আমি যখন লেখাটি লিখছি, কিংবা আপনি যে মুহূর্তে পিসি অথবা স্মার্টফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে লেখাটি পড়ছেন – ঠিক সে মুহূর্তে হয়তো ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ সিরিয়া আরেকটি শিশুর আর্তনাদের সাক্ষী হতে যাচ্ছে। যার কান্না হয়তো মানুষের কানে যায়না। মায়ের বুকে মুখ লুকোনো ভয়ার্ত নীল চোখের শিশু থেকে শুরু করে মধ্যরাতে আকাশ পানে চেয়ে থাকা নববিবাহিত তরুণ – সবার চোখে শ্রান্তির ভাব। তাদের ক্লান্তিই বলে দিচ্ছে কতটা অসহায় হলে একজন মানুষ শরণার্থী হয়ে কুকুরের মতো বাস করে। এর থেকে বাদ যায়না বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধ – যার একসময় অসাধারণ যৌবন ছিল।
সিরিয়া এমন একটি দেশ যাদের দীর্ঘশ্বাস আকাশে মিলায়। গত এক দশকে সাজানো-গোছানো সুন্দর দেশ থেকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সালের আরব বসন্তের হাওয়া যখনই সিরিয়ায় গিয়ে লেগেছে, তখন থেকেই শুরু এক ধ্বংসযজ্ঞের। যার শেষ এখনো হয়নি বরং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সময়টা হবে আরও দীর্ঘতর।
যুদ্ধ-বিগ্রহে জর্জরিত দেশটির আয়তন প্রায় ৭২ হাজার বর্গমাইল। জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি (যার মধ্যে বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে রয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ)। জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ মুসলিম, ১৫ ভাগ খ্রিস্টান এবং ১০ ভাগ অন্যান্য। ১৪ টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত দেশটির রাজধানী দামেস্ক হলেও আলেপ্পো এর সর্ববৃহৎ এবং জনঅধ্যুষিত শহর। মুসলিমদের মধ্যে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ক্ষমতা এবং সামরিক বাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া। নানান জাতি-ধর্ম-বর্ণের বৈচিত্র্যময় দেশটি দীর্ঘ বিদ্রোহ সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে ফরাসি উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বিশেষ করে দেশটির জটিল ভৌগলিক সীমা একে করে তুলেছে তাৎপর্যপূর্ণ। সিরিয়ার উত্তরে তুরস্ক, দক্ষিণে জর্ডান, দক্ষিণ-পশ্চিমে ইসরাইল, পশ্চিমে লেবানন এবং পূর্বে ইরাক। ইতিহাসের অন্যতম সুপ্রাচীন এই দেশটি সমৃদ্ধ মানবসভ্যতা গঠনে যেমন ভূমিকা রেখেছে, ঠিক তেমনি এর ধর্মীয় ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব – দেশটিকে করেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ করে তিন আব্রাহামিক রিলিজিয়ন ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং যায়োনিজমের অনুসারীদের কাছে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়াও একে নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মিথ।
ইসলাম ধর্মবিশ্বাসে সিরিয়া একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থান। গুরুত্বের দিক থেকে এর স্থান মক্কা-মদিনার পরে। হাদিসে সিরিয়াকে “বিলাদুশ শাম” নামে অভিহিত করা হয়েছে। মূলত বিলাদুশ শাম বলতে সিরিয়া ও এর আশেপাশের দেশ ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডান ও মিশরকে বোঝায়। ইসলামিক ফেইথে সিরিয়ার তাৎপর্য মূলত হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর ভবিষ্যতবাণীর জন্য ফুটে উঠেছে। রাসুল (সা.) তার জীবদ্দশায় সিরিয়া (বিলাদুশ শাম) নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন।
- • রাসুল (সা.) বলেছেন :
- “শাম ধ্বংস হলে উম্মতের জন্য কোনো কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবেনা।”
- -(সুনানে ইবনে তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ)।
- • তিনি সিরিয়ার জন্য দু’আ করে গেছেন। হাদিসে আছে,
- “হে আল্লাহ! আমাদের শামে বরকত দাও। আমাদের ইয়েমেনে বরকত দাও।”
- (সহিহ বুখারি, হাদিস নং – ৬৬৮১)।
- • অন্য এক হাদিসে আছে রাসুল (সা.) বলেছেন,
- “মহাযুদ্ধের আগে মুসলমানদের তাঁবু (সেনা ঘাঁটি) হবে শামের সর্বোন্নত নগরী দামেস্কের নিকটস্থ আল গুতা অঞ্চলে।”
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং – ৪২৯৮)।
