লিখেছেন আলিফ আলম
আজও আমার বিয়েটা ভেঙ্গে গেল । বড় দুলাভাই কোথা থেকে যেন প্রায়েই পাত্র পক্ষদের ধরে এনে, আমাকে দেখায় আর আমার চেহারার উপর স্নো পাউডারের মোটা আবরণ দেখে, যাবার সময় পাত্র পক্ষ শুধু বলে যায়, পরে জানাবে । কিন্তু পরে আর কোনদিন জানায় না ।
‘পরে জানাবে’ বাক্যটা আগে আমাকে খুব কষ্ট দিত তবে এখন সয়ে গেছে । না সয়ে উপায় ও নেই । এ নিয়ে কতবার যে আমার বিয়ে ভেঙ্গেছে ! যতবার ভাঙ্গে ততবার একটা করে ধাক্কা এসে বুকের ভিতর লাগে আর ভিতরটা দুমড়ে-মুষড়ে যায় । স্নো পাউডার মেখে কারো সামনে যেতে আর ইচ্ছে করে না । নিজেকে বাজারের পণ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না তখন । প্রতিবার বড় দুলাভাই মেহমানদের বিদায় করে মন খারাপ করে ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,__ কত বিয়ে আনলাম তোমার জন্য, কেউ তোমাকে পছন্দ করে না । একটু যদি সুন্দর হতে বোন, তাহলে বোধ হয় খুব ভাল হত ।
আমি প্রতিবারের মত আমার এলোমেলো বিধ্বস্ত মন নিয়ে দুলাভাইয়ের দিকে তাকাই আর বলি ,__ সুন্দর হওয়া যদি আমার নিজের হাতে থাকত তাহলে কি আর আমি এমন অসুন্দর থাকি । এই কথার দুলাভাই কোন উত্তর দেয় না , শুধু শান্ত স্বরে বলে , __ সব মানুষেরই জোড়া আছে বোন দুনিয়াতে । চিন্তা করো না । যে তোমাকে পছন্দ করবে, সে তোমার এই চেহারা, এই রঙ দেখেই তোমাকে পছন্দ করবে, দ্যাখো !
দুলাভাই দেখতে বেশ উঁচু, লম্বা , মোটা- সোটা, কালো কুচকুচে রঙের একটা মানুষ । যিনি সহজে খুব একটা রাগে না তবে রাগ করে বড় বড় চোখ করে তাকালে তাকে দেখতে ভয়ংকর লাগে । সব সময় ঢিলে- ঢালা পোশাক পরে বলে তাকে খুব সাধারণ মনে হয় । কিন্তু এই সাধারণ মানুষের মাঝে, ভীষণ দারণ এক ভাল মানুষ বাস করে ! বড় আপার মানসিক সমস্যা আছে জেনেও তাকে নিয়ে কিভাবে সংসার করে যাচ্ছে দিনের পর দিন । আপার সাথে উনার প্রেমের বিয়ে । আপা দেখতে তখন ভালই ছিল । এখন অসুখ আর বয়সের কারণে চেহারার লাবণ্যতা প্রায় পুরোটাই হারিয়েছে । মানসিক সমস্যা বেড়ে গেলে , অর্ধ নগ্ন হয়ে হাতে এক ব্যাগ নিয়ে প্রতিবার আমাদের বাসায় এসে হাজির হয় । কয়েক সপ্তাহ ঔষধ- পত্র খাওয়ানোর পর কিছুটা ভাল হয়ে ফিরে গিয়ে আবার সংসারে মন দেয় ।
