লিখেছেন ডি সাইফ
২৫ বছর ধরে একই দাবিতে সরব ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন – নিরাপদ সড়ক চাই। সড়কের নিরাপত্তা কি কেবল তিনি তার নিজের জন্যে চেয়েছিলেন? এই সড়কে নির্মমভাবে তার স্ত্রী নিহত হয়েছেন। তিনি শোককে শক্তি করে গোটা সড়কের নিরাপত্তার দাবি নিয়ে হাজির হলেন। বলতে চাইলেন, আর কোনো দূর্ঘটনা নয়, অকাল মৃত্যু নয়, সড়কে ফিরবে শৃঙ্খলা, গাড়ির থাকবে ফিটনেস, চালকের থাকবে লাইসেন্স, থাকবে একটা সড়ক আইন…
কিন্তু, ইলিয়াস কাঞ্চনের এই সংগ্রামের বিপরীতে কিছু অসভ্য লোক দাঁড়িয়ে গেছে। তার বার বার এই মানুষটাকে অপদস্তু করার চেষ্টা করছে। অপমানিত করার চেষ্টা করছে। এই তো, ইলিয়াস কাঞ্চনকে যেদিন এই জাতির ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো উচিত ছিল, নতুন সড়ক আইন কার্যকর করবার দিনে, সেদিন উল্টা সড়কে শ্রমিকদের ধর্মঘটে তাকে কি কদর্যতায় আঘাত করা হলো। ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ফাঁসি চেয়ে ব্যানার লাগানো হলো, ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতার মালা পড়ানো হলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু, ইলিয়াস কাঞ্চন কেন লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠলেন? তিনি কি করেছেন কেবল মানুষের জন্যে একটি নিরপরাধ আন্দোলন ছাড়া? তার এই মানুষের পক্ষে কথা বলাটা সহ্য করতে পারছে না কে? কারা? কেন শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে, ইলিয়াস কাঞ্চনকে কেন শ্রমিকদের কাছে ভিলেন করার চেষ্টা হয়েছে?
উত্তরটা বোধহয় খোলাসা হয়ে গেল গতকাল, ইলিয়াস কাঞ্চনের উপর আসলে কে রুষ্ট, কে ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা বলাকে সহ্য করতে পারছেন না তা বোঝা গেছে গতকাল শাজাহান খানের কথা শুনেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সংসদ সদস্য শাজাহান খান যে পুতুল নাচের কারিগর তা এতোদিনে তার অবস্থান দেখে সবাই বুঝে গেছে। সড়কে শ্রমিকদের ব্যবহার করে তিনি যে নৈরাজ্যের ডিসপ্লে করেন হুটহাট ধর্মঘট, অবরোধ দিয়ে তা এখন ওপেন সিক্রেট।
এই লোকটা যে মানুষের পক্ষে কথা বলা সহ্য করবেন না তাও অনুমিতই। কারণ, মানুষের জীবনের দাম তার কাছে হয়ত দুই পয়সাও না। সড়কে নির্মমভাবে যখন দুই শিক্ষার্থী রাজীব দিয়ার মৃত্যু হলো, তিনি সে খবর শুনে দাঁত কেলিয়ে হেসেছিলেন। সেই শাহাজাহান খান এবার ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ এনেছেন। এবং তার ভাষা এতোটা আক্রমণাত্মক ছিল যে, বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি ইলিয়াস কাঞ্চনের কাজকে হজম করতে পারছেন না।
শাজাহান খান রবিবার নারায়ণগঞ্জে ড্রাইভারস ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটে ইলিয়াস কাঞ্চনকে ইঙ্গিত করে বলেন, “নিরাপদ সড়ক চাই নামক এনজিও’র মাধ্যমে বিদেশীদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত তিনি (ইলিয়াস কাঞ্চন) কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই অবৈধ অর্থ দিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং স্কুলও করেছেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন কোন কোন খাত থেকে কি বাবদ কতো টাকা পান এবং সেখান থেকে অর্জিত টাকার কতোখানি নিজে নেন তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। এছাড়াও তার পুত্র ও পুত্রবধূর নামে যেভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেই হিসেবও সর্বসমক্ষে তুলে ধরা হবে।”
এসময় শাজাহান খান ইলিয়াস কাঞ্চনকে জ্ঞানপাপী বলেও উল্লেখ করেন। শাজাহান খানের চেয়ে বড় জ্ঞানপাপী এদেশে আর কে আছে, যে লোক প্রকাশ্যে মিডিয়ায় “গরু ছাগল চিনলেই লাইসেন্স দেয়া যায়” টাইপ বক্তব্য দেয় সে যে মস্তো বড় জ্ঞানপাপী তা বলাই বাহুল্য। শাজাহান খানের আরো একটা বক্তব্য মনে করিয়ে দিতে চাই। তিনি রাজীব দিয়া নিহত হবার পর হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “আমি যদি আপনাদেরকে প্রশ্ন করি, গতকাল আপনারা লক্ষ্য করেছেন, ভারতের মহারাষ্ট্রে একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে ৩৩ জন মারা গেল৷ কই ওখানে তো এভাবে কেউ কিছু বলেনি?”
