লিখেছেন এএইচএম নাঈম
ক্যাটি পেরিকে চেনেন আপনি। না চেনার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আপনি যদি একজন ক্রিকেটপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে আরেকজন ‘পেরি’ সম্পর্কে আপনার জানা প্রয়োজন। যার কথা বলছিলাম, তিনি এলিসা পেরি।
২০০৭ সালে ১৬ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। অস্ট্রেলিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করা সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার এলিসা পেরি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে করেন ২০ বলে ১৯ রান।
দুই সপ্তাহ পরের ঘটনা; পেরির আরো একবার অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে অভিষেক হয়। কী? অবাক লাগছে? এবার ক্রিকেট নয়, ফুটবলে অভিষেক হয় পেরির। হংকংয়ের বিপক্ষে অলিম্পিক গেমসের বাছাইপর্বের ম্যাচে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় পেরির। খেলা শুরুর দুই মিনিটের মাঝেই স্কোরশিটে নাম উঠে যায় তার।
তিন বছরের পরের ঘটনা। ২০১০ সালের নারী টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের শেষ ওভারে বল করছেন পেরি। শেষ বলে নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ৪ রান। স্ট্রাইকে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিত সোফি ডিভাইন।
শেষ বলে সোজা ব্যাটে খেললেন ডিভাইন, বল যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে ধরা হলো ক্যামেরা। কিন্তু না! বল স্ট্রেইট বাউন্ডারিতে যায়নি। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ফলো থ্রুতে নিজের ‘ফুটবল দক্ষতা’ দেখিয়ে বল ততক্ষণে আটকে দিয়েছেন পেরি। অস্ট্রেলিয়াও জিতে গেল, ভাগ্যিস ফুটবলটা খেলতেন পেরি!
২০১১ এর নারীদের ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে পরাজিত হয় অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন এলিসা পেরি। তার গোলটিকে সকারু কিংবদন্তি ক্রেইগ ফস্টার বলেছেন, “One of the best ever in Australia’s World Cup history.“
২০১৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার নিয়ে খেলতে নেমেও প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের টপ অর্ডারকে গুঁড়িয়ে দেন পেরি। ১৯ রানের মাঝেই টপ থ্রিকে সাজঘরের পথ দেখান তিনি। শিরোপাও সেবার যায় অজিদের ঘরে।
২০১৫ নারী অ্যাশেজে পেরি ২৬৪ রান করার পাশাপাশি শিকার করেন ১৬ উইকেট, যা ছিল উভয় দলেরই সর্বোচ্চ। ২০১৪ থেকে ২০১৬- এই সময়টুকুর মাঝখানে ২৩ ইনিংসে ১৭ বার অর্ধশতক পেরিয়েছেন পেরি। সে বছর উইজডেনের বর্ষসেরা নারী ক্রিকেটার হন তিনি।
এলিসা পেরি বড় হয়েছেন সম্পূর্ণ খেলাধুলার পরিবেশে। তার বাবা মার্ক পেরি একজন অবসরপ্রাপ্ত গণিত শিক্ষক এবং একজন অ্যামেচার ফুটবল কোচ। তিনি স্কোয়াশ ও গ্রেড ক্রিকেটও খেলেছেন। মা ক্যাথি সাঁতার ও নেটবলে পারদর্শী। তার ভাই ডেমিয়েন ক্রিকেট ও ফুটবল খেলোয়াড়। তথাপি ক্রিকেট বা ফুটবলকে পেশা হিসেবে নেয়ার কথা ভাবা পেরির জন্য সহজ ছিল না।
দুই খেলায় জাতীয় দলের হয়ে দায়িত্ব পালন করা কখনোই সহজ কাজ ছিল না। সিডনি ফুটবল ক্লাবের হয়ে ২০১৭ মৌসুম পর্যন্ত ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল খেলেছেন এলিসা পেরি। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের কারণে দুই খেলায় সমানভাবে অংশ নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। ২০১২ এর পরে অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দলে খেলেননি তিনি, অস্ট্রেলিয়ার উইমেন্স ফুটবল লিগেও খেলা কমিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য ২০১৫ বিশ্বকাপেও খেলা হয়নি তার। পেরি পরিচয় দিয়েছেন পেশাদারিত্বের, দীর্ঘায়িত করেননি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ফুটবল ক্যারিয়ার।
গত কয়েক মৌসুমে এলিসা পেরি নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন দুর্দান্ত ফাস্ট বোলার হিসেবে। দুদিকে বল সুইং করানোর পাশাপাশি বাউন্সার দিয়ে ব্যাটসম্যানকে চমকে দেয়ার কাজটা ভালোই পারেন তিনি। ব্যাটিং করেন টপ অর্ডারে। নারীদের টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান কিন্তু তারই (২১৩*)।
এক সাক্ষাৎকারে তার ইংল্যান্ড উইমেন্স সুপার লিগের সতীর্থ ও অধিনায়ক জর্জিয়া এলভিস বলেন, “Perry is always working on parts of her game and she doesn’t mind if she’s last off the training ground.“
ব্যাট হাতে তার একটা দুর্বলতা ছিল কাভারের উপর দিয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে ফেরার। ঘন্টার পর ঘন্টার অনুশীলনে পেরি তার দুর্বলতাকে রূপান্তর করেছেন তার শক্তির জায়গায়।
ধারাভাষ্যকাররা সবসময় ‘এক্স ফ্যাক্টর’-এর কথা বলেন। বল পায়ে একজন ফুটবলার, যাকে থামানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন ডিফেন্ডাররা, কিংবা ব্যাট হাতে যে নামলে মনে হয় তাকে আউট করা অসম্ভব- ‘এক্স ফ্যাক্টর’-কে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। এই ‘এক্স ফ্যাক্টর’-এর যথার্থ উদাহরণ এলিসা পেরি। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের চাপ নিতে জানেন, চাপ সামলাতে জানেন, সেই চাপ সামলে জিততেও জানেন তিনি।
২০১৫-১৬-তে অনুষ্ঠিত হয় নারীদের প্রথম বিগব্যাশ টুর্নামেন্ট। সেই আসরে অধিনায়কত্বের নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন পেরি। তার অনভিজ্ঞ দল সিডনি সিক্সার্স প্রথম ছয় ম্যাচ হেরে যায়। পেরির অধিনায়কত্বের দক্ষতা নিয়ে তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছিল।
সপ্তম ম্যাচে আশ্চর্য কাণ্ড করলেন পেরি। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ফ্ল্যাট পিচে টস জিতে ব্যাটিং না করে প্রতিপক্ষ পার্থ স্করচার্সকে ব্যাটিংয়ে পাঠান তিনি। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত কাজে লাগে। দুর্দান্ত বোলিং করেন পেরি ও তার সতীর্থরা। ম্যাচ জিতে যায় সিডনি সিক্সার্স। সেখান থেকে টানা নয় ম্যাচ জিতিয়ে দলকে ফাইনালে তোলেন এলিসা পেরি। চাপের মুহূর্তে সঠিক পরিকল্পনা করতে পারা এবং তার বাস্তবায়ন কেবল সেই আসরে নয়, পুরো ক্যারিয়ারেই করে এসেছেন পেরি।
নারীদের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১১২ ম্যাচে ৫২ গড়ে তিন হাজারের উপর রান করার পাশাপাশি ২৪ গড়ে শিকার করেছেন ১৫২ উইকেট। নারীদের টেস্টেও পিছিয়ে নন, ৮ টেস্টে ৭৮ গড়ে ৬২৪ রান ও ১৮ গড়ে ৩১ উইকেট তার ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের পরিচায়ক। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন ১১৮ টি-২০ ম্যাচও।
কেবল ক্রিকেটার বা ফুটবলার হিসেবেই নন, এলিসা পেরি নাম করেছেন শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও। শেরিল ক্লার্কের সাথে মিলে চার বইয়ের যে বেস্টসেলিং সিরিজ লিখেছেন, তাতে শিশুদের জন্য রয়েছে অনুপ্রেরণাদায়ক বার্তা।
সম্প্রতি ২০২০ নারী টি-২০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলল অস্ট্রেলিয়া। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ৮৬,১৭৪ জন দর্শক উপভোগ করলেন নারী ক্রিকেট। চোটের কারণে খেলতে পারেননি তিনি। কিন্তু সেই ১৬ বছরের কিশোরী এলিসা পেরি সম্ভবত যে স্বপ্নটি দেখেছিলেন, তা-ই পূরণ করলেন তার সতীর্থরা। পেরি তার পুরো খেলোয়াড়ী জীবন ধরে কামনা করে এসেছেন নারী ক্রিকেট এমন জনপ্রিয় হোক। সবসময় চেয়েছেন পুরুষদের ক্রিকেটের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে। চেয়েছেন যেন মাধ্যমিক স্কুলের একটা মেয়ে ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে ভয় না পায়।
ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে দাঁড়িয়ে এলিসা পেরি। অর্জন করেছেন অনেক কিছু। তবে যে কাজটি তার জীবনের সেরা কীর্তি, তা হলো একটা প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা। তাই একজন চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার, একজন দুর্দান্ত ফুটবলার, একজন লেখিকার পরিচয়ের ঊর্ধ্বে এলিসা পেরি একজন অনুপ্রেরণার নাম।