করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে চীনের প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনাম। ৯ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে শনিবার পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩২৮ জন, মৃতের সংখ্যা শূন্য।
সিএনএন জানায়, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তেমনটা উন্নত নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন-মধ্য আয়ের এ দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন ৮ জন।
গোটা ভিয়েতনামে কখনোই লকডাউন চালু হয়নি। কিন্তু কোথাও সামাজিক সংক্রমণের সম্ভাবনা দেখা গেলেই সেসব এলাকা ১৪ থেকে ২১ দিনের লকডাউন চালু করে কর্তৃপক্ষ। টানা তিন সপ্তাহ পর এপ্রিলের শেষে দেশটির সব পাবলিক প্লেসে সামাজিক দূরত্বের নিয়ম চালু হয়।
টানা ৪০ দিন ভিয়েতনামে কোনো স্থানীয় সংক্রমণ হয়নি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্কুলগুলো চালু হয়েছে। ধীরে ধীরে দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।
অনেকেই ভিয়েতনামের সরকারি তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন। তবে, ভিয়েতনামে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক গ্যাই থাইয়েটস বলেন, ‘বাস্তব চিত্রের সঙ্গে এই সংখ্যা সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি প্রতিদিন ওয়ার্ডগুলোতে যাই, রোগীদের দেখি। এখনো পর্যন্ত কাউকে মারা যেতে দেখিনি।’
হো চি মিন সিটির অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক গাই থোয়েটস আরও বলেন, ‘যদি সামাজিক সংক্রমণ অনিয়ন্ত্রিত হারে বাড়তে থাকে কিংবা সরকার পর্যন্ত তথ্য না পৌঁছায় সেক্ষেত্রেও অন্তত কিছুটা হলেও এর প্রভাব হাসপাতালগুলোতে পড়ে। অনেকেই সন্দেহ করতে পারেন যে, হয়তো মানুষজন করোনার উপসর্গ নিয়ে আসছেন এবং তাদের চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ফলে সঠিক সংখ্যা আড়ালে থাকছে। কিন্তু না, এমনটা কখনো আমাদের হাসপাতালে ঘটেনি। আর চারপাশে ঘটলেও আমরা খবর পেতাম।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিয়েতনামের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দ্রুত ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা। প্রাথমিক অবস্থাতেই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর জন্য আক্রান্তের সংস্পর্শে আসাদের শনাক্তকরণ, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা এবং মানুষকে ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে সফল হয়েছে ভিয়েতনাম।
আক্রান্ত হওয়ার আগেই কঠোর ব্যবস্থা
গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে, যখন দেশটিতে একজনও কোভিড-১৯ আক্রান্ত শনাক্ত হয়নি, তখনই ভিয়েতনাম সরকার ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেয়। রহস্যময় নতুন ‘নিউমোনিয়া রোগে’ উহানে দুই জন মারা যাওয়ার পরই তারা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
জানুয়ারির শুরুতে হ্যানয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উহান ফেরত যাত্রীদের জন্য তাপমাত্রার স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। জ্বরে আক্রান্ত যাত্রীদের আইসোলেশনে পাঠিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
জানুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে ভিয়েতনামে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। উহান থেকে এক নারী তার ছেলেকে দেখতে হো চি মিন সিটিতে এসেছিলেন। স্বাস্থ্যপরীক্ষায় তার করোনা শনাক্ত হয়।
এর পরদিনই উহানে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ভিয়েতনাম। চীনের সঙ্গে সীমান্ত এলাকাগুলো কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই সীমান্ত যোগাযোগ পুরো বন্ধ করে দেওয়া হয়। সীমান্তসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়।
জানুয়ারির শেষে চান্দ্র নববর্ষ উপলক্ষে স্কুলগুলো বন্ধই ছিল। তখনই স্কুলের ছুটি মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়।
হ্যানয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড এপিডেমিওলজির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-প্রধান ফাম কোয়াং থাই বলেন, ‘আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম না। তাদের নির্দেশনার আগেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা বাইরের দেশগুলোর ডেটা থেকে নিজেদের দেশের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেটা কল্পনা করেছি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
কঠোর স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা
ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ভিয়েতনামের বিমানবন্দরগুলোতে কঠোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা হয়েছিল।
যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে তাদেরকে একটি স্বাস্থ্যফর্ম পূরণ করতে হয়। সেই ফর্মে যাত্রীরা কার কার সংস্পর্শে এসেছে, কোথায় কোথায় গিয়েছে সেসব তথ্য দেন।
কারো শরীরের তাপমাত্রা যদি ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে তখন তাকে সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। করোনা পরীক্ষা করা হয়।
অন্যদিকে, কেউ স্বাস্থ্য ফর্মে ভুল তথ্য দেওয়ার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
লকডাউন
প্রথম থেকেই দেশজুড়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করেছে ভিয়েতনাম কর্তৃপক্ষ। কোনো এলাকায় এমনকি মাত্র একজন আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকা লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে।
দেশটতে ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম লকডাউন চালু হয়। হ্যানয়ের ১০ হাজার মানুষকে ২০ দিনের জন্য বাড়িতে লকডাউনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেসময় ওই অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সাত।
আক্রান্তের সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করে বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করেছে ভিয়েতনাম কর্তৃপক্ষ।
অধ্যাপক থোয়েটস বলেন, ‘ব্যাপক পরিসরে মানুষকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো এই সাফল্যের পেছনে একটা বড় কারণ। কেননা যত মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল তাদের অর্ধেকের মাঝে কোনো ধরনের উপসর্গ ছিল না।’
তিনি আরও জানান, উপসর্গ থাকুক-না থাকুক, কোয়ারেন্টিনে যাদের নেওয়া হয়েছিল, তাদের সবাইকে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষা করা না হলে ভিয়েতনামে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত রোগীদের শতকরা ৪০ ভাগ জানতোই না যে তাদের শরীরে ভাইরাস রয়েছে।
অধ্যাপক থোয়েটস বলেন, ‘উপসর্গহীন রোগীদের মাধ্যমে ব্যাপক সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে করণীয় একটাই। যেটা ভিয়েতনাম করেছে। তাদের যদি কোয়ারেন্টিনে আটকে রাখা না হতো, তাহলে তারা বাইরে ঘুরে বেড়াতো এবং অন্যদের সংক্রমিত করতো।’
ভিয়েতনাম স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অর্থাৎ আক্রান্তের সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে। এজন্য দেশটিতে ব্যাপক জনশক্তি নিয়োগ করা হয়।
জনগণের কাছে সফলভাবে তথ্য পৌঁছে দেওয়া
ভিয়েতনামের সাফল্যের জন্য গবেষকরা তৃতীয় যে বিষয়টির উল্লেখ করছেন, সেটি হচ্ছে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুরু থেকেই সরকার এই ভাইরাসটি কতখানি মারাত্মক সে ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছে।
জনগণকে সফলভাবে বোঝাতে পেরেছে, কোনোভাবেই নিজেদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যাবে না।
সরকারের বেশ সৃজনশীল কিছু কৌশল এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
যেমন, প্রতিদিন সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তথ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের বরাতে করোনাভাইরাসের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সব মানুষের মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হতো।
ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জনগণের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে ভিয়েতনামের সব শহরে পোস্টার লাগানো হয়েছে।