লিখেছেন সোহাম দাস
২০১২ সালের সাংহাই মাস্টার্স শুরুর ঠিক আগের ঘটনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক উগ্র সমর্থকের পোস্টে নড়েচড়ে বসে ক্রীড়া দুনিয়া। ব্লু ক্যাট পলিথেইজম ফাউন্ডার ০৭ নামধারী ব্লগারটি তার পোস্টে লিখেছিল- “টেনিসের স্বার্থে ৬ই অক্টোবর আমি রজার ফেডেরারকে খুন করতে চলেছি।” হাড় হিম করা এই হুমকির সঙ্গে একটি ছবিও পোস্ট করেছিল সেই ব্লগার। সেখানে দেখা যাচ্ছে, টেনিস কোর্টে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন মুণ্ডহীন রজার, তার সামনে কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক জল্লাদ।
এই ঘটনা জনসমক্ষে আসতেই তড়িঘড়ি তদন্তে নামে সাংহাই পুলিশ ও প্রতিযোগিতা আয়োজকরা। টুর্নামেন্টে প্রতিটি খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে আশ্বাস দেয় তারা। সাংহাইতে রীতিমতো দেহরক্ষীদের ঘেরাটোপে অনুশীলন করতেন রজার। পরে অবশ্য এমন কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয় খোদ ব্লগারই। সে জানায়, ফেডেরারের কিছু অন্ধ ভক্তদের সঙ্গে তর্ক করে তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল বলে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।
সাংহাই মাস্টার্সে ফেডেরার তখনো জয়ী না হলেও এই শহরের কি ঝং স্টেডিয়ামে তার রেকর্ড ছিল ঈর্ষণীয়। এর আগে এটিপি টেনিস মাস্টার্স কাপে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে পরপর দু’বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি। ২০০৯ থেকে শুরু হয়েছিল সাংহাই মাস্টার্স। ২০১০-এর ফাইনালে অ্যান্ডি মারের কাছে হেরে রানার্স আপ হওয়া ছাড়া বলার মতো পারফরম্যান্স ছিল না টেনিসের সর্বকালের সেরা এই খেলোয়াড়টির। ২০১১ সালের মাস্টার্সে খেলেননি তিনি। ফলে পয়মন্ত স্টেডিয়ামে ভালো খেলবার জন্য মুখিয়ে ছিলেন ‘রাজা রজার’। তার উপর, সে বছরই সকলকে অবাক করে উইম্বলডন জিতে আবার এক নম্বরে ফিরে এসেছিলেন তিনি।
সব মিলিয়ে বেশ উত্তেজক পরিস্থিতিতে এমন একটি অদ্ভুত ঘটনা তাকে তো বটেই, বিচলিত করেছিল সমগ্র টেনিস দুনিয়াকেই। আর তখনই বার বার উঠে এসেছিল উনিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া বিশ্বক্রীড়ার ইতিহাসের অন্যতম রোমহর্ষক ঘটনাটির প্রসঙ্গ।
১৯৯৩ সালের ৩০শে এপ্রিল। জার্মানির হ্যামবার্গ শহরে চলছে সিটিজেনশিপ কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। বুলগেরিয়ার মাগদালিনা মালিভার মুখোমুখি নারী টেনিসের এক নম্বর খেলোয়াড় যুগোস্লাভিয়ার মনিকা সেলেস। খেলোয়াড় হিসেবে মনিকা তখন অপ্রতিরোধ্য। তখন সাড়ে উনিশ বছরও হয়নি, তার মধ্যেই জিতে ফেলেছেন আটটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। নারী টেনিসে সর্বকালের সেরা বলে যাদের নাম বারবার উঠে আসে, সেই মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা বা স্টেফি গ্রাফকে তখন নিতান্ত সাধারণ মনে হতো মনিকার আক্রমণাত্মক টেনিসের কাছে।
কিন্তু ভাগ্যবিধাতার হয়তো অন্যরকম ভাবনা ছিল। মাগদালিনার বিরুদ্ধে এগিয়ে ছিলেন মনিকা। সেটের মাঝে বিরতিতে নিজের চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ দর্শকের আসন থেকে ছুটে এসে তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয় এক দর্শক। নাম গুন্টার পার্শে। শারীরিক আঘাত তেমন গুরুতর না হলেও মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে পরবর্তী দুই বছর আর পেশাদার টেনিসে ফিরতে পারেননি এই এক নম্বর খেলোয়াড়।
