লিখেছেন ডঃ শোয়েব সাঈদ, মন্ট্রিয়ল থেকে
কোভিড সংগ্রামের ঘাত-প্রতিঘাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন সংহার, মিলিয়ন্স মানুষের সংক্রমণ, চাকুরী বাজার আর অর্থনীতির অভূতপূর্ব ধসের মাঝে আমাদের পার হয়ে গেছে প্রায় ৬টি মাস। গত সপ্তাহে লিখেছিলাম শীতকালীন দেশগুলোতে কাঙ্খিত সামারের লোভনীয় আহবানে লকডাউন মেনে চলা খুবই মুশকিল। আজ মধ্য মে মাসের এই রোববারে কোভিডে এই পর্যন্ত দুই হাজারেরও অধিক মৃত্যু ভারাক্রান্ত শহর মন্ট্রিয়লের নদীর ধারে বা পার্কে জনসমাগম দেখে আইননিষ্ঠ কানাডিয়ান জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের অধৈর্য হয়ে উঠা কিংবা নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণের প্রবণতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে খুব পার্থক্য খুঁজে পাইনি। এমতাবস্থায় সংক্রমণের প্রথম ধাপ থেকে বের হয়ে আসা কিংবা দ্বিতীয় ওয়েভের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান। যুদ্ধ কৌশলে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে অপেক্ষা করা কিংবা আক্রমণে যাওয়া এই দুটো হচ্ছে মূল পন্থা। লকডাউনের প্রতি নিষ্ঠার অভাবে দুর্গে নিরাপদ থাকা অর্থাৎ প্রতিরক্ষা ব্যূহের রক্ষা কবচে ভাল থাকার সম্ভাবনা ক্রমশই কমে আসছে। প্রতিরোধ যখন দুর্বল, আক্রমণে যাওয়াই তখন শ্রেয়। কিন্তু আক্রমণের যথোপযুক্ত অস্ত্র যুদ্ধ জয়ের প্রধান শর্ত। আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত বিজয় নিশ্চিত করতে পারার মত কোন অস্ত্র নেই, তবে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার নজীরবিহীন অবিরাম এক কর্মযজ্ঞে মহাব্যস্ত দেশে দেশে বিজ্ঞানী আর সংশ্লিষ্ট লোকবল কাঙ্খিত হাতিয়ারটি উদ্ভাবনে। অর্থ, প্রযুক্তি আর সামর্থ্যের সম্মিলনে SARS-CoV-2 নামক ভাইরাসটির প্রতিষেধক কিংবা ঔষধ উদ্ভাবনে মানবজাতির সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পরার আয়োজনটি মানব সভ্যতার এক অভূতপূর্ব বাঁচা মরার লড়াই; আশা নিরাশার দোলায় দুলছে গোটা বিশ্ব। প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন দিয়ে SARS-CoV-2 কে আক্রমণ করতে না দেওয়া কিংবা SARS-CoV-2 এর সংক্রমণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবার পর ভাল হয়ে যাবার ঔষধ আবিস্কারে ব্যস্ত বিশ্ব। এবারের লিখায় এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করছি।
প্রথমেই আসি ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে। ঘাতক অনুজীবকে পরাস্ত করে সমূলে উৎপাটনের মাধ্যমে মানবজাতিকে নিরাপদ রাখতে এটি সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। হার্ড ইমিউনিটি অর্জনেও ভ্যাকসিন অত্যাবশ্যক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ব্যাপক সময় সাপেক্ষ এবং এটি নিরাপদ কিনা এটি নিশ্চিত করতেই অনেক সময় লেগে যায়। এর উদ্ভাবন প্রক্রিয়ার বড় ঝুঁকি হচ্ছে শেষতক কাজ করবে কিনা সেই অনিশ্চয়তা। করোনা লড়াইয়ে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে বিশ্বব্যাপী শতাধিক প্রজেক্ট কাজ করছে যার মধ্যে কয়েকটি আশার আলো ছড়াচ্ছে। ঔষধের মতই ভ্যাক্সিনকে মানব শরীরের পরীক্ষার অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চারটি ধাপ পার হতে হয় যার মধ্যে অনুমোদিত হতে হলে প্রথম তিনটি ধাপকে অতিক্রম করতে হয়। কয়েক জন থেকে কয়েক শত হয়ে কয়েক হাজার মানুষের উপর কার্যকারিতা আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষার এই তিনটি ধাপে সন্তোষজনক ফলাফলের উপর নির্ভর করে অনুমোদন। মানব ট্রায়েলের চতুর্থ ধাপে থাকে অব্যাহত পর্যবেক্ষণ আর দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখার বিষয়। স্বাভাবিক অবস্থায় ট্রায়ালের তিনটি ধাপ শেষ করে অনুমোদন পেতে কয়েক বছর লেগে যায়। মহামারীর অতীব জরুরী এই অবস্থায় প্রথম তিনটি ধাপ একের পর এক ধাপ অতিক্রমের