লিখেছেন ড: মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী, মন্ট্রিয়ল থেকে
করোনাকালিন এই ভয়ংকর সময়ে একটা কথা প্রায়ই উচ্চারিত হচ্ছে- ‘হার্ড ইমিউনিটি’ ( Herd Immunity)। ‘হার্ড’ (Herd) মানে ‘পাল’ তাই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলতে মুলত কোন নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে একটি এলাকা বা দেশের জনগনের সামগ্রিক ‘গন-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা’ কে বোঝায়। সহজ ভাষায়, ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলতে এটা বোঝায় যে কোন জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোক (৬০-৯০%) যখন কোন নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠে তখন অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীও ‘পরোক্ষভাবে’ ঐ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। একটি কার্যকর ’ভ্যাক্সিন’ ব্যবহার করে অথবা ‘প্রাকৃতিক উপায়ে’ রোগাক্রান্ত হয়ে সুস্থতা অর্জনের মাধ্যমে কোন জনগোষ্ঠীর এই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হয়। ‘হার্ড ইমিউনিটি’ খুবই গুরুত্বপূর্ন কারন কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগকে সম্পুর্নরূপে নির্মুল করার এটাই একমাত্র উপায়। ‘ভ্যাক্সিন-ভিত্তিক’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের মাধ্যমে বিশ্ব হতে গুটি বসন্ত নির্মুল হয়েছে; যক্ষা এবং পোলিওর মত রোগও এখন নির্মুলের পথে। কোভিড-১৯ রোগটি নির্মুলের জন্যও একটা নিরাপদ ‘ভ্যাক্সিন-ভিত্তিক’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জন চরম আকাংক্ষিত।
হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের মুলনীতি ও প্রক্রিয়া:
কোন ভাইরাস যখন সম্পুর্ন নতুন কোন জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করে তখন পুরো জনগোষ্ঠীর যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।তাই প্রথম রোগ সংক্রমনের কিছুটা পরেই একজন হতে আরেকজনে সংক্রমনের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে ( Exponential Growth)।এখন আক্রান্তের সংখ্যা অতি দ্রুত বাড়ার সাথে সাথে রোগ সংক্রমনের হার (সামান্য করে হলেও) আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। এর কারন হল সময়ের সাথে আক্রান্ত রোগীর একটা অংশও তো সুস্থ হয়ে উঠে এবং তারা আর নতুন করে রোগ বিস্তার করতে পারেনা-ফলে জনগোষ্ঠীর মাঝে তাদের অবস্থান অনেকটা রোগ সংক্রমন ‘প্রতিরোধকারী ঢাল’ বা ‘হিউম্যান শীল্ড’ ( Human-Shield) হিসেবে কার্যকর হতে থাকে।এভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পুরো জনগোষ্ঠীতে এই ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ ব্যক্তির সংখ্যা এমনভাবে বেড়ে যায় যে রোগ সংক্রমন বৃদ্ধির হার এক পর্যায়ে শুন্য হয়ে পড়ে এবং এরপর পরই এমন একটা পর্যায় আসে যখন এই ‘প্রতিরোধী’ জনগনের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীতে তাদের অনুপাত বা শতাংশ এমন হয় যে রোগ সংক্রমনের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করে এবং সেই সাথে নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও কমতে থাকে। ঠিক এই পর্যায়েই আমরা বলি পুরো জনগোষ্ঠীই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এভাবে আরো কিছু সময় যেতে দিলে রোগ সংক্রমনের হার এতই নগন্য হয় যে পুরা জনগোষ্ঠীই কার্যত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করে।
এখন ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের লক্ষ্যে কোন জনগোষ্ঠীর ঠিক কত ‘শতাংশ‘ লোককে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ হয়ে উঠতে হবে তা নির্ভর করে মুলত রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসটির ‘রোগ সংক্রমন হার’ বা ‘Ro’-মানের উপর। কোন ভাইরাসের Ro = ২ বলতে বোঝায় যে ১ জন আক্রান্ত ব্যক্তি নতুন করে ২ জনকে সংক্রমিত করতে পারে এবং ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য অন্ততপক্ষে ৫০% জনগোষ্ঠীকে ঐ রোগের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা’ অর্জন করতে হবে। একইভাবে কোন ভাইরাসের Ro =৩ হলে ৬৭% এবং Ro =৪ হলে ৭৫% জনগোষ্ঠীকে ‘রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন’ হয়ে উঠতে হবে- ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য।
এখন কীভাবে কোন জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট অংশকে ‘রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন’ করে গড়ে তুলে কাংক্ষিত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন সম্ভব হয়?