শুধু আটটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতাই নয়, মনিকার তৎকালীন সার্বিক পরিসংখ্যান দেখলে যেকোনো বড় খেলোয়াড়ই লজ্জায় পড়ে যাবে। এমনিতে বাঁহাতি মনিকা ফোরহ্যান্ডও মারতেন দু’হাতে। ১৯৯০ সালের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেছিলেন তিনি। মৌসুমের শুরুটা মন্থর গতিতে হলেও টানা ৩৬টি ম্যাচ জেতার নজিরবিহীন রেকর্ড গড়লেন তিনি। টানা ৬টা টুর্নামেন্ট জিতলেন। মিয়ামিতে লিপ্টন প্লেয়ার্স চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা থেকে শুরু, সেই দৌড় থামল ১৯৯০-এর ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে।
তার বয়স তখন মাত্র সাড়ে ষোল। আগামী কয়েক বছরে স্টেফি গ্রাফের সঙ্গে যে কিংবদন্তিতুল্য চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হবে মনিকার, এমনকি যার খেসারত তাকে দিতে হল পিঠে ছুরির আঘাত পেয়ে, সেই লড়াইয়ের শুরু এই ফ্রেঞ্চ ওপেন ফাইনাল থেকেই। স্টেফি তখন বিশ্বের এক নম্বর, তাকে গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে স্ট্রেট সেটে হারিয়ে দিলেন মনিকা। ফলাফল মনিকার পক্ষে ৭-৬ (৮-৬), ৬-৪। ১৯৮৯ ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনালে স্টেফির কাছে হারার মধুর প্রতিশোধও নিয়ে নিলেন তিনি।
পরের বছর শুরুই করলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে। চেক প্রজাতন্ত্রের জানা নোভোত্নাকে হারিয়ে। পরপর ফ্রেঞ্চ ওপেন ও ইউএস ওপেনও জিতলেন। ইউএস ওপেনের ফাইনালে স্ট্রেট সেটে হারিয়েছিলেন মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাকে (৭-৬ (৭-১), ৬-১)। সঙ্গে বছরের শেষে ডব্লিউ টি এ (উইমেন’স টেনিস অ্যাসোসিয়েশন) ট্যুর ফাইনালও জিতলেন। হপম্যান কাপে জেতালেন যুগোস্লাভিয়াকে। মিক্সড ডাবলসে তার সঙ্গী ছিলেন গোরান পারপিচ।
১৯৯২ সালে আবারও অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, ইউএস ওপেনে জয়ীর শিরোপা উঠল তার মাথায়। ফ্রেঞ্চ ওপেনে আবারও হারালেন স্টেফিকে। কিন্তু সেই বদলা স্টেফি নিলেন উইম্বলডনে। প্রথমবারের মতো উইম্বলডন ফাইনালে উঠে একপেশে ম্যাচে ২-৬, ১-৬-এর স্ট্রেট সেটে হেরে গেলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে। কিন্তু আবার ১৯৯৩ সালের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যামটি মনিকা দখল করলেন স্টেফিকে হারিয়েই। প্রথম সেটটি খোয়ানোর পর দ্বিতীয় ও নির্ণায়ক সেটে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের পর তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান ওপেনটি জিতে নিলেন মনিকা।
১৯৮৯ সালে পেশাদার হয়েছিলেন মনিকা। তারপর থেকে ১৯৯৩ সালে ছুরিকাহত হওয়ার আগে পর্যন্ত চার বছরে তার জেতা-হারার পরিসংখ্যান ছিল ২৩১-২৫। ১৯৯১ সালের জানুয়ারি থেকে ধরলে পরিসংখ্যানটা আরো অবিশ্বাস্য। গ্র্যান্ড স্ল্যাম (অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইম্বলডন ও ইউএস ওপেন) ও অন্যান্য প্রথম সারির প্রতিযোগিতা মিলিয়ে যে ৩৪টি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি, তার মধ্যে ৩৩টি প্রতিযোগিতায় ফাইনালে উঠেছিলেন। জিতেছিলেন মোট ২২টি শিরোপা। ১৭১টি ম্যাচ খেলে হেরেছিলেন মাত্র ১২টি ম্যাচে। এর মধ্যে গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টগুলিতে ৫৫টি ম্যাচের মধ্যে হেরেছিলেন শুধু ’৯২ উইম্বলডন ফাইনালে।
