লিখেছেন শ্যামল কান্তি ধর
২ মে ২০২০ তারিখ ছিল চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, সঙ্গীত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মদিন। চলচ্চিত্র শিল্পের এই প্রবাদ পুরুষ সারা বিশ্বে যেমন আলোচিত তেমনি কিছু সমালোচনার তীরেও বিদ্ধ। তাঁর বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে ‘দারিদ্র্য বিক্রির” হাস্যকর অভিযোগও উঠে! সত্যজিৎ রায়ের এই জন্মশতবার্ষিকীতে এইসব আলোচনায় না গিয়ে, আমি শুধু আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার একটি উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি “সত্যজিতের সিনেমা যে দেখেনি, সে পৃথিবীতে বাস করেও চাঁদ আর সুর্য দেখেনি”।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারনে একসময় সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা, তাঁর রচিত সিনেমা বিষয়ক বইয়ের কিছু কাছাকাছি যাবার সুযোগ ঘটে। আজ তাঁর জন্মের শতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করি শ্রদ্ধার সাথে এবং তুলনামুলকভাবে কম আলোচিত তাঁর এক সৃষ্টি “টু'(Two) নিয়ে কিছু আলোচনার চেষ্টা করছি এবং তা অবশ্যই দর্শক চোখে যা দেখেছি সেভাবে।
মাত্র পনেরো মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবি “টু'(Two) নির্মিত হয় ১৯৬৪ সালে অর্থাৎ তার প্রথম সিনেমা “পথের পাঁচালী “মুক্তির নয় বছর পর। “ইসো ওয়ার্ল্ড থিয়েটার”-এর ব্যানারে আমেরিকান পাবলিক ব্রডকাস্টিং টেলিভিশনের জন্য নির্মিত এই ছবি সংলাপহীন। ছবিটি ইংরেজি ভাষায় নির্মাণ করার জন্য সত্যজিৎ রায়কে অনুরোধ করা হলেও তিনি তাতে রাজি হননি। অবশেষে শব্দ ও আবহ সংগীতের সংমিশ্রনে নির্মিত হয় “টু’। আমার মনে হয় সংলাপহীন এই ছবি নির্মাণে সত্যজিৎ রায় বেশ সাচ্ছন্দ্য ছিলেন। কারণ চলচ্চিত্রে সংলাপের ব্যাপারে তার নিজস্ব চিন্তা হলো “চলচ্চিত্রে সময়ের দাম বড় বেশী। যত অল্প কথায় যত বেশী বলা যায়, ততই ভালো; আর কথার পরিবর্তে যদি ঈংগিত ব্যবহার করা যায়, তবে ত কথাই নেই”। ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায়ের আরেক মাস্টারপিস “চারুলতা” মুক্তি পায়। “চারুলতা” নিয়ে এত আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে যে “টু” প্রায় চাপা পড়ে গেছে “চারুলতা”র চাপে। “টু” দুই চরিত্রের একটি সংলাপহীন চলচ্চিত্র। তাই এ ছবি উপভোগ করতে হয় গভীর একাগ্রতায়, তবেই এর রস আস্বাদন সম্ভব।
“টু”কে কি বলব? শ্রেনীদ্বন্দ্ব? সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের লড়াই? নিঃসঙ্গতায় বন্দি এক শৈশবের কাহিনী? নাকি শুধু দুই শিশুর খেলাচ্ছলে লড়াই মাত্র? পনেরো মিনিটে সংলাপহীন এই চলচ্চিত্রে ছয় থেকে সাত বছরের দুই শিশুর বিভিন্ন অভিব্যাক্তি, কার্যকলাপের মাধ্যমে অনেক বিষয়ে আমাদের ভাবান সত্যজিৎ রায়। চলুন ঘুরে আসি “টু” এর কিছু দৃশ্যাবলী থেকে।
