এক সপ্তাহ আগে, গত ৮ এপ্রিল, যখন কোভিড-১৯ আক্রান্ত ডা. মো. মঈন উদ্দিনকে সিলেট থেকে ঢাকায় রেফার করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে কেনো তাকে সিলেটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করা হলো না। নাকি সিলেটের আইসিইউ সচল নয়। সে রাতেই জরুরি একটি সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বুধবার ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে তার মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে আবারো আলোচনা শুরু হয়েছে।
ডা. মঈন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং এখন পর্যন্ত দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা একমাত্র ডাক্তার।
গত ৫ এপ্রিল তার করোনা শনাক্ত হয় এবং ৭ এপ্রিল তাকে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে স্থাপিত করোনা আইসোলেশন সেন্টারে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালটি ওসমানী হাসপাতালের অধীন একটি ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এবং করোনা আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ঘোষণার পর একটি দুই শয্যার আইসিইউ ইউনিট এখানে স্থাপন করা হয়েছে।
হাসপাতালটির আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুশান্ত কুমার মহাপাত্র বলেন, ‘ডা. মঈন উদ্দিনের শারীরিক অবস্থা আইসিইউতে রাখার মতো খারাপ ছিল না। অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার পর তার অবস্থা স্বাভাবিকই ছিল। যেহেতু এখানকার আইসিইউ নতুন, আর ওসমানী মেডিকেলের আইসিইউ অনেকদিন ধরে সচল; তাই তিনি প্রথমে সেখানে যেতে চান। কিন্তু সেখানে তাকে ভর্তি না করতে পারায় তিনি ঢাকায় যেতে চান।’
ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউতে কেনো তাকে ভর্তি করা যায়নি, এ ব্যাপারে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় আলাদা ইউনিট করার নির্দেশনা থাকায় আমরা পুরো শামসুদ্দিন হাসপাতালকে করোনা আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ঘোষণা করি, যাতে মূল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি করোনামুক্ত রাখা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু ওসমানী মেডিকেলের আইসিইউতে সব ধরণের রোগী আছেন, তাই এখানে ডা. মঈনকে ভর্তি করা যায়নি। পরে তিনি ঢাকায় যেতে চাইলে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাকে ঢাকায় রেফার করি। সরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় তিনি বেসরকারি একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে ঢাকায় যান। ওনাকে আইসিইউতে ভর্তির ব্যাপারে কোনো ব্যক্তিগত কিছু ছিল না, আর ওনার মৃত্যুতে আমরাও শোকাহত।’
সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘শামসুদ্দিন হাসপাতালটি মূলত সদর হাসপাতাল ছিল। আর এটিই দেশে একমাত্র সদর হাসপাতাল যা স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে নয়, বরং ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধীনে। যেহেতু হাসপাতালটির পরিচালকের হাতে দুটি হাসপাতাল ছিল, তিনি শামসুদ্দিন হাসপাতালকে করোনা সেন্টার হিসেবে নির্বাচিত করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘উনি চেয়েছেন মূল হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসা বজায় রেখে করোনা রোগীদের পৃথকভাবে চিকিৎসা করতে। আর এ কারণেই ডা. মঈনকে ওসমানী মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়নি।’
এরই মধ্যে শামসুদ্দিন হাসপাতালে আরও নয়টি আইসিইউ বেড ও নয়টি ভেন্টিলেটর আনা হয়েছে এবং বড়মাপের একটি আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
তবে হাসপাতাল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এ বক্তব্যের পরেও ডা. মঈনের সহকর্মী ও অন্যান্য ডাক্তারদের দাবি, কর্তৃপক্ষ চাইলে ওসমানী মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া যেতো তাকে।
মেডিকেল কলেজটির মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক আ.ফ.ম. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ডা. মঈনের মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। এটা একটা মহামারি, সবাই ঝুঁকিতে রয়েছেন। আর যারা স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আইসিইউ মানে, যখন যেখানে যেটা প্রয়োজন সেটা দেওয়া। আমার মতে, সিলেটে যেহেতু ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটা প্রতিষ্ঠিত আইসিইউ ইউনিট আছে, আর কোভিড-১৯ যেহেতু একটা জরুরি অবস্থা, তাই উচিত ছিল হাসপাতালের আইসিইউটিকেই কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড করা।’
তিনি বলেন, ‘আইসিইউ তো ক্রিটিক্যাল পেশেন্টদের জন্য। সিলেটে আইসিইউ থাকা অবস্থায় একজন ডাক্তারকে, বা হোকনা কোনো একজন সাধারণ রোগীকে বা একটা ক্রিটিক্যাল পেশেন্টকে, এখানে ভর্তি করা হলো না। এটাই ব্যথা ও দুঃখ।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডা. মঈন সিলেট আইসিইউতে থাকলে, আমরা মনে হয় ওভারকাম করতে পারতাম এই ডিজিজটা।’