তখন দুলাভাইকে দেখি খুব কাছ থেকে। আপার মানসিক সমস্যা আছে জেনেও আপাকে কি পরিমাণ ভালবাসে দুলাভাই । আপা যতদিন আমাদের বাসায় থাকে ততদিন ব্যাগ ভরে ভরে বাজার সদাই করে দিয়ে যায় । কাজ থেকে ফিরে এসে, মনে করে আপাকে ঔষধ খাওয়ায়, চুল আঁচড়ে দেয় । তারপর আপা আস্তে আস্তে কেমন জানি ভাল হয়ে যায় । আমি একবার খুব আগ্রহ নিয়ে দুলাভাইকে আপাকে এমন ভালবাসার কারণ জানতে চেয়েছিলাম । উত্তরে উনি বলেছিলেন , তোমার আপাকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছি , আর ভালবাসার মানুষের অসুখ হলেও , ভালবাসার অসুখ হয় না । তবে যদি ভালবাসার অসুখ হয় তবে তা ভালবাসা না । তোমার আপা খুব ভাল মনের একটা মেয়ে । মাঝে মাঝে মাথার অসুখ হলেও , তার মনের কোনদিন অসুখ হয় নি । শুধু এই কারণে তোমার আপার এমন অসুখ থাকা সত্ত্বেও আমি অন্য কোন নারীর উপর বিন্দুমাত্র ও আকর্ষণ বোধ করি না । কারণ তোমার আপা আমার মনকে খুব শান্তিতে রেখেছে । এই কথার পর আর আর কোন কথা চলে না । আমিও আর কোন দিন কিছু জানতে চাই না ।
এই দুলাভাই আর আপাকে দেখেই গোপনে , আমার মনের ভিতর সংসার করার স্বপ্ন দানা বাঁধে । একটা ছোট্ট স্বপ্ন চোখের কোণে এসে জমা হয় । বড় স্বপ্ন দেখার সাহস তো নেই আমার । অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে আমি । একে তো রঙ কালো তার উপর শিক্ষা – দীক্ষা নেই , বাবার পয়সা নেই , জীবনের কোথাও কোন চাকচিক্য নেই , থাকার মাঝে আছে শুধু কোমর অবধি ঢেউ খেলানো চুল আর কিছু জন্মগত গুণ । বয়স বেড়ে বেড়ে এখন ৩৪ এর কোঠায় । বড় স্বপ্ন দেখার সাহস কোথায় আমার । তাই একটা ছোট স্বপ্ন আমার __ নিজের একটা সংসার , কয়েকটা হাড়ি -পাতিল , একটা বিছানা যার চাদরে প্রিন্টের ফুল পাতার ছবি । একটা ছোট ঘর আর তাতে ভালবাসায় পরস্পরকে আঁকড়ে ধরা দুটো জীবন্ত মানুষ । এই তো ।
বড় তিন বোন দেখতে ভাল বলে তাদের তরতর করে বিয়ে হয়ে গেল । এমনকি তাদের মেয়েদের ও আমার সামনেই বিয়ে হল । বুকে পাথর চেপে, চাপা কষ্ট নিয়ে তাদের মেয়েদের আঁতুড় ঘরের কাজ ও আমি সেরেছি। আমার সম বয়সী অনেকের এখন বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে বাসায় । কেবল আমিই আটকা পড়লাম । বাবা মুক্তি যুদ্ধের সময় মারা যান । সম্পদ বলতে একটা আধা- পাকা বাড়ি আর একটা দোকান যার ভাড়া দিয়ে আমাদের সংসার চলে ।
ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে মা যখন প্রতিদিন অথৈ সাগর পাড়ি দেয় তখন বড় আপা আর দুলাভাইয়ের প্রেমটা শুরু হয় । আপার বিয়ের পর থেকেই দুলাভাই আমাদের মাথার উপর গাছ হয়ে দাঁড়িয়েছেন । আমার বড় তিন বোনের বিয়ে দেয়া আর আমাদের যাবতীয় দেখাশুনার ভার সবই তখন এই দুলাভাইয়ের উপর । নিজের বাবা- মায়ের পরিবার সামলে আবার আমাদেরও দেখাশুনা করেন । মুদির দোকানের দোকানি যেমন একদিকে বাটখারা আর অন্য দিকে জিনিস রেখে শক্ত কাঁপা কাঁপা হাতে দাড়ি পাল্লার ভারসাম্য ঠিক রাখেন , দুলাভাই ও যেন ঠিক সেই রকম ভূমিকায় ।