দুটি উপায়ে এই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন সম্ভবঃ
১)ভ্যাকসিন প্রয়োগ: এই পদ্ধতিতে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের লক্ষ্যে একটি কার্যকর ‘ভ্যাক্সিন’ প্রয়োগ করে জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশকে ‘রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন’ করে তোলা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ‘নিরাপদ’ এবং ‘গ্রহণযোগ্য’ কারন ভ্যাক্সিন গ্রহণকারীকে কোন মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়তে হয়না।
২)প্রাকৃতিকভাবে রোগ সংক্রমন এবং সুস্থতা অর্জন: এই পদ্ধতিতে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের লক্ষ্যে জনগোষ্ঠির একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘প্রাকৃতিকভাবেই’ রোগটিতে ‘আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠা’র মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ‘রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন’ হয়ে উঠে।
এই প্রক্রিয়াটি ‘বিপদজনক’ কারন ভাইরাসটি যদি ‘প্রানঘাতি’ হয় তবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন প্রক্রিয়ায় জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ মৃত্যু-মুখে পতিত হয়! তাই বৈজ্ঞানিক ভাবে এর একটা ভিত্তি থাকলেও মানবিক দিক দিয়ে বিচার করলে এটা একটা ভয়ংকর পদ্ধতি! এছাড়া অতিরিক্ত রোগীর ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসা দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ভেংগে পড়ার উপক্রম হয়।
কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি বাস্তবতা-বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট:
কোভিড-১৯ মহামারীর ক্ষেত্রে প্রাপ্ত উপাত্ত হতে দেখা গিয়েছে যে সবধরনের ‘সাবধানতামুলক’ ব্যবস্থা গ্রহনের পরও এই করোনা ভাইরাসটিন ’রোগ সংক্রমন হার’ বা ‘Ro’-মান ২.২ -৩.৪ এর মত। এই ‘Ro’-মান কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে সংক্রমনকারী ভাইরাসটির স্ট্রেইন (ধরন), শক্তিমাত্রা, জলবায়ু ইত্যাদি কারনে পরিবর্তিত হতে পারে। আবার ‘সাবধানতামুলক’ কর্মসূচী কমিয়ে ফেললে এই ‘Ro’-মান আরো বেড়ে যেতে পারে। তারপরও করোনা ভাইরাসটির ‘Ro’-মান যদি গড়ে ৩ হয় তবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য বিশ্বের ৭.৫ বিলিয়ন লোকের প্রায় ৬৭% লোককে ‘রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন’ হয়ে উঠতে হবে!
কিন্তু কোভিড-১৯ রোগটির ক্ষেত্রে, নিরাপদ ‘ভ্যাক্সিন-ভিত্তিক’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জন এই মুহুর্তে সম্ভব নয় কারন এখন পর্যন্ত কোন কার্যকরী ‘ভ্যাক্সিন’ আবিষ্কৃত হয়নি এবং আগামী ১২-১৮ মাসের মধ্যে হাতে আসার সম্ভাবনাও কম।
অন্যদিকে, প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের প্রচেষ্টা অত্যন্ত বিপদজনক-কারন রোগটি প্রানঘাতী, অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং দ্রুত সংক্রমনকারী। গত পাঁচ মাসে নানা মাত্রার লক-ডাউন, সামাজিক দুরত্ব ও সাবধানতামুলক ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও এপর্যন্ত ৫০ লক্ষেরও বেশী লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং সোয়া ৩ লাখের বেশী লোকের মৃত্যু হয়েছে যেখানে মৃত্যুর হার প্রায় ৬.৫%। যদিও এই মৃত্যুহার মুলত যারা টেষ্ট করে ‘পজিটিভ’ হয়েছে তার ভিত্তিতে। এর বাইরেও প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু টেষ্ট হয়নি, আবার প্রচুর মানুষের মৃত্যুও হয়েছে করোনার উপসর্গ নিয়ে যাদের সংখ্যা গননায় আসেনি! যাই হোক বোঝাই যাচ্ছে, মৃত্যুর এই হার যদি অব্যহত থাকে তবে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ বিশ্বের ৬৭% লোক কে আক্রান্ত করে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করতে হলে ‘কোটি কোটি’ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হবে! তার উপর ভাইরাসটির কোন বাছ-বিচার নেই এবং ইমিউন সিষ্টেম দুর্বল হলে যে কেউ মারা যেতে পারে- এক ভয়াবহ পরিস্থিতি! এছাড়া ২০% কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসা প্রদান করতে গিয়ে বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ভেংগে পড়ার উপক্রম হবে। তাই প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের প্রচেষ্টা মোটেও ‘বাস্তবসম্মত’ নয়!
