লিখেছেন নাঈম আহমেদ
মুসলিম সভ্যতার অন্যতম প্রধান নিদর্শন হলো মসজিদ। যুগে যুগে যে সকল স্থানে মুসলমানরা বসতি গড়ে তুলেছে, সেখানেই তারা নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ করেছে। মুসলিম বিশ্বাস অনুসারে, ঘরে বসে নামাজ আদায়ের চেয়ে মসজিদে নামাজ আদায় করা উত্তম। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি নানা সামাজিক কার্যক্রমও সংগঠিত হতো। অর্থাৎ মসজিদ ছিল তাদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
স্থানীয় মুসল্লিদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সক্ষমতা এবং ঐতিহাসিক পরম্পরার ভিন্নতার কারণে মসজিদসমূহের নির্মাণ-শৈলীতে নানা রকমফের দেখা যায়। সম্ভবত এর একটি উত্তম নিদর্শন হলো আফ্রিকার দেশ মালির ডিজেনি শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক মসজিদ ‘দ্য গ্রেট মস্ক অব ডিজেনি’; যা আমাদের এশিয়া বা আরব অঞ্চলের মসজিদের গঠন প্রণালী থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
ডিজেনি মসজিদের নির্মাণপদ্ধতি এখন পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি’মুক্ত’! মাটি, বালু ও পানির সাহায্যে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদটি। অবশ্য দেয়ালের গাঁথুনি শক্ত করতে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর তাল গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘টোরন’।
মাটি দিয়ে নির্মিত হওয়ায় প্রতি বছরই মসজিদটির কিছু অংশ অথবা পুরো অংশ সংস্কার করতে হয়। সেই হিসেবে সম্ভবত এটিই বিশ্বের একমাত্র প্রাচীন মসজিদ, যা প্রতি বছর পুনর্নির্মাণ করতে হয়। এছাড়া এই মসজিদটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মাটি ও বালু দ্বারা নির্মিত মসজিদ।
মালির দক্ষিণাঞ্চলে সাহারা মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকাময় জমিনের বুক চিরে বয়ে গেছে বানি নদী। এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী ডিজেনি মসজিদ। দূর থেকে মসজিদটি দেখলে যে কারোর চোখে এক অসাধারণ দৃশ্যপট ফুটে উঠবে। মসজিদটির উচ্চতা প্রায় ২০ মিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ৯১ মিটার। আফ্রিকার স্থানীয় সুদানো-সাহেলাইন স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হয়েছে এটি।
১৯৮৮ সালে এই মসজিদ ও ডিজেনি শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে ডিজেনি শহরের গোড়াপত্তন ঘটে। সে হিসেবে এটি আফ্রিকান সাব-সাহারান অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন শহর। কিন্তু ১৩ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে এর অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এখানে লবণ, স্বর্ণসহ নানা মূল্যবান পণ্যের বৃহৎ বাজার গড়ে ওঠে। এ সময় বাণিজ্যিক সূত্রে অনেক মুসলিম বণিক আফ্রিকা অঞ্চলে আগমন করেন এবং তাদের সংস্পর্শে এসে অনেক স্থানীয় বাসিন্দা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
ধারণা করা হয়, ১২ থেকে ১৩ শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময় এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। কথিত আছে, সুলতান কুনবুরু ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তিনি স্বেচ্ছায় তার নিজস্ব রাজপ্রাসাদ ভেঙে সেখানে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
পরবর্তীকালে কুনবুরুর উত্তরাধিকারগণ নানা সময়ে এটির সংস্কার করেন এবং নকশায় পরিবর্তন আনেন। তবে বর্তমানে মসজিদটি যে নকশায় বর্তমান আছে, তা ১৯০৭ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ায় মসজিদটির নকশা একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। তবে সকল নকশাতেই ইসলামি নিদর্শন সুস্পষ্ট ছিল- যেমনটি এখন পর্যন্ত বহাল আছে।
অতীতকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অত্র অঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসারে এই মসজিদটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত, এখন পর্যন্ত মসজিদের রাস্তায় নিয়মিত পবিত্র কুরআন শিক্ষার আসর বসতে দেখা যায়।
মসজিদটিতে পৃথকভাবে তিনটি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। এছাড়া শতাধিক মিনার সদৃশ ছোট ছোট কাঠামো রয়েছে। মিনারগুলোর মাঝে সারিবদ্ধভাবে তাল গাছের একাধিক খন্ড গেঁথে দেয়া হয়েছে, যার সাথে খ্রিস্টান চার্চের নকশার কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