এ বছর বৃষ্টি হচ্ছে খুব । একটু বৃষ্টি হলেই আমাদের উঠোনে পানি জমে যায় । আজ সকাল থেকে বৃষ্টি । পারাপারের জন্য দেয়া উঠোনের ইট গুলো পানিতে ডুবে গেছে , দেখা যাচ্ছে না একদম । মা ঘুম ভাঙতেই মনে করিয়ে দিলেন পানিতে ডুবানো ইটের উপর নতুন কয়েক জোড়া ইট বসিয়ে উঁচু করে দেবার জন্যে । কারণ কাল আবারও আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে ।
ইটের উপর ইট বসাতে বসাতে ভাবছি , কালও আবার আর একটা কষ্টের দিন হবে আমার । আমাকে মায়ের পুরনো শাড়ি পরিয়ে মুখে বেশী করে স্নো পাউডার মাখিয়ে, আমাকে আবারও তাদের সামনে নেয়া হবে আর তারা পরে জানাবে বলে এই ইটের উপর দিয়ে দ্রুত পা ফেলে ঠিক চলে যাবে । আমি তখন ভাঙ্গা মন নিয়ে শাড়ি পালটাবো আর স্নো পাউডারের আড়ালে থাকা আসল চেয়ারাটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে ফেলতে আবার ও একটু আয়নায় দেখে নেব ।
বিকেল হয়ে এল । ছেলে পক্ষ আসার সময় হয়ে এলো বলে আজ মায়ের ব্যস্ততা খানিকটা বেড়েছে । সামান্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করেছে দুলাভাই । ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এলো কালো করে আর সাথে ঝুম বৃষ্টি । আমাদের একটা এক চিলতে ঘর । আসবাব বলতে দুটো খাট, একটা ছোট কাঠের আলমারি আর ছোট একটা চেয়ার -টেবিল । পাশে লাগোয়া একটা ছোট ঘর তাতে ছোট ভাইটা থাকে । ঘরে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট । এমন বৃষ্টির দিনে কম লাইটের আলোয় ঘরটাকে কেমন যেন বড় মলিন লাগে ।
আমি যথারীতি সেজে গুজে পাত্র পক্ষের সামনে গেলাম । এ দৃশ্য আমার পরিচিত । সবাই আলাপচারিতার ফাঁকে চা পানি খায় । আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে , কয়েকটা প্রশ্ন করে তারপর চলে যায় । আজও তাই হল । তবে দুলাভাই মেহমানদের বিদায় করে ভারী আর বিষণ মুখের পরিবর্তে এক উজ্জ্বল মুখ নিয়ে এমন বাদলা দিনে ঘরে ঢুকে বললেন , জানো ! ছেলে তোমাকে পছন্দ করেছে ! একথা শুনে খুশিতে মায়ের চোখ জোড়া ঝলমল করে উঠল । আমার তেমন কিছু হচ্ছে না । কষ্ট পেতে পেতে অভ্যস্ত মনে এই অনভ্যস্ত আনন্দটা তেমন অনুভূত করতে পারছি না । ছেলে পক্ষ কয়েকদিন সময় চেয়েছে । এর পরেই বিয়েটা করে ফেলতে চায় ।
কাল বিয়ে । মা ঘরের সব কাজ সেরে , আজ অনেকদিন পর আমার পাশে এসে বসল । জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে খুব ক্লান্ত মায়ের চেহারাটা ঘরের হালকা আলোয় খুব করুণ লাগছে । মা খুব শান্ত আর স্বস্তির চাহনি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল , __ যা , মা । নিজের সংসারে যা । অসময়ে বাপ কে হারিয়ে তো আমার