এখন দেখি-প্রাকৃতিক উপায়ে কোন দেশ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের প্রচেষ্টা নিয়েছে কি?
বিশ্বের কয়েকটি দেশ অফিসিয়ালি স্বীকার না করলেও তাদের গৃহীত কিছু কর্মসূচীতে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের একধরনের ‘প্রচেষ্টা’ পরিলক্ষিত হয়েছেঃ
- যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন মার্চের মাঝামাঝি ইতালী, জার্মানী, ফ্রান্স বা স্পেনের মত বড় আকারের লোক সমাগম বা স্কুল/কলেজ বন্ধ না করার নীতি ঘোষনা দিয়েছিল। কিন্তু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হঠাৎ করে হু হু করে বেড়ে উঠলে জনগনকে ‘বাড়িতে-থাকা’র নির্দেশ দিতে তিনি বাধ্য হন। বোরিস নিজেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যে আজ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ প্রায় ২ লক্ষ ৪০ হাজার লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩৪ হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
- ইউরোপের মধ্যে সুইডেন এখন পর্যন্ত লক-ডাউনের কোন নীতিই গ্রহন করেনি- স্কুল-কলেজ, রেষ্টুরেন্ট, খেলার মাঠ সব কিছুই তারা খোলা রেখেছ। সুইডেন এর পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন যে তারা ‘হার্ড ইমিউনিটি থিওরি’ ফলো করছেন না কিন্তু জনগনের উপর ভরসা রাখছেন যে তারা নিজেদের সচেতনতার মাধ্যমেই রোগ বিস্তার রোধ করবে! অন্যদিকে সুইডেনের প্রধান মহামারী বিশেষজ্ঞ বলেছেন আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ‘ষ্টকহোম’ এ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হবে! কিন্তু এই ধরনের কর্মসূচী গ্রহনের ফলে সুইডেনে ইতিমধ্যেই ৩০ হাজার লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং সাড়ে ৩ হাজারের বেশী রোগী মৃত্যুবরন করেছে। সুইডেনে মৃতের সংখ্যা প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ড (মৃত – ৩০৬) বা নরওয়ের (মৃত- ২৩৫) চেয়ে অনেক বেশী।
- অন্যদিকে ব্রাজিলও বলছে তারা সবধরনের লকডাউনের বিরুদ্ধে। তারা সব কিছু খুলে দিয়েছে-রেষ্টুরেন্ট, পাব, শপিং মল সব কিছু! তার ফলাফলও তারা হাতেনাতে টের পাচ্ছে! এখন পর্যন্ত ২ লক্ষেরও বেশী লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং ১৪ হাজারেরও বেশী লোকের মৃত্যু হয়েছে!
কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের এই বাস্তবতায় অর্থাৎ ‘ভ্যাক্সিন-ভিত্তিক’ বা ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের এই ‘সীমাবদ্ধতা’গুলো বিবেচনা করে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই মুলত চেষ্টা করেছে একটা নির্দিষ্ট সময় জুড়ে ‘লক-ডাউন’, ‘সামাজিক দুরত্ব’ বজায় রাখা সহ অন্যান্য ‘সাবধানতামুলক’ ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে ‘রোগ সংক্রমনের হার’ কমিয়ে রাখতে, যাতে একটি কার্যকর ‘ভ্যাক্সিন’ না আসার আগ পর্যন্ত ব্যাপক ‘প্রানহানী’ না ঘটে এবং ’সংকটাপন্ন রোগী’দের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা যায়। মহামারীর একেবারে শুরুতে উন্নত বিশ্বের কোন কোন দেশ ঢিলেমী করলেও রোগের ‘তীব্রতা’ বাড়ার সাথে সাথে কমবেশী সব দেশই এই ‘সাবধানতামুলক’ পদক্ষেপগুলো গ্রহন করেছে।
কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি বাস্তবতা-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট:
বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মত বাংলাদেশেও মার্চ এর শেষ সপ্তাহ হতে স্কুল-কলেজ বন্ধ, দরকারী অফিস-আদালত সীমিত আকারে খোলা রেখে একধরনের ‘লক-ডাউন’পরিস্থিতি চালু করা হয়েছে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে পর্যাপ্ত সময় হাতে পাবার পরও আমরা নিজেদেরকে খুব একটা প্রস্তুত করে তুলতে পারিনি। আমাদের জনসংখ্যার আধিক্য, ঘনত্ব ও দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিবেচনায় সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা হতে পারতো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সীমিতকরন, বিদেশ ফেরত যাত্রীদের যথাযথ স্ক্রীনিং এবং কোয়ারেন্টিন এর বন্দোবস্ত করে জনগোষ্ঠীতে রোগ সংক্রমনের সম্ভাবনাকে কমিয়ে ফেলা।কিন্তু জানুয়ারী হতে মার্চ পর্যন্ত আগত ছয় লক্ষ প্রবাসীকে বিমানবন্দরে কোন কার্যকরী স্ক্রিনিং করতে পারিনি, তাদেরকে সাবধানতামুলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারিনি বা তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদেরকে ট্রেইস করে আইসোলেট করতে পারিনি। যার ফলে ঐ বিদেশ ফেরত যাত্রীদের দ্বারাই আমাদের এখানে কোভিড-১৯ রোগটি কম্যুনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া ঐসময়ে নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও গ্রহন করিনি যার ফলে করোনার প্রাথমিক ধাক্কাতেই আমরা খেয়াল করেছি কতটা ভংগুর আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা! অসংখ্য মানুষ করোনা ‘টেষ্ট’ করাতে পারছেনা, আবার সংকটাপন্ন রোগী ‘বিশেষায়িত’ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েও ভর্তি হতে পারছেনা!
যাই হোক, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসটি এখনো হয়তো তার ‘পূর্ন শক্তিমাত্রা’ নিয়ে আবির্ভুত হয়নি- সম্ভবত ভাইরাসটির ‘দুর্বলতর স্ট্রেইন’ বা ’জলবায়ুগত’ কারনে। কিন্তু সরকারী হিসেবে এর মধ্যেই ২৭ হাজারেরও বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ৪০০’র মত মানুষ মৃত্যুবরন করেছে। এই ‘মৃতের সংখ্যা’ অপেক্ষাকৃত কম হলেও ‘মৃত্যুর হার’ কিন্তু দক্ষিন এশিয়ায় সর্বোচ্চ- প্রায় ১৫% এর মত! যাই হোক টেষ্টের অভাবে বেসরকারীভাবে আক্রান্ত এবং করোনা উপসর্গে মৃতের সংখ্যা সরকারী হিসেবের চাইতে আরো বেশী! এই মুহুর্তে প্রতিদিনই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই!
এখন দেখি, বাংলাদেশে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের ‘বাস্তবতা’ কতখানি? আমরা যদি ‘প্রাকৃতিকভাবে’ই তা অর্জন করতে চাই, তবে ১৮ কোটি জনসংখ্যার ৬৭% অর্থাৎ ১২ কোটি লোককে কোভিড-১৯ এ ‘আক্রান্ত’ হতে দিয়ে ‘রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন’ হয়ে উঠতে হবে! আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার যদি ১০% হয় তবে মৃতের সংখ্যা হবে ১কোটি২০ লাখ; যদি ১০ভাগ কমিয়ে ১% ও ধরি তবে মৃতের সংখ্যা হবে ১২ লাখ! আরো কমিয়ে মৃতের হার ১০০ ভাগ কমিয়ে ০.১% ও যদি ধরি তাহলে ও মৃতের সংখ্যা হবে ১ লাখ ২০ হাজার! কী ভয়াবহ অবস্থা!! এই বাস্তবতায় আমরা কি চাইবো ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য এত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে জেনেশুনে ‘মৃত্যুর মুখে’ ঠেলে দিতে? না, এটা মোটেও ‘বাস্তবসম্মত’ নয় এবং মানুষ হিসেবে আমরা তা চাইতেও পারিনা!
কোভিড-১৯ হার্ড ইমিউনিটি বাস্তবতা ও লক-ডাউন শিথিলতার রূপরেখা- বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটঃ
কোভিড-১৯ জনিত ব্যাপক ‘প্রানহানী’র সম্ভাবনা বিবেচনায় ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন এবং সেই লক্ষ্যে সমস্ত লক-ডাউন, সামাজিক দুরত্ব এ সাবধানতামুলক ব্যবস্থাগুলো একেবারেই তুলে দেয়া যেমন ‘বাস্তবসম্মত’ নয় তেমনি অর্থনৈতিক বিবেচনায় দীর্ঘ সময় জুড়ে সম্পূর্ণ ‘লক-ডাউুন’ বজায় রাখাও ‘সম্ভব’ নয়। আমাদের এর মাঝামাঝি একটা কার্যকর পন্থা বের করতে হবে। কী করা যেতে পারে?
লক-ডাউন যদি খুলতেই হয় তবে অন্ততপক্ষে একটা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান বের করতে হবে। উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে আস্তে আস্তে তাদের দেশের বাস্তবতায় ধাপে ধাপে লক-ডাউন শিথিল করার পরিকল্পনা করছে কতগুলো বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে:
- বয়স্করা অতিমাত্রায় ঝুঁকিগ্রস্থ বলে তাদের কে পুরোপুরি বাসায় রেখে অপেক্ষাকৃত তরুনদের বা সুস্থ হয়ে উঠা রোগীদের সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো।
- অতি জরুরী সেবার কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজে ফেরানো।
- সীমিত মাত্রার জনসমাগমের অনুমতি দেয়া এবং বাইরে অবস্থানকালে প্রয়োজনমত মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহারের নির্দেশ।
- কর্মক্ষেত্রে, রেষ্টুরেন্টে, অন্যান্য ব্যবসায়, ধর্মীয় উপসনালয় বা অন্যান্য জনসমাগমে নিরাপদ শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা, হাত-মুখ নিয়মিত ধুয়ে জীবানু-মুক্ত করার বিধান।
- পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক ধাপে ধাপে আন্তর্জাতিক ট্রাভেল সহ অন্যান্য বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কর্ম-কান্ডের নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরন।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে আমাদেরকেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় ধাপে ধাপে লক-ডাউন তুলে নেবার একটি সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে,নানা ‘সীমাবদ্ধতা’ আর ‘অব্যবস্থাপনা’ থাকা সত্ত্বেও সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে গত দেড় মাসের লকডাউনে কিছুটা সাফল্য এসেছে- রোগে মৃতের সংখ্যা এখনো অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। কিন্তু এই ‘আপাত’ সাফল্যেকে অক্ষুন্ন রেখে একটা ‘নিরাপদ পর্যায়’ বা ‘স্থিতাবস্থা’য় পৌছানোর জন্য আমাদের এই ‘লক-ডাউন’ প্রক্রিয়াটা যখন আরো কয়েক সপ্তাহ চালিয়ে যাবার দরকার ছিল তখনই ঘোষনা এসেছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাবার, সরকারী-বেসরকারী কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে কাজের ডিউটি বাড়ানো সহ, হাট-বাজার, ঈদ শপিং এর জন্য মলগুলো খুলে দেবার। এর ফলাফল কী হতে পারে তা আমরা এই মাসের শেষ নাগাদ ভালোভাবেই বুঝতে পারবো। আরো কয়েকটা সপ্তাহ দেখা যেতে পারতো আমাদের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার ট্রেন্ড টা কী দাড়ায় এবং এই সময়ের মাঝে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামান্য হলেও তো কিছুটা ঘাটতি পুরনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের মধ্য বা উচ্চবিত্তের অনেক মানুষই সাবধানতার জন্য রোজার মাস বা মে মাসের শেষ পর্যন্ত লক-ডাউনটি চালিয়ে যাবার জন্য মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুতও ছিল। প্রশ্ন আসতে পারে দেশের ৩০-৩২% অতি দরিদ্র, দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষদের (৫.৫-৬.