এখানে মহাযুদ্ধ বলতে কেয়ামতের আগে ঘটিতব্য শামের যুদ্ধ যেটাকে হাদিসে “মালহামা” বা “মহাযুদ্ধ” বলা হয়েছে। মুসলিম ধর্মবিশ্বাসে “মালহামা” ইতিহাসের চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব মীমাংসাকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শাম বা আজকের সিরিয়া হবে মুসলমানদের জন্য অপরাজেয় ঘাঁটি। মুসলিমরা বিশ্বাস করে, শেষ জামানায় নেতৃত্বশূন্য মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ইমাম মাহদীর আগমন ঘটবে। ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে মুসলিমরা বিলাদুশ শামে ইহুদি-খ্রিস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেবেন। যুদ্ধ সমাপ্তির সপ্তম বছরে দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। দাজ্জাল থেকে বাঁচার জন্য মুসলিমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। একসময় আল্লাহ ঈসা (আ.) কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের সাদা মিনারায় অবতরণ করবেন এবং ইহুদি দাজ্জালকে ধাওয়া করে ইসরাইলের “লুদ” ফটকে হত্যা করবেন।
সিরিয়া নিয়ে খ্রিষ্টানদের মধ্যে নানান ধরনের মিথ রয়েছে। বাইবেলের একটি চ্যাপ্টারের নামই আছে “The War of Armageddon” বা শুভ-অশুভর চূড়ান্ত লড়াই। এখানে “আরমাগেদন” একটি রণক্ষেত্র। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসমতে, যিশু আরমাগেদনে শয়তানি শক্তি বা সকল অ-খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সত্যকে বিজয়ী করবেন। এটাকে “শুভ-অশুভর চূড়ান্ত লড়াই” বলে অভিহিত করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আজকের সিরিয়াই কি ইতিহাসের আরমাগেদন? ধারণা করা হচ্ছে তা-ই।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার 1999 : Victory Without War বইয়ে লিখেছেন “১৯৯৯ সাল নাগাদ আমেরিকা বিশ্ব শাসকে পরিণত হবে এবং এই ‘বিজয়’ তারা যুদ্ধ ছাড়াই অর্জন করবে। উল্লেখিত সাল নাগাদ মসিহ’র সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমেরিকার দায়িত্ব এসব ব্যবস্থাপনাকে সম্পন্ন করা পর্যন্ত। তারপর মসিহ রাজ্য পরিচালনা করবেন।
যায়োনিজম বা ইহুদীবাদে সিরিয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। যায়োনিস্টদের কাছে বিলাদুশ শাম (সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, মিশর) গুরুত্বপূর্ণ মূলত দাজ্জালকে কেন্দ্র করে। ইহুদি ধর্মবিশ্বাসে দাজ্জাল হলেন তাদের ” সম্রাট” বা “রাজা”। তারা বিশ্বাস করে দাজ্জাল বিশ্বব্যাপী ইহুদী রাজত্ব কায়েম করে সমস্ত ইহুদিদেরকে বায়তুল মোকাদ্দাসে (ফিলিস্তিনে অবস্থিত) অভিবাসন দান করবেন। দাজ্জালের জন্য ইহুদি ধর্মপ্রচারকরা আকুল আগ্রহের কারণ তারা বিশ্বাস করে দাজ্জাল আসার পরে পৃথিবীতে ইহুদীদের জন্য আর কোন শঙ্কা থাকবেনা। দাজ্জাল সমস্ত সন্ত্রাসবাদীদেরকে নির্মূল করে সর্বত্র শান্তি স্থাপন করবেন।
ইহুদীরা বিশ্বাস করে, জেরুজালেমের দক্ষিণ ফটক ‘বাবে লুদ্দে’ ইহুদি রক্ষাকর্তা দাজ্জাল অবতরণ করবেন। তিনি ইহুদিদেরকে নিয়ে ম্যাগডের মাঠে অশুভর বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে বিশ্বব্যাপী ইহুদি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন।
এখানে ম্যাগডের মাঠ একটি সুপ্রাচীন বাণিজ্যপথ যার বিস্তৃতি ঘটেছে ফিলিস্তিন, মিসর, জর্ডান, তুরস্ক এবং সিরিয়ায়। এজন্য সিরিয়া বা বিলাদুশ শাম ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে ইহুদিদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সিরিয়ার ধর্মীয় গুরুত্ব নিয়ে আব্রাহামিক রিলিজিয়নের অনুসারীদের আগ্রহের নিচে একটা একটা নির্মম সত্য চাপা পড়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে দেশটিতে নির্মমতার শিকার হাজারো শিশু-বৃদ্ধবণিতা। এরা রাজনীতির প্যাঁচ বোঝেনা। তবে একটা কথা বলাই যায়, ভূ-মধ্যসাগরে ভেসে থাকা আইলান কুর্দির লাশ কিংবা তার মতো হাজারে শিশুর বুকচাপা কান্না চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যায় অনেক কিছু। অন্ধত্বের কালো চশমা সেঁটে আঙ্গুল উঁচিয়ে যত মানবাধিকারের কথা বলবো, হাজারো লাশের গন্ধকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইবো, ঠিক ততই আইলান কুর্দিরা আমাদের দেখে হাসবে তাচ্ছিল্যের হাসি।