যে স্টেফি পেশাদার টেনিসে তার প্রথম দু’বছরে (১৯৮৭-১৯৮৯) জিতে নিয়েছিলেন আটটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম, তার মধ্যে ১৯৮৮-তে ক্যালেন্ডার গ্র্যান্ড স্ল্যাম (একই বছরে চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার নজির), মনিকার আধিপত্যের বছরগুলিতে তিনি জিততে পেরেছিলেন মাত্র তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম (অস্ট্রেলিয়ান ওপেন-১৯৯০, উইম্বলডন-১৯৯১ ও ১৯৯২)।
স্টেফির এহেন ‘অপমান’ সইতে পারেনি গুন্টার পার্শে। স্টেফির খেলার বড় ভক্ত ছিল গুন্টার, তাই মনিকার কাছে এক নম্বর স্থান খোয়ানোটা মেনে নিতে পারেনি সে। সে সময় কর্মহীন হয়ে পড়ায় মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত ছিল আটত্রিশ বছর বয়সী গুন্টার। একটি নয় ইঞ্চি লম্বা মাংস কাটার ছুরি নিয়ে মনিকার পিঠে বসিয়ে দেয় সে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিল সুষুম্নাকাণ্ড ও ফুসফুস। অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে যান মনিকা। নিজের আত্মজীবনী ‘গেটিং আ গ্রিপ: অন মাই বডি, মাই মাইন্ড, মাই সেলফ’-এ এই হাড়-হিম করা অভিজ্ঞতার বিবরণ লিখতে গিয়ে তিনি বলেছেন-
“আঘাত লাগতেই সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে মাথা ঘোরাতে দেখি একটা লোক, মাথায় বেসবল ক্যাপ, মুখে ব্যাঙ্গের হাসি। হাত দুটো মাথার উপর তুলে রেখেছে, একটা হাতে ধরা রয়েছে লম্বা ছুরি। আবার আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল সে। কী যে ঘটছে, কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না।”
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কোর্টেই বসে পড়েন আহত মনিকা। তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসেন কোর্ট অফিসিয়ালরা। অন্যান্য দর্শক ও নিরাপত্তারক্ষীরা ততক্ষণে পাকড়াও করেছে গুন্টারকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হ্যামবার্গের ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সামান্য কয়েকটি সেলাই ছাড়া তেমন বড় চিকিৎসার দরকার পড়েনি। দুদিন পরেই তাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যে মানসিক আঘাত তিনি পেয়েছিলেন, তা পুরোপুরি আর সামলে উঠতে পারেননি।
পরবর্তী দুই বছর খেলা থেকে সম্পূর্ণ বাইরে ছিলেন। রিহ্যাবে দশ মিনিট হাঁটলেও তা হতো প্রায় অত্যাচারের সামিল। পিঠে একটা ব্যথা হতো। কিন্তু ক্যাট স্ক্যান বা এমআরআই স্ক্যান করে ব্যথার উৎস নির্ণয় করা যায়নি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একবারে অনেক বেশি পরিমাণ খাবার খাওয়ার প্রবণতা বা বিঞ্জ ইটিং ডিসঅর্ডার।
আঠাশ মাস পর আবার কোর্টে ফিরে কানাডিয়ান ওপেন জেতেন। ইউএস ওপেনের ফাইনালেও পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু হার মানতে হয় সেই স্টেফির কাছেই। স্টেফি তখন সর্ব অর্থেই সর্বকালের সেরা হয়ে গিয়েছেন। ১৯৯৬ এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে আঙ্কে হুবেরকে হারিয়ে কেরিয়ারের নবম ও শেষতম গ্র্যান্ড স্ল্যামটি জেতেন তিনি। এরপর গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে তিনি উঠতে পেরেছিলেন মাত্র দুবার। সে বছরেরই ইউএস ওপেন ফাইনাল, যেখানে আবারও স্টেফির কাছে হার মানতে হয় তাকে এবং ১৯৯৮-এর ফ্রেঞ্চ ওপেন ফাইনাল, যেখানে হারলেন স্প্যানিশ তারকা আরানৎজা স্যাঞ্চেজ ভিসারিওর কাছে।
ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলা আর সম্ভব হয়নি মনিকার পক্ষে। তার শেষ উল্লেখযোগ্য অর্জন বলতে ২০০০ সিডনি অলিম্পিক্সে সিঙ্গলসে ব্রোঞ্জ পদক জয়। নানাবিধ চোটের কারণে ২০০৩ সালে মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সেই অবসর নিয়ে নেন তিনি।
২০০৪ সালে ‘শিকাগো ট্রিবিউন’ সংবাদপত্রের কলামনিস্ট মেলিসা আইজ্যাকসনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মনিকা আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “আমি অন্তত কিছুতেই বলতে পারব না যে, যা ঘটে তা ঘটার ছিল বলেই ঘটে। আমি যখন পেছন ফিরে দেখি আমার অতীতকে, তখন আমার নিশ্চিতভাবেই মনে হয়, সেদিন এরকম আক্রমণ না হলে আরও সাফল্য পেতে পারতাম আমি। আজীবন এই ভাবনাটা আমাকে ভাবাবে যে, ইতিহাসে শুধু আমার সঙ্গেই কেন এমন হলো?”
স্টেফি ছিলেন জার্মান, আর আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছিল জার্মানির হ্যামবার্গেই। অন্যদিকে মনিকার দেশ যুগোস্লাভিয়া তখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত। ফলে প্রথমে ভাবা হয়েছিল, হামলার পেছনে হয়ত কোনো সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু পরে গুন্টার পার্শেকে আদালতে তোলা হলে সে স্বীকার করে, এই আক্রমণের পরিকল্পনা সে অনেকদিন ধরেই করেছে শুধুমাত্র তার প্রিয় খেলোয়াড় স্টেফি গ্রাফ যাতে আবার এক নম্বর আসনটা ফিরে পান সেই উদ্দেশ্যে। কিন্তু মনিকাকে হত্যা করার কোনও মতলব তার ছিল না।
জেরায় তার কাছ থেকে ইতালি যাওয়ার একটি প্লেনের টিকিট উদ্ধার হয়, সঙ্গে এক হাজার ডয়েশমার্ক। এক সপ্তাহ বাদেই ইতালিয়ান ওপেনে খেলতে যাওয়ার কথা ছিল মনিকার। অর্থাৎ, হ্যামবার্গে উদ্দেশ্য সফল না হলে রোমে পাড়ি দেওয়ার বন্দোবস্তও করে রেখেছিল গুন্টার, প্রিয় খেলোয়াড়কে প্রথম স্থানে ফেরাতে এতটাই মরিয়া ছিল সে।
গুন্টারের স্বীকারোক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান সত্ত্বেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ‘খুনের চেষ্টা’-র অভিযোগ খারিজ করে দেন বিচারপতি। গুন্টারের কৌঁসুলি যুক্তি দেন, তার মক্কেল মানসিকভাবে স্থিত নয়, সে এক কল্পনার জগতে বাস করে এবং তাই স্টেফির প্রতি তার টান এক অসুস্থ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা থেকে জন্ম নিয়েছে মনিকার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ। পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরাও বলেছিলেন, গুন্টার ব্যক্তিত্ব সঙ্কটে ভুগত। মানসিক অবস্থার কথা ভেবেই গুন্টারকে শুধুমাত্র ‘আঘাতের চেষ্টা’-র অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। শাস্তিও হয়েছিল সামান্যই।
স্বভাবতই, এতে খুশি হননি মনিকা। সেই যে ২রা মে ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল ছেড়ে ফ্লোরিডায় নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন, আর কোনোদিন জার্মানিতে ফেরেননি। শুনানি চলাকালীনও অনুপস্থিত থেকেছেন। আক্রমণের ট্রমা ঘিরে ধরেছিল তাকে। পরে বলেছিলেন- “ওরা কীভাবেই বা আশা করে যে আমি আবার হ্যামবার্গে ফিরব! সেই তো আদালতে ওই আক্রমণকারীর দিকে পিঠ রেখে আমায় বসতে হবে। আমার পক্ষে সেটা ভাবাই খুব কষ্টকর ছিল।”
