• উন্নতমানের মাস্কের কথা বলে দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের মাস্ক।
• ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছেন ভেজাল পিপিইর কারণে।
• আমার পরামর্শ মানা-না মানা প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। আমার তো কোন নির্বাহী ক্ষমতা নেই।
• শারীরিক দূরত্ব মেনে না চললে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়বে।
• অনিয়মের প্রতিবাদকারী চিকিৎসকদের বদলি করা ঠিক হয়নি।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি, পিপিই সংকট, ডাক্তার আক্রান্ত, হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি ঘাটতি, প্রতিদিনের আলোচনার বিষয়। দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন দুইজন ডাক্তার, এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।
এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণে জানতে চাই।
আমরা এখনও করোনার ঝুঁকির মধ্যে আছি। মানুষ লকডাউন ঠিক মতো মানছেন না। কেউ ঠিক মতো কথা শুনছেন না। এখন তো করোনার ঝুঁকি একটু বেশি মনে হচ্ছে।
এখন করণীয় কী?
আমি বার বার বলছি, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে। খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হবেন না। মানুষ তো আর পারছে না। তারা বিরক্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে, যারা দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রিকশা-ভ্যানগাড়ির চালক—তারা পেটের দায়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। এটা নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল।
ঢাকায় এমন অনেক মেস আছে যেখানে চার পাঁচজন এক ঘরে থাকেন। আমরা যে বলি শারীরিক দূরত্ব তিন থেকে পাঁচ ফুট রাখতে, সেটা কি তারা পারবে? এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এসব নানাবিধ কারণে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে তো আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে?
আমি যদিও আশার কথা শোনানোর চেষ্টা করি, তারপরও বলছি, আমরা ঝুঁকিমুক্ত নই। আমি অনুমান করে বলেছিলাম, মে মাসে করোনার প্রভাব কমে আসবে। চলমান লকডাউনকে বিবেচনায় নিয়ে কথাটা বলেছিলাম। এখন গার্মেন্টস কারখানা, মার্কেট খুলে দেওয়ার কথা শুনছি। যদি শারীরিক দূরত্ব মেনে না চলা হয়, তাহলে আমার এই কথা কতটুকু সত্য হবে জানি না। ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। শারীরিক দূরত্ব মেনে না চললে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়বে।
আমরা ঝুঁকিমুক্ত নই এবং আরও ঝুঁকির দিকে যাচ্ছি…
আমরা ঝুঁকিমুক্ত নই। তবে আমরা যেন নিরাশ না হই। আতঙ্কগ্রস্ত যেন না হই। আমাদের ঝুঁকি মোকাবিলা করেই চলতে হবে। এ সমস্যা শুধু আমাদের নয়। সারা বিশ্বেই একই সমস্যা। আমেরিকার মতো দেশেও লকডাউন তুলে নেওয়ার জন্যে মিছিল হয়েছে।
আমরা তো তাদের থেকে কোনো শিক্ষা নেইনি?
এ কথা সত্য। শিক্ষা নিতে চাইলেও তো পারা যায় না। যেমন, একটি বড় অফিসের চার ড্রাইভার এক রুমে থাকেন। তারা সবাই করোনা পজিটিভ। তাদের আইসোলেশনে থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। পরে বলে-কয়ে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরকম অনেকে আছেন। আমি সহজে পরামর্শ দিতে পারি। কিন্তু, তা বাস্তবায়ন করা সহজ না।
এরপরের বিষয় হলো: আমরা যদি খাদ্যসামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারতাম, তাহলেও হয়তো অনেকে লকডাউন মানতেন। সেটাও তো আমরা পারছি না। ত্রাণ নেওয়ার লাইনও দীর্ঘ। ঘাড়ের ওপর মানুষ এসে পড়ছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে চলা হয় না।
প্রথম দিকে আপনি বলেছিলেন—‘সরকারের সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে’। কিন্তু, করোনা ধরা পড়ার পর দেখা গেল—পিপিই সংকট, ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছেন, হাসপাতালগুলোর কোনো প্রস্তুতি নেই ইত্যাদি।
এটা তো প্রশাসনের বিষয়। আমি প্রশাসনের কথাই বলেছিলাম। সেটা আমার ব্যক্তিগত কথা ছিল না। মন্ত্রী, সচিব—এরাইতো এ বিষয়গুলো দেখেন। মানুষ যে কথা মানবে না তা তারা ভাবতেও পারেন নি। আর রোগীর সংখ্যা বাড়লে যা হয়!
