ভোরের আলো ডেষ্ক: করোনা প্রকোপের জন্য পাশ্চাত্যের মিডিয়া চীনকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। চীনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যই করোনাভাইরাস যে গোটা দুনিয়াকে আজ চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তা নিয়ে আর সন্দেহ নেই ইউরোপ ও আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমের। চীনের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউডএইচও)-র অসাধু আঁতাতের বিষয়টিও সামনে উঠে এসেছে। বেইজিং যদি সময় মতো উহানে করোনার প্রকোপ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলকে সতর্ক করতো, তাহলে পরিস্থিতি এতো জটিল হতো না। বহু প্রাণ রক্ষা পেত। কিন্তু কমিউনিস্ট দেশটি কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিষয়টি ধামা চাপা দিয়ে উরোপ ও আমেরিকাকে বিপদের মুখে টেলে দিয়েছে। আর এখন নিজেদের বিপদ সামলে সাহায্যের নামে নিম্নমানের কিট সরবরাহ করছে বিভিন্ন দেশে। এমনটাই উঠে আসছে পশ্চিমা দুনিয়ার মিডিয়া রিপোর্টে।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এখনও বলছে, করোনাভাইরাস চীনের গোপন জৈব রাসায়নিক অস্ত্রাগার থেকে লিক হয়েছে। আর তার জেরেই চলছে মৃত্যুর মিছিল। চীন অবশ্য এই তথ্য অস্বীকার করে আমেরিকাকে কাঠগড়ায় তুলতে ব্যস্ত। মোসাদের বক্তব্য অবশ্য এখনও প্রমাণ স্বাপেক্ষ। করোনাভাইরাস ম্যান মেড কিনা সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরাও নিশ্চিত নন। তবে ঘটনা পরম্পরায় এটা স্পষ্ট, সমাজতান্ত্রিক দেশটির কারণেই গোটা দুনিয়া আজ সংকটে। চীনে করোনা সংক্রমণ গত বছর ডিসেম্বরে শুরু হয়। বছরের শুরুতেই এক জন মারা যান। চীন বিষয়টি চেপে গিয়েছিল। চীনা সংবাদমাধ্যমকে সেন্সর করা হয়। চিকিৎসকদেরও মুখ বন্ধ করে দেয় চীন। সামাজিক গণমাধ্যমে তবু কিছুটা আভাস পায় দুনিয়া। কিন্তু তেমনভাবে কিছুই জানা যায়নি। ইউরোপিয়ান সান টাইমস এবিষয়ে কড়া সমালোচনা করেছে চীনের। আমেরিকার ইউএস নিউজ এবং নেশন রিভিউ-ও চীনের এই অতি গোপনীয়তায় বিস্ময় প্রকাশ করে। সার্স (সিভিয়ার অ্যাকুউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম)-এর মতই কোভিড-১৯-এর জন্য বেইজিংকে কাঠগড়ায় তুলেছে লন্ডনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট। চীনের সামাজিক গণমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে ইউকে-র এই পত্রিকাটি জানাচ্ছে, ৬ ফেব্রুয়ারি চীনের উহানের ডা. লি ওয়েংলিয়ং-এর মৃত্যুর পরই সেখানকার ভয়াবহ ছবিটা প্রকাশ পায়। কারণ সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। চীনারাও বুঝতে পারেন কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল জানাচ্ছে, লকডাউন শেষ হতেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। উহানের আকাশ ভরে যায় মরা পোড়ানোর ছাইতে। সামাজিক গণমাধ্যমে চীন থেকেই অনেকে মন্তব্য করেন তাদের নিখোঁজ প্রিয়জনের লাশটুকুও তাদের দেখতে দেয়নি। চীন সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেও শেষমেষ ব্যর্থ হয়। ঝাঁপি থেকে ভয়ঙ্কর বেড়াল বেরিয়ে আসে। পাশ্চাত্যের মিডিয়াকূলের আশঙ্কা, অগণিত করোনা আক্রান্ত মানুষের লাশে ভারী হয়ে গিয়েছে চীনের আকাশ। দুনিয়া এখনও প্রকৃত ছবি থেকে বঞ্চিত। বাস্তব ছবিটা নাকি আরও ভয়ঙ্কর। আমেরিকার ইপোচ টাইমস-এর খবর, উহানে লাশপোড়া ছাইয়ে চাপা পড়ে রয়েছে স্বজন হারানোর কান্না। তাই চীন এখন বিষয়টি জাতিসংঘের বৈঠকে তুলতে দিচ্ছে না। জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে করোনার বিষয়টি তুলতেই দেয়নি চীন। চীনা দূত ঝাং ঝুনের দাবি, আলোচ্য সূচিতে না থাকায় করোনা নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। তাই করোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও ঠাঁই পেল না জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে।