তরতাজা এক দূর্ঘটনার পর সে এরকম কথা বলতে পারে, তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবা উচিত আসলে। কিভাবে শাজাহান খানকে বছরের পর বছর সরকার পুষে রেখেছে তা এক বিস্ময়। এই শাজাহান খান এখন উঠে পড়ে লেগেছেন ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ থাকতেই পারে, কিন্তু এরকম অভিযোগ কোনো প্রমাণ ছাড়া মিডিয়ার সামনে কিভাবে করলেন? ইলিয়াস কাঞ্চন কোনো অনৈতিক কাজ করে থাকলে তার নিশ্চয়ই প্রতিকার চাওয়া সমস্যা না। কিন্তু, এই অভিযোগের ভিত্তি কি?
শাজাহান খানের নামেও তো অভিযোগের শেষ নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে লস্কর পদে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ আছে তার নামে। ২৮ জনের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তার ইশারায় নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ৮৫ জনকে। নিয়োগপ্রাপ্তদের ৭৫ ভাগই মাদারীপুর জেলার। আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের চাকরি না দিয়ে অন্যদের চাকরি দেয়া হয় এই চতুর্থ শ্রেণীর পদে। এই নিয়োগ বাণিজ্য ঘিরে শাজাহান খানকে অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
শাজাহান খান ঘুষ নেয়া লোকের পক্ষে অবস্থান নেন এমন ঘটনাও আছে। দুর্নীতির অভিযোগে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার এ কে এম ফখরুল ইসলাম তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। যিনি পরে ঘুষ নিয়ে হাতেনাতে ধরা খান। এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ থাকলেও শাজাহান খান তার পক্ষে থাকায় ব্যবস্থা নেয়া যায় নি।
শাজাহান খানের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ তো ভুরি ভুরি। গুগলে সার্চ দিলে পুরানো দিনে শাজাহান খানের বক্তব্য, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের খতিয়ানের দেখা মিলবে অহরহ। শাজাহান খানকে কখনো শক্ত পরীক্ষার মুখে পড়তে হয় নি। শুদ্ধি অভিযান তার বিরুদ্ধে হলে হয়ত তারও মুখোশ উন্মোচন হবে।
আর শাজাহান খান যার মুখোশ উন্মোচন করতে চেয়েছেন, সেই ইলিয়াস কাঞ্চনের &নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠন শাজাহান খানকে ইতিমধ্যে ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। শাজাহান খান যেসব ভয়ংকর অভিযোগ এনেছেন, তার প্রমাণ চায় সংগঠন। সংগঠনটি বিবৃতি দিয়ে শাজাহান খানকে পাল্টা জবাব দেয়। বলা হয়,
“আমরা মনে করি সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮কে বাধাগ্রস্ত করতে উদর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে শাহজাহান অবান্তর এসব প্রশ্নের অবতারণা করছেন। আমরা বিশ্বাস করি এদেশের মানুষ এসবের যোগ্য জবাব দিবে।
সেই সঙ্গে উল্টো প্রশ্ন রাখছি পরিবহন সেক্টরে বছরে বিভিন্ন খাতের নামে যে টাকা উত্তোলন (চাঁদা আদায়) করা হয় সেই টাকার কত অংশ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়েছে, কয়টা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে শ্রমিকদের দক্ষ করার জন্য, কয়টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য, কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য, কয়টি আবাসন পল্লী গড়ে তোলা হয়েছে শ্রমিকদের আবাসনের জন্য, তাদের জীবনমান উন্নয়নে এই টাকার কত অংশ ব্যয় করা হয়?”
শাজাহান খান এমন এক সময়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যখন, সড়ক আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে সরকার। শাজাহান খান ও তার আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকা ‘মবিল সন্ত্রাস’রা হয়ত চায় না সড়ক আইন বাস্তবায়ন ঘটুক। হয়ত সেকারণেই, এখন তাদের লক্ষ্যবস্তু এমন একজন মানুষ, যিনি ২৫ বছরের বেশি সময় এক দাবিতে অনড় আন্দোলন করে গেছেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন আমাদের পক্ষে আন্দোলন করে, আমাদের জীবনের পক্ষে লড়াই করে জীবনের ২৫ টা বছর বিলিয়ে দিয়ে অনেক বট ‘অপরাধ’ করে ফেলেছেন হয়ত। তার বড় ‘অপরাধ’ এটাই যে তিনি পরিবহন শ্রমিক আইনের সংশোধন চেয়েছেন। নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তায় নেমেছেন। চালক-যাত্রী-পথচারী সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর পর থেকেই নিরাপদ সড়কের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, আর কেউ যায়ে চালকের অসাবধানতায় মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়ে, কোন মানুষকে যেন তার মতো সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়, সেজন্যেই নিজের ক্যারিয়ারকে একপাশে ফেলে রেখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা।
ইলিয়াস কাঞ্চন একারণেই স্পেশাল, এই ২৫ বছর ধরে তিনি পাল্টে যান নি। এক দাবিতেই স্থির থেকেছেন। রাজনীতিবিদদের মতো রং বদলান নি অন্তত। শাহাজান খানরা যেমন পেছন থেকে কলকাঠি নাড়িয়ে স্বার্থসিদ্ধি করেন, হুটহাট ধর্মঘট ঘটিয়ে আমাদের বিপদে ফেলেন, সেসময় ইলিয়াস কাঞ্চন আমাদের পক্ষে রাস্তায় থাকেন। ইলিয়াস কাঞ্চন নেতা না হয়েও আমাদের নেতা, আর শাজাহান খান জনপ্রতিনিধি হয়েও ভোগান্তির প্রতীক। শাজাহান খান, জনগণকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবেন কবে?