পিপিই যেখান থেকে আসবে সেখান থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে না। তার ওপর আবার নকল জিনিস। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না—মাস্ক ভেজাল, গাউন ভেজাল। ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছেন কেন? ভেজাল পিপিইর কারণেই তো হচ্ছেন। ডাক্তারদের নিরাপত্তা-সুরক্ষা সবচেয়ে জরুরি। ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল কর্মী সবারই সুরক্ষা জরুরি। যারা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তারাই যদি আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে চলে যান তাহলে রোগীদের দেখবে কে? আমি এ কথা বারবার বলছি।
আপনি দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, আপনি বলছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের। অথচ তা মানা হচ্ছে না। তাহলে গলদটা কোথায়?
আমি তো ব্যক্তিগত জায়গা থেকে শুধু পরামর্শ দিতে পারি। আমি তো প্রশাসনের লোক না। আর আমার পরামর্শ মানা-না মানা প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। আমার তো কোন নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কাজ করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যদের।
পুলিশ-নিরাপত্তাকর্মী, সাংবাদিকসহ যারা সম্মুখ-যুদ্ধে আছেন তাদের সুরক্ষা দেওয়া দরকার। পুলিশ সদস্যরা অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের সুরক্ষা দিতে না পারলে একসময় তারা কাজে যোগ দিতে উৎসাহ হারাবেন। অথবা ভয় পাবেন। তাদেরও তো পরিবার আছে। তারা আক্রান্ত হলে তাদের পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আমি মনে করি, সবারই প্রণোদনা ও স্বাস্থ্যবীমা দরকার। যাতে তারা স্বাচ্ছন্দে কাজ করতে পারেন।
এই সুরক্ষা দেবে কে?
সুরক্ষা দেওয়ার প্রশাসনিক দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের।
তাহলে সুরক্ষা দিতে মন্ত্রণালয় কি ব্যর্থ হচ্ছে না?
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছুটাতো ব্যর্থ হচ্ছেই। মন্ত্রণালয় যেহেতু সুরক্ষা দিতে পারছে না তাহলে ব্যর্থ তো বলা যায়। ডাক্তারদের অভিযোগ তো একটাই। তারা শুরু থেকেই পিপিই চাইছিলেন। সময় মতো পিপিই সরবরাহ করা হয়নি। তাহলে তারা রোগী দেখবেন কীভাবে? আবার যদি নিম্নমানের পিপিই দেওয়া হয় সেটাও তো সমস্যা। উন্নতমানের মাস্কের কথা বলে দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের মাস্ক। তাহলে ভুল শুরুতেই একটা হয়ে গেল।
যেসব চিকিৎসক এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন তাদেরকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তও ঠিক হয়নি। এমন সংকটের সময় অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তাদেরকে সরিয়ে দিবে—এটা ঠিক না।
এমন পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জন্যে আপনার পরামর্শ?
আমরা এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছি। যেহেতু কোনো ভ্যাকসিন নেই, কার্যকর ওষুধ নেই, তাই আক্রান্ত হয়ে গেলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। নিজেদেরকেই নিজেদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যেখানে-সেখানে থুতু-কফ ফেলবেন না। টিস্যু-রুমাল ব্যবহার করবেন। খুব দরকার না হলে ঘরের বাইরে যাবেন না।
আপনি ঘরে থাকলে শুধু নিজেকে নিরাপদ রাখবেন না, অন্যকেও নিরাপদ রাখবেন। আপনি বাইরে গেলে অন্য কারো মাধ্যমে কোন না কোনভাবে আপনার শরীরে ভাইরাস আসতে পারে। ফলে আপনি আক্রান্ত হবেন, আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও আক্রান্ত হবে।
যতদূর সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মনে চলবেন। বিশেষ করে, ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। খাবার ভালো করে সেদ্ধ করে খাবেন। বয়ষ্ক ব্যক্তিরা, যাদের অন্যান্য রোগ আছে তারা যেন বাইরে না যান। তাদের ঝুঁকি বেশি। যতদিন পর্যন্ত আমরা ঝুঁকিমুক্ত না হই ততদিন এসব মেনে চলতে হবে।