ডেইলি এশিয়ান এজ জানাচ্ছে, ১৯৩ সদস্য বিশিষ্ট জাতিসংঘের সাধারণ সভাতেও বিষয়টি তুলতে দিতে নারাজ চীন। অবশ্য লকডাউন চলছে নিউইয়র্কে। ফলে জাতিসংঘের সদর দপ্তরেও এখন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া করোনা পরিস্থিতি তো এখন লাগামছাড়া অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সবাই ব্যস্ত চীনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে। অভিযোগ উঠছে, চীন দুনিয়াকে বিভ্রান্ত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও কাজে লাগিয়েছে। এর বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেল ডা. টেড্রো আধানমকে এই পদে নিযুক্তির বিষয়ে চীন প্রচুর সাহায্য করে। সেই ঋণ বোধ হয় এখন শোধ করছেন ডা. টেড্রো। ইথিওপিয়ার এই মানুষটির ভূমিকায় খুশি নন পাশ্চাত্যের সাংবাদিকরা। চীনে করোনা সমস্যা যখন মধ্যগগণে, সেই সময়ে টেড্রো টুইট করেন, ‘চীনা কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক তদন্তে মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশায় চীনের হুবাই প্রদেশে শনাক্তকৃত করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোনও প্রমাণ পায়নি।’ অথচ, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জার্নাল ক্যুইও শি-র ১৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় অন্য তথ্য মিলছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৭ জানুয়ারি পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে বলেন, ‘আমি ইতিমধ্যেই হুবেইয়ের প্রশাসনকে নোভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি। করোনার মহামারী রুখতে মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। বহিরাগতদের প্রবেশ কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছি।’ ৭ জানুয়ারি চিনা প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের পর ১৪ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিজির টুইট তাই অনেককেই অবাক করেছে। রহস্যের এখানেই শেষ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩০ জানুয়ারি গ্লোবাল এমার্জেন্সি ঘোষণা করে। বিশ্ব মহামারী ঘোষণা করে ১১ মার্চ। কেন এতো দেরিতে বিশ্ব মহামারীর ঘোষণা? এখানেও চীনা যোগের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই। কারণ ৩০ জানুয়ারিতেই তো জাতিসংঘের নথিভুক্ত ১৯৫টি দেশের মধ্যে করোনা আক্রান্ত দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪। আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক। করোনার প্রকোপে প্রাণ হারান ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই ঢিলেমি রহস্যের জন্ম দিচ্ছে। ১৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ড, ১৭ জানুয়ারি জাপান, ২২ জানুয়ারি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ পৌঁছে গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীরাবতা ডা. টেড্রোর চীন-প্রেমেরই পরিচায়ক বলে অনেকে মনে করছেন। ভারতসহ একাধিক দেশ জি-২০-র ভিডিও সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশের পর কিছুটা হলেও টনক নড়েছে চীনের। তাই নিজেদের ঘর সামলে এখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ইমেজ বিল্ডিং-এ নতুন খেলা শুরু করেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। চীন এখন ত্রাতার ভূমিকায় নিজেদের তুলে ধরতে ব্যস্ত। কিন্তু সেখানেও ধরা পড়েছে চীনের চালাকি। স্পেন ও চেক প্রজাতন্ত্র থেকে পাওয়া তথ্যে চোখ লাগলেই সেটা বোঝা যাবে। ১৮ মার্চ চেক প্রজাতন্ত্রকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোভিড-১৯ পরীক্ষার কিট ‘উপহার’ হিসেবে পাঠায় চীন। কিন্তু চেক সরকারি সূত্রে খবর, এর জন্য বেইজিং-এর শোনজেন বায়োইজি টেকনোলজিকে ৫ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলার পেমেন্ট করে। কিন্তু ৮০ শতাংশ কিটেরই গুণমান অতি খারাপ। স্পেনের স্প্যানিশ সেন্টার ফর হেলথ ডিরেক্টর ফার্নান্দো সিমেন জানিয়েছেন, ৭০ শতাংশ চীনা কিট খারাপ। করোনা পরীক্ষায় ১০-১৫ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু ২-৩ দিন পরও অনেক সময়ই রিপোর্ট আসে না। তাই চীনের কিট নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সবমিলিয়ে করোনা নিয়ে চীনের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশ। করোনা পরিস্থিতি সামলে তারা এর জবাব দিতে চান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের টেলি-প্রেম সেই ক্ষোভকে কমাতে ব্যর্থ হবে বলেই পাশ্চাত্য দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষেরই বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস, মানবসভ্যতার বিরুদ্ধেই দানবীয় যুদ্ধ ঘোষণা করেছে চীন। সেই যুদ্ধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকাও এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে।