল। যদিও আমরা ওই সময়ও পাকিস্তান ভাঙার স্বপ্ন দেখিনি। তখন একটাই স্বপ্ন ছিল আমি পাকিস্তানের এক নম্বর ডাক্তার হবো। সবাই আমাকে চিনবে এবং জানবে। এটা ছিল আমার পিওর মধ্যবিত্ত চিন্তা ভাবনা।
তিনি বলেন, আমাদের ব্যর্থতার জায়গাটা হচ্ছে, কাজগুলো আমরা এতো সহজে দেখতে পাই কিন্তু করতে পারি না। করোনার শুরুর দিকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে টকশোতে গিয়ে বলেছিলাম, করোনার সময় দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে অক্সিজেন নিয়ে। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনেনি। এটা কাউকে বুঝাতে পারিনি। আজকে জ্বর হলেই কেউ হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে না। কোনো পরীক্ষা করা যাবে না। এটা কেমন কথা। শুধু বলে আইসিইউ বেড খালি নাই। আমি তেজগাঁওয়ে হাসপাতাল করতে চাইলাম। কিন্তু আমাকে দেয়া হলো না। তখন খুব কষ্ট পেয়েছি। সরকারের যারা লুটপাট করে সরকার তাদেরই সুযোগ করে দেয়। সামনে আমি সমূহ বিপদ দেখছি। এই করোনা হঠাৎ করে থামবে না। এটা ছড়িয়ে পড়বে বিবিধ কারণে। তবে এখনো আমি মনে করি ‘উই সেল ওভার কাম’। তার জন্য আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বড় একাকী। এটা অনেকেই রিয়ালাইজ করেন না। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলি সবাইকে ডাকেন না কেন। আপনি তো ওই চেয়ারে আছেনই। আমাদের না হয় এক কাপ চা খাওয়াইয়েন।
সবাইকে একসঙ্গে এই দেশকে বাঁচানোর আহ্বান জানিয়ে রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, তুমি না বাঁচলে তো আমি বাঁচবো না। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। মানুষ একাকী কোনো কিছুই করতে পারে না। আমি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরই বলেছি যে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবো না। হাভার্ড আমাকে অপারেশন করতে চেয়েছে। আমি তাদের বলেছিলাম তোমরা কি সব ফ্রিতে করে দিবা? আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশেও ভালো চিকিৎসা আছে। আমি তো জীবন মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে এসেছি। আমার হাসপাতালের ডাক্তারদের উছিলাই তো আমি বেঁচে আছি। দেশের মানুষের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। অন্যের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। এই দেশ না থাকলে, দেশের মানুষ না থাকলে, আমি বেঁচে থেকে লাভ কি। এই দেশের মানুষের হাসি যদি আমি না দেখতে পাই তাহলে তো আমার জীবন অন্ধকার।