এ কারণে ১৯০০ সালে ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স দুবাইস মালি থেকে ফিরে এসে দাবি করেন, চার্চের অনুকরণে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে! তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চার্চ নয়, বরং স্থানীয় স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করেই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রচণ্ড গরমের দিনেও মসজিদটির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অত্যন্ত ঠাণ্ডা থাকে। এর অভ্যন্তরে একসাথে প্রায় ৩ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে।
মসজিদের দেয়াল ও ছাদের ভার বহন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ৯০টি মজবুত কাঠের কলাম। অভ্যন্তরে আলো, বাতাস প্রবেশ করার জন্য ছাদ ও দেয়ালে রাখা হয়েছে একাধিক জানালা। তবে সমস্যা হয় বর্ষা-মৌসুমে। এ সময় বৃষ্টির পানিতে মসজিদের দেয়াল ও ছাদ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এ কারণে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে মসজিদটির পুনর্নির্মাণ উৎসব পালিত হয়, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘লা ক্রিপিসাজি’ বা ‘পলস্তারা দিবস’। মূলত জুলাই থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত মালিতে ভাড়ি বৃষ্টিবর্ষণ হয়, এর আগেই মসজিদটি সংস্কার করে প্রস্তুত রাখা হয়।
বর্তমানে প্রতিবছর মসজিদের খুব সামান্য অংশই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারপরেও প্রতি বছর এই সংস্কারকাজ চালু রাখার মূল কারণ হচ্ছে- উৎসবটি উদযাপন করা। কেননা এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় সকলে অংশগ্রহণ করে এবং এটি তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য।
উৎসবের আগের রাতেই এলাকাবাসী পুরো শহরকে দারুণভাবে সাজায় এবং তারা আল্লাহর কাছে তাদের পাপকর্মের জন্য ক্ষমা চায়। এরপর তারা ‘লা নুটি’ নামক বিশেষ নৃত্য প্রদর্শন করে এবং রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন শোকগাথা ও ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে থাকে। তারপর সকাল থেকে তারা মসজিদ সংস্কারের কাজে শুরু করেন।
মসজিদের নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করতে পারা ডিজেনি শহরের প্রত্যেক বাসিন্দার জন্য গর্বের ব্যাপার। কেননা এটি একই সাথে তাদের কাছে সৌভাগ্য ও পুণ্যের কাজ। তবে একসাথে সকল মানুষকে এই কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
এজন্য প্রত্যেক সমাজ থেকে একটি করে প্রতিনিধি দলকে এই সংস্কার কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। তারা খুব যত্ন সহকারে দেয়ালে নতুন করে মাটির প্রলেপ প্রদান করেন এবং ক্ষতিগ্রস্থ জায়গা সংস্কার করেন। প্রায় ৮০ জন পেশাদার মিস্ত্রি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ করেন।
সাধারণত যুবকদের এই কাজে বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। তারা মাথায় ঝুড়িতে করে বানি নদী থেকে কাদা সংগ্রহ করেন এবং তা দেয়ালের প্রলেপ হিসেবে ব্যবহার করেন।
প্রত্যেক টিমকে প্রলেপ দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যাদের প্রলেপ সবচেয়ে সুন্দর হয়, তাদেরকে ৫০,০০০ আফ্রিকান ফ্রাঙ্কা (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭১ হাজার টাকা) পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এই পুরস্কার মালির অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বেশ বড় পুরস্কার- যেখানে ডিজেনি শহরের বহু মানুষের দৈনিক আয় ৭০ টাকারও নীচে!
মূল কাজে শুধুমাত্র বাছাইকৃতরা অংশগ্রহণ করতে পারলেও পদ্ধতিগতভাবে সমগ্র শহরবাসীই এতে অংশগ্রহণ করেন। এমনকি শিশুরাও তাদের সমাজের প্রতিনিধি দলকে কাদা সংগ্রহের কাজে সহায়তা করে। নারীরা তৃষ্ণার্ত শ্রমিকদের পানি পান করানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন। মজার ব্যাপার হলো, বছরের শুধুমাত্র এই একটি দিনেই নারীরা উক্ত মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন।
মসজিদ সংস্কারের এমন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার নজির সম্ভবত বর্তমান বিশ্বের আর কোথাও নেই। একটি মসজিদ পুরো ডিজেনি শহরবাসীকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। ডিজেনির মেয়র বালাসিনো ইয়ারো বলেন-
এই মসজিদ আমাদের ঐক্যের প্রতীক। প্রতিবছর এটি আমাদের একত্র হতে সহায়তা করে। প্রত্যেক গোত্রের প্রতিনিধি দলের সুষম অংশগ্রহণ এখানকার সামাজিক ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এটি আমাদের জন্য বড় ধরনের প্রাপ্তি।