পথ পরিহার করে একটি ধাপের চূড়ান্ত ফলাফলের অপেক্ষা না করেই আরেকটি ধাপ শুরু করার ওভারলেপিং প্রক্রিয়ায় একই সাথে ধাপগুলি অতিক্রমের মাধ্যমে সময় কমিয়ে আনা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে অগ্রাধিকারে দ্রুততার সাথে অনুমোদনের মাধ্যমে মোট সময় কমিয়ে আনার পরেও বাজারের আসতে এই বছরের শেষ নাগাদ সময় লেগে যাবে যদি কোন ভ্যাকসিন আমাদের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়। ধাপ অতিক্রমের ওভারলেপিং এপ্রোচে ঝুঁকি থাকলেও যথাসম্ভব নিরাপদ ট্রায়াল নিশ্চিত করা হয়। সম্প্রতি কানাডার থেকে সুসংবাদটি হচ্ছে একটি চীনাকোম্পানি CanSino Bilogistics এর ভ্যাকসিন AdV5-nCov এর জন্যে কানাডা সরকারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি। কানাডার আগে চীন শুরু করেছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি এবং ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ধাপে আছে। কোভিড লড়াইয়ে বিশ্ব এই প্রথমবারের মত দ্বিতীয় দফায় কোন ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে অন্য আরেকটি দেশে। কানাডা অনুমোদন দিয়েছে AdV5-nCov ভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নোভাস্কশিয়া প্রদেশের হ্যালিফেক্স শহরের ডালহৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ের কানেডিয়ান ভ্যাক্সিনোলজি সেন্টারে। ডালহৌসী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নিজেদের ডাটার উপর নয়, চীনের ডাটার উপরেও নজর রাখছে। সফল হলে দ্রুত উৎপাদনে গিয়ে প্রথমে কানাডার প্রয়োজন মেটাতে প্রস্তুত কানাডা সরকার আর বেসরকারি সহযোগীরা।
প্রায় গোটা দশেক কোম্পানি ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে আছে। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এসট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে এপ্রিলের শেষের দিকে ৫০০ মানুষের উপর ট্রায়াল শুরু হয়েছে। অক্সফোর্ডের ভাষ্য অনুসারে সফল হবার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরের দিকে ভ্যাক্সিনটি পাওয়া যেতে পারে। এই সামারে অনুমোদনের জন্যে প্রয়োজনীয় ট্রায়ালের শেষ ধাপটি শুরু হবার আশা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল ভিত্তিক কোম্পানি মডার্না ম্যাসাঞ্জার আরএনএ ভ্যকাসিন নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে গত মার্চে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) থেকে দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছে এবং আশা করা যাচ্ছে বছরের মাঝামাঝি ধাপ তিনের ট্রায়াল শুরু হবে। তৃতীয় ধাপে সফল হলে দ্রুত অনুমোদন দিতে এফডিএ তৎপর রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভ্যানিয়া ভিত্তিক বায়োটেক কোম্পানি ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যাল বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে কাজ করছে। এপ্রিলে প্রথম ফেজের কাজ শুরু করে সামারে দ্বিতীয়, তৃতীয় ফেজে যাবার ইচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, জন্সন জন্সন, সানোফি, ফাইজারের মত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি ব্যস্ত রয়েছে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায়। কানাডার কুবেকে অনুজৈবিক প্রযুক্তির লালামন্ড সম্মিলিতভাবে উলাইস বায়োটেক, বায়ো-কে-প্লাস ইন্টারন্যাশনালের মত কোম্পানির সাথে ইস্ট এবং ব্যাকটেরিয়া থেকে ওরাল ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের প্রোজেক্টে কাজ করছে। যক্ষ্মা আর পোলিও ভ্যাক্সিনের মত ইতিমধ্যে ব্যবহৃত ভ্যাকসিন দিয়ে SARS-CoV-2 কে দমন করার বিষয়টিও পরীক্ষা করা হচ্ছে যদিও আপাতত আশাপ্রদ অগ্রগতি নেই।
ভ্যাক্সিনের মত সর্বাত্মক সমাধানের পাশাপাশি করোনা ভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত সফল কোন ঔষধের দেখা মেলেনি। রোগীদের বাঁচাবার জন্যে নতুন ঔষধ উদ্ভাবনের পাশাপাশি পুরনো ঔষধ প্রয়োগে সফলতার পাবার বিষয়ে বৈশ্বিক গবেষণায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু পজিটিভ ফলাফল এসেছে বটে কিন্তু এখনো সার্বজনীন হয়নি। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ৯০% রোগী উপসর্গ ছাড়া কিংবা সাধারণ সর্দি কাশির মত উপসর্গ নিয়ে এমনিতে সেরে যায় কিন্তু বাকী ১০% এর জন্যে চিকিৎসাটা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাড়ায়।
ঔষধ আবিস্কারের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশও জড়িত। প্রথমেই আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৬০ জন রোগীর ওপর অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল মেডিসিন ইভারমেকটিনের সিঙ্গল ডোজের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মাত্র তিন দিনে ৫০ শতাংশ লক্ষণ কমে যাওয়া আর চার দিনে করোনা ভাইরাস টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ আসার সাফল্য পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঐ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞগণ। অধ্যাপক ডা. তারেক আলম এবং অধ্যাপক ডা. রুবাইয়ুল মোরশেদের ভাষ্যমতে এই ঔষধ দুটির সম্মিলিত ব্যবহারে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্য দুটি ঔষধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও রেমডিসিভিরের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ফল পাওয়া যাবে। আরও জানা গেছে এই ঔষধ নিয়ে ভারতে গবেষণা শুরু হয়েছে।
ফ্যাভিপিরাভির ব্র্যান্ড নাম অ্যাভিগান, একটি এন্টিভাইরাল ড্রাগ। ২০১৪ সালে জাপানের ফুজি ফিল্ম গ্রুপের তয়োমা ক্যামিক্যালের উদ্ভাবিত এই ঔষধ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে খুবই কাজে লেগেছিল। অ্যাভিগান (৬-ফ্লুরো-৩-হাইড্রোক্সি-২-পাইরাজনিকারবক্সামাইড) হচ্ছে পিউরিন নিউক্লিক এসিড এনালগ। এই ড্রাগটি ওরাল ট্যাবলেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি আর সংক্রমণ সক্ষমতা কিছু এনজাইমের উপর নির্ভর করে। এনজাইম হচ্ছে আসলে প্রোটিন।এই এনজাইমের কার্যক্ষমতা বা প্রোটিন গঠনে আঘাত করে ভাইরাস দমন করা যায়। অ্যাভিগান “আরএনএ নির্ভরশীল আরএনএ পলিমারেজ” (আরডিআরপি) এনজাইমটি নিস্ক্রিয় করে ভাইরাসের কার্যক্ষমতা অকেজো করে দিয়ে বিস্তার রোধ করে। বাংলাদেশে বেক্সিমকো, বিকন ফার্মা এটির উৎপাদনে রয়েছে। চীনে ট্রায়ালে দেখা গেছে এটি প্রয়োগে ৬১% রোগী ৭ দিনের মধ্যে জ্বর, কাশি থেকে মুক্ত হয়েছে। অ্যাভিগান নিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের উচ্ছ্বাসের মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এবং জন্ম ত্রুটির বিষয়ে সতর্কতা এসেছে। ভাইরাসে আক্রান্ত হবার প্রথম দিকে এটি যতটুকু কার্যকর, সিরিয়াস অবস্থায় ততটা নয় বলে মতামত আছে।
কোভিড যুদ্ধে রেমডেসিভি নামের আরেকটি ঔষধের উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশের আটটি ফার্মা কোম্পানি। এডেনোসিন নিউক্লিওসাইড ট্রাইফসফেটের এই এনালগটি আরডিআরপি এনজাইমের কাজে ব্যাঘাত করে ভাইরাল লোড কমিয়ে আনে ফলে রোগী কম সময়ে ভাল হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডঃ অ্যান্থনি ফসি বলেন এই ড্রাগ ব্যবহারে ১৫ দিনের জায়গায় ১১ দিনে ভাল হয়েছে অনেক রোগী। তবে এই কার্যকারিতা নিয়ে ভিন্নমত আছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগকৃত এই ড্রাগ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের জিলিড সায়েন্স উদ্ভাবন করে।
আরো কিছু ড্রাগ যেমন ইন্টারফেরন আলফা টুবি, কালেটরা, আরবিডল, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, ক্লোরোকুইন কোভিড যুদ্ধে সফলতার পরীক্ষা নিরীক্ষায় রয়েছে। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন/ ক্লোরোকুইন নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এডভোকেসী এবং এর সেফটি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সতর্ক বার্তা ইত্যাদি এপিসোডের মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছে অস্থির সময়। অপেক্ষায় থাকতে হবে বিক্ষিপ্ত নয়, সার্বিক কার্যকারিতার সুখবরের জন্যে।
অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সোরেনটো থেরাপিউটিক নামের একটি ছোট কোম্পানি এন্টিবডি ড্রাগের মাধ্যমে ভাইরাস প্রতিহত করার সফলতার কথা বলেছে। মনোক্লোনাল এন্টিবডি ড্রাগের মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেমকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে একশনে সাহায্য করতে কাজ করছে বেশ কিছু কোম্পানি। ভীর বায়োটেক চাইনিজ সহযোগীদের নিয়ে এবং এবচেলেরার মত কোম্পানি কোভিড যুদ্ধে ব্যস্ত মনোক্লোনাল এন্টিবডি নিয়ে। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষের রক্তরস বা প্লাজমায় প্রাপ্ত এন্টিবডি নিয়ে রোগীদের ইমিউন সিস্টেমকে অস্ত্র সজ্জিত করে লড়াইয়ের কৌশল নিয়ে কাজ করছে অনেকেই। বাংলাদেশেও প্লাজমা এন্টিবডি নিয়ে স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এথারসিস কোম্পানি কাজ করছে স্টেম সেল নিয়ে। কোভিডে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের মধ্যে একিউট রেস্পিরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোমে (এআরডিএস) মারা যায় বেশী। স্টেম সেল এর মাধ্যমে এআরডিএসের চিকিৎসার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এআরডিএস এ ফুস্ফুস অকেজো হয়ে যায়।
কোভিড যুদ্ধে সাইটোকাইন এবং সাইটোকাইন ঝড় শব্দগুলোর সাথে অনেকেরই হয়তো পরিচয় ঘটেছে। সাইটোকাইন হচ্ছে ছোট আকারের প্রোটিন, আমরা একে পেপটাইডও বলতে পারি। পেপটাইড তৈরি হয় এমাইনো এসিড দিয়ে। সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই এবং অন্যান্য ইমিউন ইস্যুতে সাড়া দিতে সাইটোকাইন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শ্বাস কষ্ট, নিউমোনিয়া কোভিড রোগীদের অবস্থা সংকটাপন্ন করে তুলে। এই ক্ষেত্রে কিছু রোগীর বেলায় প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে ইমিউন সিস্টেমের মাত্রাতিরিক্ত সাড়ার কারণে শ্বেত রক্ত কণিকাগুলো সক্রিয় হয়ে প্রচুর পরিমানে সাইটোকাইন রিলিজ করে এবং এই অবস্থাকে বলে সাইটোকাইন ঝড়। এই সাইটোকাইন ঝড়ের কবলে পরে অনেকে এআরডিএস মত মরণাপন্ন অবস্থায় পতিত হয় এবং ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিতে হয়। সাইটোকাইন ঝড়ের কবল থেকে রক্ষার জন্যে কিছু ইমিউন অবদমন ড্রাগের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে বেশ কয়েকটি কোম্পানি।
কোভিড সংগ্রামে ভ্যাকসিন আর ড্রাগ নিয়ে উপরোক্ত ধারণামূলক আলোচনায় এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আজ এই কঠিন পরিস্থিতিতে মানব সভ্যতা তার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার নানা ফ্রন্টে লড়ছে একটি মোক্ষম অস্ত্রের জন্যে। আমরা দুলছি আশা নিরাশার দোলাচলে। এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত কিছু আশার আলো ছড়ালেও টানেলের শেষ প্রান্তে এসে এখনো উদ্ভাসিত আলোর মুখোমুখি হইনি আমরা। টানেলটি যেহেতু অচেনা, শেষ প্রান্ত সম্পর্কেও আমরা অজ্ঞ। এই অজ্ঞতার মাঝে হঠাৎ করেই সুযোগ এসে যেতে পারে উদ্ভাসিত আলোয় স্নিগ্ধ হবার। যুদ্ধকালীন অবস্থার চাইতেও জরুরী ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী একটি ভ্যাকসিন বা একটি ড্রাগের তৃষায় ছুটছে মানবজাতি তার বিজ্ঞানভিত্তিক মেধা আর মননের সবটুকু ঢেলে দিয়ে। ভাগ্য আমাদের ফেরাবে না নিশ্চয়, শীঘ্রই দেখা মিলবে একটি সমাধানের, আর এই আশাই হচ্ছে আমাদের লড়ে যাবার ড্রাইভিং ফোর্স।
লেখক: কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক বিষয়ে বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।