ঘটনার দেড় বছর পরে অন্য একজন বিচারপতির তত্ত্বাবধানে আবার যখন নতুন করে শুনানি শুরু হয়, তখন তিনিও এই রায়ই বহাল রেখে দেন। তিনি আবার মামলা চলাকালীন আদালতে মনিকার অনুপস্থিতির দিকে আঙুল তুলেছিলেন। বিচারকের কথায় সাংবাদিক সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মনিকা। আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি কটাক্ষ করেছিলেন মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাও। এই সিদ্ধান্তকে ‘অদ্ভুত’ এবং ‘জার্মান-পক্ষপাতদুষ্ট’ বলেছিলেন তিনি। সঙ্গে যোগ করেছিলেন- “আমার মতে, এটা কোনও শাস্তিই নয়। ‘ও আর এরকম করবে না তাই আমি ওকে ছেড়ে দিচ্ছি যাতে বেরিয়ে আবার কাউকে খুন করতে পারে’- বিচারকের রায়টা ঠিক এমনই শোনাচ্ছে। এটাই যদি মনিকাকে জেতাতে কেউ স্টেফিকে আক্রমণ করত, তাহলে ঠিক ওরা সঠিক পদক্ষেপ নিত।”
দুঃখজনকভাবে, গুন্টারের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছিল। সিটিজেনশিপ কাপে স্টেফি ফাইনালে আরানৎজার কাছে হেরে যান। মনিকার মানসিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে আরানৎজার সঙ্গে তাকেও যুগ্মজয়ী ঘোষণা করা হয়। সেই বছরের পরবর্তী তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যামই কুক্ষিগত করেন স্টেফি। এমনকি পরের বছরের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও। মনিকা আক্রান্ত হলেন ৩০শে মে। আর স্টেফি ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতলেন ৬ই জুন। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই এক নম্বরে ফিরে এলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে অবসর নেওয়ার আগে অবধি বাইশটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের এগারোটিই তিনি জিতেছিলেন ৩০শে এপ্রিল-পরবর্তী সময়ে। ওই সময়ে মোট তেরোবার গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে উঠে হেরেছিলেন মাত্র দুবার। ১৯৯৪ ইউএস ওপেনে আরানৎজার কাছে, এবং ১৯৯৯ উইম্বলডনে মার্কিন খেলোয়াড় লিন্ডসে ড্যাভেনপোর্টের কাছে। ওটাই ছিল তার শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল।
শুধু মেয়েদের মধ্যেই নয়, পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সর্বকালের সেরার সেরা খেলোয়াড় বলতে যার নাম করা হয়, তিনি অস্ট্রেলিয়ার মার্গারেট কোর্ট। পদবীতে কোর্ট, সমগ্র ক্যারিয়ারেও রাজ করেছেন কোর্ট জুড়ে। গ্র্যান্ড স্ল্যামে চব্বিশটি সিঙ্গেলস, উনিশটি ডাবলস ও একুশটি মিক্সড ডাবলস খেতাব তার ঝুলিতে।
নব্বইয়ের শুরুতে তখনো কুড়ি না ছোঁয়া মনিকার উত্থানে মার্গারেটের এমন অতিমানবিক রেকর্ডও বিপন্ন মনে হয়েছিল বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস, যে মেয়েটাকে সহ-খেলোয়াড়রা সকলেই তার ইস্পাতকঠিন মানসিকতার জন্য সমীহ করতেন, সেই মেয়েটাই কিনা টানা আড়াই বছর সার্কিটের বাইরে চলে গেলেন। ফিরে এসেও জিততে পারলেন মাত্র একটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ততদিনে রেকর্ডবইয়ে নিজের জায়গা পাকা করে নিলেন। একজন খেলোয়াড়ের কাছে এর চেয়ে যন্ত্রণা আর কী-ই বা হতে পারে?
স্টেফি পরবর্তীকালে এই ঘটনা নিয়ে তেমন মুখ খোলেননি। তার উজ্জ্বল, বর্ণময় ক্যারিয়ারে এই একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা সামান্য হলেও নিশ্চয় কণ্টকসম মনে হয় তার কাছে। অপরাধ না করেও শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিজের কাছে অপরাধী হতে হয়। মনিকাকে হাসপাতালে দেখে এসে বলেছিলেন- “আমার নিজের আরও বেশি খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, এটা জার্মানিতে, আমার নিজের দেশে ঘটল বলে। যে জার্মান লোকটা এ কাজ করল, সে আবার আমার ভক্ত।”
মনিকার এই ঘটনার জেরে আরও আঁটসাঁট করা হয় টেনিস কোর্টের নিরাপত্তা। এখন একজন ভক্তকে সামান্য অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যেও হয়তো প্রিয় খেলোয়াড়ের কাছে পৌঁছনোর অনুমতি দেওয়া হয় না। তাও অনেকসময়ই নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনির ফাঁক গলে দর্শকাসন থেকে খেলার বেষ্টনীতে ঢুকে পড়েন ভক্তরা। কারও উদ্দেশ্য হয়ত থাকে প্রিয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে ছবি তোলার, আবার অনেকসময় উদ্দেশ্য থাকে কোনো বার্তা পৌঁছে দেওয়ার।
২০১৩ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেন ফাইনালে রাফায়েল নাদাল ও ডেভিড ফেরারের মধ্যে খেলা চলছে। হঠাৎই সমকামিতা-বিরোধী বার্তা দিতে হাতে মশাল নিয়ে কোর্টে ঢুকে আসে এক মুখোশধারী। নিরাপত্তারক্ষীরা তৎক্ষণাৎ তাকে ও তারই দলের আরো একজনকে আটক করে বাইরে নিয়ে গেলেও প্রজ্জ্বলন্ত মশালটি বহুক্ষণ কোর্টের উপরেই পড়ে ছিল। যেকোনো খেলাতেই ভক্ত অপরিহার্য অঙ্গ। তাদের আবেগ, সমর্থন ছাড়া খেলার মেজাজ বড়ই নিষ্প্রাণ। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা কেবল খেলার সৌন্দর্যকেই নষ্ট করে না, অনেকসময়ই তা খেলোয়াড়ি সৌহার্দ্যেরও ক্ষতি করে।
মেলিসা আইজ্যাকসনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মনিকা আরও বলেছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে সবটাই মেনে নিয়েছেন। কী হতে পারত, বা, কী হতে পারত না, একটা সময়ের পর থেকে এসব নিয়ে আর ভাবতে ইচ্ছা করত না তার। আত্মজীবনীতে তার লেখার মধ্যেও একই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। নিয়তি যেন বড়ই নিষ্ঠুর খেলা খেলেছিল মনিকার সঙ্গে। আক্রমণের ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই বাবা কারোলির ক্যান্সার ধরা পড়া, যার হাতেই টেনিসে হাতেখড়ি হয়েছিল মনিকার, আক্রমণকারীর বেকসুর খালাস, পাঁচ বছর পর বাবার মৃত্যু, সর্বোপরি ধারাবাহিকতার পতন- খেলার ইতিহাসে দুর্ভাগ্যবান কিংবদন্তি বলে যদি কোনো তালিকা কখনো প্রস্তুত হয়, সেই তালিকায় সম্ভবত উপরের দিকেই জ্বলজ্বল করবে একটা নাম, মনিকা সেলেস।