প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখি কোমরে খেলার তলোয়ার, মাথায় মিকি মাউস ক্যাপ, হাতে কোমল পানীয়ের বোতল হাতে এক বালক ছাদে এসে দাঁড়ায়, হাত নেড়ে গাড়ি দিয়ে চলে যাওয়া কাউকে বিদায় জানায়। গাড়ির জানালা দিয়ে এক নারীর হাত নাড়ানো দেখা যায়।আমাদের বুঝে নিতে হয় সেই হাত তার মায়ের হাত। বালক ঘরে ফেরে। পথে পড়ে থাকা ফুটবলকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দেয় যেন তার চলার পথে কোন বাধা সে সহ্য করবেনা। বালকটির মুখ ভার। সে সোফায় শুয়ে তাকায় ছাদের দিকে, সেখানে ঝুলে আছে কয়েকটি বেলুন।এখানে হয়তোবা গতকাল কিংবা কিছুদিন আগে কোন পার্টি হয়েছে। টি টেবিলে একটা দেশলাইয়ের বাক্স, সিগারেট। সে দেশলাইয়ের বাক্স হাতে নেয়। একটা কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেট ধরানোর মত ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। পরক্ষনেই দেশলাইয়ের আগুন দিয়ে সে বেলুন ফাটাতে থাকে। একটা শিশু যখন বড়দের মত আচরণ করে তখন তা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের হাসির উদ্রেক করে কিংবা ইচরেপাকা উপাধি পায়। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিতে ছেলেটির অভিব্যাক্তির কারণে, নির্মাণের কৌশলে আমাদের একটু অন্যভাবে ভাবায়। একটু সিরিয়াসলিই আমাদের ছবির শেষ পর্যন্ত যেতে হয়।
সাধারণভাবে দেখলে এই দৃশ্যের মধ্যে এক নিঃসঙ্গ শিশুর ছায়া দেখতে পাই। যার শৈশবের আনন্দ এই নি:সঙ্গতার যাঁতাকলে পিষ্ট, ঘরবন্দী। ঘরবন্দী এই জীবনে সে তার মত করে স্বাধীনতা খুঁজে ফিরছে। বড়দের মদ্যপানের মত সে কোমল পানীয় পান করে, সিগারেটের আগুন জ্বালানোর অভিনয় করে। কিন্তু একটু গভীরে চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি এটা আসলে সেই ঘুনেধরা সমাজের চিত্র যে সমাজ ছুটছে সম্পদের পেছনে,ভোগের পেছনে, একটা তথাকথিত সামাজিক অবস্থান অর্জনের পেছনে। সেখানে একটি শিশুর আনন্দ ঘোরপাক খায় যান্ত্রিক খেলনায়। আগুন দিয়ে বেলুন ফাটানো, সেকি তার নিছক বিনোদন? না ধ্বংসাত্মক মনের প্রতিফলন? আনন্দের আয়োজনও তার কাছে তুচ্ছ? কেন এইসব বিষয়ের অবতারনা করছি তা পরিস্কার হয়ে যাবে ছবিটির পরের কিছু দৃশ্যে।
বালক তার নিজের ঘরে যায়। সেখানে সাজানো আছে নানা ধরনের আধুনিক খেলনা। মাংকি ড্রাম, মাংকি ভায়োলিন,খেলনা রোবট, মুখোশ, ক্লারিওনেট। ফ্লোরে সাজানে প্লাস্টিকের মনুমেন্ট। কিশোর নেপথ্যেএকটি বাঁশের বাঁশির সুর শুনতে পায়। সে এগিয়ে যায় জানালার দিকে। সেখান থেকে দেখতে পায় তার বাসার নিচে একটা ঝুপড়ি ঘরের পাশে তার বয়সী আরেক শিশু আপনমনে বাঁশি বাজাচ্ছে। সে দৌড়ে গিয়ে তার ক্লারিওনেট নিয়ে আসে। সেও বাজায়। ঝুপড়ি ঘরের দরিদ্র ছেলেটিও সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে। সেও আরো জোরে বাজায়। কিন্তু একসময় বাঁশের বাঁশির সুর চাপা পড়ে যায় আধুনিক প্রযুক্তির ক্লারিওনেটের কাছে। এবার ঝুপড়ি ঘরের ছেলেটি তার খেলনার ঢোল নিয়ে আসে এবং নেচে নেচে বাজায়। ধনি ছেলেটি নিয়ে আসে মাংকি ড্রাম। এবারও ঢোল পরাজিত হয় আধুনিক প্রযুক্তির মাংকি ড্রামের কাছে।দরিদ্র ছেলেটি এবার মুখোশ পরে খেলনার তীর ধনুক হাতে এসে নাচতে থাকে। এর জবাবে ধনী ছেলেটি মুখোশ পরে তার উন্নত প্রযুক্তির তৈরী তলোয়ার, বন্দুক নিয়ে আসে।বন্দুকের গর্জনে দরিদ্র ছেলেটির নাচের ছন্দ থেমে যায়। ধনী ছেলেটির মুখে বিজয়ের হাসি। সে এবার মুখের চুইংগাম বের করে খেলনা রোবটের কপালে লাগিয়ে দেয় জয়টিকা।
প্রিয় পাঠক, এই যে দরিদ্র ছেলেটির আপনমনে বাঁশি বাজানো দেখে ধনী ছেলেটি খেপে যায় সেকি কেবলি শিশু মনের জেদ? স্বাধীন মুক্ত আকাশের নিচে দরিদ্র ছেলেটিকে দেখে, ঘরবন্দী ধনী ছেলেটির মানবিক বিপর্যয়? আসলে ছেলেটির ভুবন তৈরী হয়েছে বুর্জোয়ার সমাজ ব্যাবস্থার ছায়াতলে, যে সমাজ তাকে সবকিছুতেই তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে শিখিয়েছে এবং সেটা বল প্রয়োগ করে হলেও, ভোগ করতে শিখিয়েছে। তাই দরিদ্র ছেলেটির মুক্ত আকাশের নিচে বাঁশি বাজানো তার সহ্য হয়না।সে থামিয়ে দিতে চায় তার ঢোল, তার খেলনা তীর ধনুক।তার কাছে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির খেলনা বন্দুক। এখানে সাম্রাজ্যবাদ কিংবা সামন্তবাদের একটা রূপ দেখতে পাই। যদি ছবিটি নির্মানকালের দিকে তাকাই তাহলে দেখি এটা ১৯৬৪ সাল, যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছিল, যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হিংস্র নখরের থাবা বসিয়েছে ভিয়েতনাম সাম্যবাদী শিবিরে।এই যে দরিদ্র ছেলেটির বাঁশির সুর, ঢোল, খেলনা ধনুক থামিয়ে দেয় সম্ভ্রান্ত ধনি ঘরের ছেলেটি তার উন্নত প্রযুক্তির খেলনা বন্দুকের গর্জনে, জংলি অট্টহাস্যে সেটা কি কেবলি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা?আসুন পরবর্তি দৃশ্যগুলো দেখে আসি।