সাথে কম কষ্ট করলি না । ভাল খাবাররে অভাবে তোর শরীরটাও ভাল করে বাড়তে পারল না । অপুষ্ট শরীরে রূপ লাবণ্য কিভাবে থাকবে ? অভাবের কারণে পড়াশুনাও করাতে পারলাম না । শুনেছি ছেলের কাঁচা মালের ব্যবসা । ব্যবসাও ভালই চলে নাকি । বিয়েতে ছেলের তেমন কোন দাবি -দাওয়া নেই । এই ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগছে । তুই চলে গেলে আমার খুব একলা লাগবে সত্যি , তাও অনেক ভাল, অন্তত তোর দীর্ঘশ্বাস তো আর গুনতে হবে না । কারোর বিয়ের কথা শুনলে তোর যে হাসি ফুরিয়ে যেত , সেদিন সারাদিন দরজা চাপিয়ে অসুখের ভান করে শুয়ে থাকতি, তা তো আর দেখতে হবে না । যা, এবার নিজের সংসারে যা । মায়ের ভেজা চোখে চেয়ে মাকে বললাম , __তুমি এত বুঝ মা ! আমার ধারণা ছিল উল্টো । মা আঁচলে চোখ মুছে আর বলে , মায়েরা সন্তানদের সব খেয়াল করে ,তবে মুখে সবসময় বলে না ।
পরক্ষণেই আমার এতদিনের বিমর্ষ পৃথিবীর রঙটা বদলে গেল । বৃষ্টি যেন আজ আমার বিয়ের আনন্দে টিনের চালে ড্রাম বাজাচ্ছে । আমার এতদিনের কষ্টের সাক্ষী হয়ে থাকা এই এক চিলতে ঘর ছেড়ে কাল আমি পালাব , আমার নতুন এক ঘরের ঠিকানায় । যে স্বপ্ন এতদিন আমার চোখে জমা করে রেখেছিলাম । একটা ছোট স্বপ্ন__ একটা ছোট ঘর , একটা বিছানা , দুটো বালিশ । ফুল আর পাতার প্রিন্টের বিছানার চাদর , কয়েকটা হাড়ি – পাতিল , দুটো থালা আর ফুল পাখির নকশার বুননে একটা রঙিন কাঁথা । কাল আমি এ বাড়ি থেকে বের হব । হ্যাঁ , কাল আমি এমন ঘোর বর্ষায় উঠোনের বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া ইটে পা ফেলে আমি বের হব আমার সত্যিকারের মানুষের সাথে যে আমার এই চেয়ারা , এই অবয়ব দেখে আমাকে ভালবেসে বিয়ে করবে, কোন এক নতুন স্বপ্নের বুননের আশায় ।
আমি বিয়ের রাতে প্রথমেই যে প্রশ্নটা তাকে করেছিলাম ,__ তুমি আমার মাঝে কি দেখলে ? কেন আমাকে তোমার ভাল লাগল ? সে আমার চোখে তার চেনা দৃষ্টি ফেলে নরম স্বরে বলেছিল ,
___ তোমাকে যখন আমি প্রথম দেখি তখনেই আমার খুব ভাল লেগেছে । আমার মনে হয়েছে তোমাকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি । তুমিই আমার সেই মানুষ যাকে আমি এতদিন খুঁজে বেড়িয়েছি । এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না ।
(গল্পের’ আমি ‘ চরিত্রটিকে আমার ব্যক্তিগত ভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল । তার কষ্ট গুলো কতখানি লিখতে পারলাম জানি না তবে এটা জানি পৃথিবীতে আমাদের সবার সত্যিকাররের ভালবাসার মানুষ রয়েছে যারা আমাদের গায়ের রঙ , শিক্ষা , সম্পদ উপেক্ষা করেও আমাদের ভালবাসে আবার উপেক্ষা না করেও ভালবাসে । )