০ কোটি) তো বের হতেই হবে জীবিকার জন্য! কিন্তু সেক্ষেত্রেও সাময়িক একটা জরুরী বন্দোবস্তেরও সুযোগ ছিল বা আছে! আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের একটা বড় অংশ তো এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় আছে ( প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার মত) সেখান হতে জরুরী ভিত্তিতে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যবহার করে এই মানুষগুলোকে এককালিন কিছু নগদ টাকা বা ফ্রি-রেশনের ব্যবস্থা করলেও তাদেরকে তো আর কয়েক সপ্তাহ বা মাসের জন্য জীবিকার সন্ধানে বের হতে হতোনা। পশ্চিম বংগ বা পাকিস্তান কিন্তু এধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তাদের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও। সরকার বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। এছাড়া, শপিং মল বা আবদ্ধ জায়গার পরিবর্তে খোলা জায়গায় হাট-বাজারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এখনো। কোন কোন ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে ঘোষনা দিয়েছে জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় ঈদের জন্য তারা তাদের শপিং মল বন্ধ রাখবেন।তাদের এ দায়িত্বশীল উদ্যেগকে সাধুবাদ জানাই। একটি গুরুত্বপূর্ন অর্জন হয়েছে এর মাঝে-আমাদের গবেষকরা বাংলাদেশে প্রাপ্ত করোনা ভাইরাসের জিনম সিকোয়েন্স বের করতে সমর্থ হয়েছে যা আমাদের কে এই ভাইরাসের মিউটেশন ট্রেন্ড মনিটর করতে, এর শক্তিমাত্রা বুঝতে বা এর বিরুদ্ধে কার্যকরী ভ্যাক্সিন বা ড্রাগ নির্বাচনে যথেষ্ট সাহায্য করবে। আরেকটি বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে, তা হল গনস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত প্লাজমাভিত্তিক র্যাপিড টেষ্টিং কীটটির কার্যকারিতা পিসিআর টেষ্ট এর সাথে ক্রস-চেক করে ভেরিফাই করা যায় কিনা।এটা আমাদের দেশে তৈরী, সস্তা এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। যদিও সরাসরি ভাইরাসের পরিবর্তে রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি সনাক্ত করার মাধ্যমে এই কীটটি কাজ করবে তাই অনেক ফল্স ‘পজিটিভ’ ও ‘নেগেটিভ’ রেজাল্ট আসবে। তাই রোগ নিশ্চিত করার জন্য গনস্বাস্থ্যের কীটটি খুব বেশী ‘নির্ভরযোগ্য’ না হলেও অন্ততপক্ষে প্রাথমিক স্ক্রীনিং এর জন্য এটা ব্যবহার করে পিসিআর দিয়ে রোগটিকে পরে কনফার্ম করা যেতে পারে। তবে এটার সবচেয়ে কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ন ব্যবহার হতে পারে জনগোষ্ঠীর ঠিক কত অংশ ‘ইমিউনিটি’ অর্জন করেছে তা জানার জন্য। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বর্তমান বাস্তবতায় দেশের মানুষের সার্বিক কল্যানে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা বা পুনর্বিবেচনা করতে পারেন।
পরিশেষে, ‘ভ্যাক্সিন-ভিত্তিক’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনই হচ্ছে কোভিড-১৯ রোগটিকে নির্মুল করার সবচেয়ে ‘কাংক্ষিত’ ও ‘নিরাপদ’ উপায় কিন্তু একটি কার্যকর ভ্যাক্সিনের অভাবে এই মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, রোগটি ভয়ংকর ‘ছোঁয়াচে’ ও ‘প্রানঘাতি’ বলে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জন এবং সেই লক্ষ্যে সমস্ত লক-ডাউন, সামাজিক দুরত্ব এবং ‘সাবধানতামুলক’ ব্যবস্থাগুলো একেবারে তুলে দেয়াটাও কোনভাবে ‘বাস্তবসম্মত’ নয়। আবার অর্থনৈতিক বিবেচনায় দীর্ঘ সময় জুড়ে ‘লক-ডাউন’ চালিয়ে যাওয়াটাও সম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রনয়নপূর্বক সতর্কতামুলক ব্যবস্থা বজায় রেখে ধাপে ধাপে লক-ডাউন তুলে নেয়া বা শিথিল করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন ‘বিকল্প’ নেই। সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় নিরাপদ ‘ভ্যাক্সিন-ভিত্তিক’ হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের মাধ্যমে এই ভয়াবহ মহামারীকে আমরা অচীরেই জয় করবো-পৃথিবীও আবার তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে- সময়ের এই প্রত্যাশা!
লেখক : ডঃ মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে রসায়নে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী-NXP Semiconductor Inc. এ External Quality Engineer হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রসায়ন বিভাগ হতে বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি সম্পন্ন করে প্রায় তিন বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা করেন।