দরিদ্র ছেলেটিকে হারিয়ে বিজয়ী ছেলেটি যখন ফ্রিজ খুলে আপেলে কামড় বসিয়েছে তখন সে জানালা দিয়ে একটি ঘুড়ি দেখতে পায়। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখল দরিদ্র ছেলেটি আপনমনে আকাশে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। এবার ধনী ছেলেটি গুলতি নিয়ে আসে। দুইবার গুলতি দিয়ে ঘুড়ি ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যার্থ হয়। সেই ব্যার্থতায় হাসি উপহার দেয় দরিদ্র ছেলেটি।এইবার ক্ষেপে যায় ধনী ছেলেটি। সে হাতে নেয় সেই মোক্ষম অস্ত্র। এয়ারগানে গুলি ভরে এক শটেই সে ছিঁড়ে ফেলে ঘুড়ি।কুইক ঝুম শটে ক্লোজআপে আমরা দেখতে পাই ছেলেটির মুখ। কান্না আসার আগে শিশুদের মুখে যে অভিব্যক্তি আসে সেই অভিব্যক্তি।সেই মুখাবয়বে ছিল রাগ, অভিমানের এক মিশ্রন যা দেখলে মনের ভেতর একটা মোচড় দিবেই। সেই শিশুমুখ যেন ধিক্কার দিচ্ছে গায়ে পড়ে যুদ্ধের দামামা বাজানো বিশ্ব মোড়লদের প্রতি।দরিদ্র ছেলেটি ছেঁড়া ঘুড়ি নিয়ে ফিরে যার তার ঝুপড়ি ঘরে। বিজয়ী ধনী ছেলেটি ফিরে আসে তার খেলনার কাছে। সব খেলনা সে আবার চালু করে। খেলনা রোবট চালু করে। আবার শুরু হয় যান্ত্রিক খেলনার গর্জন।এইসব গর্জন ছাপিয়ে আবার ভেসে আসে সেই বাঁশির সুর। এইবার হতাশ হয় ধনী ছেলেটি। খেলনা রোবট চলতে চলতে ভেঙ্গে ফেলে তার মনুমেন্ট, বাঁশির সুরের সাথে এক ধমকা হাওয়া এসে ফেলে দেয় তার খেলনা। গল্প এখানেই শেষ হয়।
বলছিলাম ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমনের কথা, সামন্তবাদের কথা। ধনী ছেলেটি তৃতীয় বারের মত যখন বন্ধুক নিয়ে আসে তখন তার ঠোঁটের উপর একটা অঙ্কিত বড় গোঁফ দেখতে পাই, যে গোঁফ দেখা যেত তৎকালীন সামন্তবাদের প্রতিনিধি রাজা ও জমিদারের মুখে। প্রথম থেকেই ছেলেটির হাঁটাচলায়, অভিব্যাক্তিতে এক ভোগী জমিদারের ছায়া দেখতে পাই। সত্যজিৎ রায় এক ধনী পরিবারের নি:সঙ্গ শিশুর গল্পের ছায়ায়, দুই শিশুর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় আমাদের দেখিয়েছেন বুর্জোয়া শ্রেনী, সাম্রাজ্যবাদের চেহারা এবং পরিশেষে শুনিয়েছেন শান্তির বার্তা। তাই সিনেমা শেষ হয় ঝুপড়ি ঘরের ছেলেটির বাঁশির সুরে। যে সুরে ভেঙ্গে যায় সামন্তবাদের অহংকার, ভেঙ্গে যায় সাম্রাজ্যবাদের মনুমেন্ট যা যত্নের সাথে ছেলেটি তৈরী করেছিল। দরিদ্র ছেলেটির ঘুড়ি সাম্রাজ্যবাদের আকাশে সাম্যবাদের মুক্তির ঘুড়ি যা সাম্রাজ্যবাদের আঘাতে ছিঁড়ে যায়, ভুপতিত হয়। তবুও ছেঁড়া ঘুড়ি ছেলেটি ফেলে দেয়না। হয়তো আবার সে এই ঘুড়ি নতুন করে তৈরী করবে। আবার আকাশে ছড়িয়ে দেবে মুক্তির বার্তা। বাতাসে বাঁশির সুরে ছড়িয়ে দেবে শান্তির বার্তা।মাত্র পনেরো মিনিটের সংলাপহীন এ চলচ্চিত্রে যুদ্ধ, বিশ্ব রাজনীতি, শ্রেনীদ্বন্দ্ব ইত্যাদি এত সুনিপুন ভাবে তুলে ধরা একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভব।
তথ্যসুত্র: উইকিপিডিয়া, বিষয় চলচ্চিত্র : সত্যজিৎ রায়।
শ্যামল কান্তি ধর: ব্যাংকার