লিখেছেন দীপু সারোয়ার
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসান কানাডার অভিজাত এলাকায় যে বাড়িটি কিনেছেন তার সাম্প্রতিক ছবি পেয়েছে বাংলা ট্রিবিউন। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে এ বাড়িটি কেনা হয়েছে বলে অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। এ বিষয়ে অনুসন্ধানও চালাচ্ছে সংস্থাটি। বাংলা ট্রিবিউনের কানাডার যোগাযোগ জানিয়েছে, বাড়িটি কেনার পর সেটির সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এ কাজেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন আরিফ হাসান, যার উৎস অজানা। কানাডায় নিজস্ব যোগাযোগের মাধ্যমে এই বাড়ির ছবি গত বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) তোলা হয়। আর মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাতে বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসে তার বাড়ি কেনার নথি।
এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে আরিফ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বাংলা ট্রিবিউন। তবে ফোন না ধরে বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
আর অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য দেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন দুদকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা।
আরিফ হাসানের বাড়ি কেনার নথির তথ্য:
তথ্য বলছে, ২০০০ সালের ৮ মে থেকে ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরিফ হাসানের কেনা বাড়িটি হাত বদল হয় চারবার। সর্বশেষ হাত বদলে বাড়ির মালিক হন আরিফ।
নথির তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের ৮ মে বাড়িটি কিনেছিলেন মারিয়া লার্চ ও অগাস্ট লার্চ নামে দুই ব্যক্তি। ৩ লাখ ৫৮ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কিনেছিলেন তারা। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারা বাড়িটি বিক্রি করে দেন। ক্রেতা ছিলেন জরা ইজাদিয়ান। ২৪ লাখ কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জরা ইজাদিয়ানও বাড়িটি বিক্রি করেন। এবার বাড়ির ক্রেতা ছিলেন রাফে নাদের। ২৫ লাখ ৫৫ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। সর্বশেষ বাড়িটি হাত বদল হয় ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। রাফে নাদেরের কাছ থেকে ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসান। বাড়ির মালিকানায় আরও দু’জনের নাম আছে। তারা হলেন আরিফ হাসানের স্ত্রী এমিলি ফয়েজ ও স্থানীয় বাসিন্দা সুফিয়া চৌধুরী।
প্রসঙ্গত, কানাডীয় এক ডলারের বিনিময় মূল্য (বাংলাদেশি মুদ্রায়) হলো ৬৪ টাকা ৩১ পয়সা।
অভিজাত এলাকায় আরিফ হাসানের বাড়ি:
টরন্টোর নর্থ ইয়র্ক এলাকাটি অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত। এই নর্থ ইয়র্ক এলাকাতেই বাড়িটি কিনেছেন আরিফ হাসান। নর্থ ইয়র্কের ৮২ হলিউড অ্যাভেনিউ হলো তার বাড়ির ঠিকানা। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে আরিফ হাসান টরন্টোতে উপস্থিত থেকে বাড়িটি কেনেন। পরে পুরনো বাড়ি সংস্কার করে নতুন রূপ দেন। বাংলা ট্রিবিউনের সংগ্রহে পুরনো বাড়ির ছবিটিও আছে। সংস্কার করে বাড়িটির নতুন রূপ দিতে আরিফ হাসান খরচ করেছেন ১ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার। বাড়ি বেচাকেনার লিস্টিংয়ের (নথিভুক্ত) বাইরে প্রাইভেট ডিলিংয়ের (ব্যক্তিগত যোগাযোগ) মাধ্যমে নগদে বাড়িটি কেনা হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনের কানাডার যোগাযোগ বলছে, কানাডায় বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে হাইস বা একক বাড়ির প্রতি আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। এরপর আছে কন্ডো বা অ্যাপার্টমেন্ট। আলাদা একটা স্বতন্ত্র বাড়িকে বলা হয় ডিটাচড। পাশাপাশি দু’টো বাড়ি একই জমিতে-এমন বাড়িকে বলা হয় সেমি ডিটাচড। আরিফ হাসান ডিটাচড বাড়ি কিনেছেন। তা-ও আবার ডাউন টাউনে, অভিজাত এলাকায়।
৬ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গার ওপর আরিফ হাসানের বাড়িটির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩ কোটি ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৯৮২ টাকা। আর সংস্কার বাবদ খরচ হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৪৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৭ টাকা।
টরন্টোতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টই (যা কানাডায় কন্ডো নামে পরিচিত) একটা স্বপ্ন। ডাউন টাউনে, অভিজাত এলাকায় ডিটাচড বাড়ির কেনার কথা প্রবাসীরা চিন্তাই করেন না। আরিফ হাসান সেটা কিভাবে সম্ভব করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তাদের।
ট্যাক্স ফাঁকি:
বাংলা ট্রিবিউনের কানাডার যোগাযোগ বলছে, আরিফ হাসান ও তার স্ত্রীর নাগরিকত্ব এখনও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। বিদেশিদের ক্ষেত্রে বাড়ি কিনতে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। আরিফ যে দামে বাড়ি কিনেছেন তাতে তার কর দিতে আরও অনেক খরচ হতো। এই কর বাঁচাতেই আরিফ কানাডার স্থানীয় একজনকে বাড়ির মালিকানায় বড় অংশের অংশীদার হিসেবে দেখিয়েছেন। এতে করে করের টাকা বেঁচে গেছে তার। কর ফাঁকি দেওয়ার কৌশল হিসেবেই এটি করেছেন তিনি।
নতুন বাড়িতে থাকেন না আরিফের পরিবার:
নর্থ ইয়র্কে বাড়ি কেনার পর সংস্কার কাজ শেষ হলেও ওই বাড়িতে এখনও বসবাস শুরু করেননি আরিফ ও তার পরিবার। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় আরিফ দেশে থাকলেও তার স্ত্রী এমিলি ফয়েজ থাকছেন টরন্টোতেই। সেখানে আরেকটি বাড়িতে থাকেন তিনি। দুদক ওই বাড়িটির সন্ধান করছে। এমিলি ফয়েজ বর্তমানে যে বাড়িতে বসবাস করছেন কানাডার সরকার ও প্রবাসীদের সহযোগিতা নিয়ে সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন দুদকের এক কর্মকর্তা।
আরিফের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা:
গত বছরের সেপ্টেম্বরে কানাডায় বাড়ি কিনে দেশে ফেরেন আরিফ। আর নভেম্বরে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। অবৈধ সম্পদ অর্জন, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, অর্থপাচার আর সিন্ডিকেট পরিচালনার মাধ্যমে দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগে আরিফের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয় গত বছরের ১৮ নভেম্বর। নভেম্বরেই তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে দুদক।
আরিফের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপারকে (ইমিগ্রেশন) পাঠান দুদকের সহকারী পরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১) মো. শফি উল্লাহ।
চিঠিতে আরিফের জন্মস্থান কুমিল্লা এবং দু’টি ঠিকানা উল্লেখ করা হয়। তার বাবার নাম আবদুল আজিজ এবং মায়ের নাম মালেকা পারভীন। ঠিকানা দু’টি হলো বাড়ি-১৮/এ, সড়ক-৪৪, গুলশান উত্তর, ঢাকা-১২১২ এবং অ্যাপার্টমেন্ট-বি-৩/ডি, বাসা-১৫, পুরাতন ডিএএইচএস, বনানী।
চিঠির তথ্য অনুযায়ী, আরিফের জন্ম তারিখ হলো ১৯৭৪ সালে ২৭ জুন। তিনি যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে কানাডা সফর করেন সেটির ইস্যুর তারিখ হলো ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর।
ঘন ঘন পাসপোর্ট পরিবর্তন:
২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬ বার পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন আরিফ হাসান। এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছে দুদক। কোন পাসপোর্টে কী ধরনের তথ্য গোপন করেছেন আরিফ তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘন ঘন পাসপোর্ট পরিবর্তনের কারণ নিয়ে দুদককে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি আরিফ।
দুদক বলছে, আরিফ বিদেশে পাচার করা টাকায় কানাডায় বাড়ি করার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে, নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ২৭৫ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছেন। আরিফ ও তার বাবার নামে ১২৮ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার ৯০০ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক।
আরিফের ঋণ জালিয়াতি:
ন্যাশনাল ব্যাংক মহাখালী শাখায় আরিফের মালিকাধীন হাসান টেলিকমের নামে ২৭৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। ডিরেক্ট হু হোম প্রকল্পের আওতায় ৪৭৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ওয়ার্ক পারমিটের বিপরীতে ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ঋণের আবেদন করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর ব্যাংকের পর্ষদ সভায় হাসান টেলিকমের অনুকূলে ২৭৫ কোটি টাকার ৫ বছর মেয়াদি ওভারড্রাফট (ওডি) ঋণ অনুমোদন করা হয়। ২৯ নভেম্বর আরিফের ব্যাংক হিসাবে ১০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে পুরো টাকা ১৯টি চেকের মাধ্যমে তুলে নেন আরিফ। ২ ও ৩ ডিসেম্বর যথাক্রমে ১০০ কোটি ও ৭৫ কোটি টাকা একইভাবে আরিফের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে চেকের মাধ্যমে ওই টাকাও তুলে নেন আরিফ। এত কিছুর পরও চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ঋণসীমা ২৭৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৩৫ কোটি টাকায় উন্নীত করার আবেদন করেন আরিফ হাসান।
দুদক বলছে, টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ভি-৮ গাড়িটি বাংলাদেশে খুব বেশি ব্যবহার হয় না। আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা। আরিফ ভি-৮ ব্যবহার করেন। গত বছর তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হলে গাড়িটি লুকিয়ে ফেলেন আরিফ। গাড়িটির নম্বরের সূত্র ধরে দুদক জানতে পেরেছে নিজের টাকায় কেনা হলেও রেজিস্ট্রেশন অন্যের নামে করেছেন আরিফ। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, গাড়িটি বেইলি রোড এলাকার কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
দুদক জানায়, আরিফ ও তার বাবার নামে গুলশানে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। এছাড়াও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আছে জমি। দেশ টিভিতে শেয়ার বাবদ বিনিয়োগ ৭৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দেশ এন্টারটেইনমেন্টে শেয়ার বাবদ বিনিয়োগ ৬ লাখ টাকা। হাসান টেলিকমে শেয়ার বাবদ বিনিয়োগ ৮ লাখ টাকা। ৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। এফডিআর, বিভিন্ন ব্যাংকের জমা এবং হাতে নগদ বাবদ ১২০ কোটি ৬৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৮ টাকা আছে। কিন্তু কোনও কিছুরই বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি তারা।
সংবাদ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন