রাজধানীতে যানজট সমস্যার সমাধান করতে গত ১৫ বছরে সাতটি উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। অধিক ব্যয়ে নির্মিত এসব বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরেও নগরীর যানজট নিরসনে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েছে না। যানজট সমস্যার সমাধানে উড়ালসড়ক কতোটুকু কার্যকর, তা নিয়েও ভিন্ন মত রয়েছে।
বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, যানজটের কারণে নগরীর স্থবিরতা সমাধান শুধু উড়ালসড়ক তৈরি নয়। বরং গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সর্বস্তরের মানুষের জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা এবং দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যেই এর সমাধান হতে পারে।
চার হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নগরীর প্রায় ২৯ কিলোমিটার জুড়ে সাতটি উড়ালসড়ক মহাখালী, খিলগাঁও, তেজগাঁও, বনানী, কুড়িল, যাত্রাবাড়ী এবং মগবাজার নির্মাণ করা হয়েছে।
২০১৩ সালে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কটি প্রায় ২ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। একই বছরে প্রায় ৩শ’ ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩.১ কিলোমিটার দীর্ঘ কুড়িল বহুমুখী উড়ালসড়ক (কেএমএফ) প্রকল্পটি চালু করা হয়েছিলো।
উড়ালসড়কের তালিকার সর্বশেষ সংযোজন হলো মগবাজার-মালিবাগ উড়ালসড়ক। যা দুবার বাজেট বৃদ্ধির পরে এক হাজার দুইশ ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এ উড়ালসড়কটি ২০১৭ সালে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং সড়ক ও পরিবহন অবকাঠামোগত বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উড়ালসড়কের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, “প্রথমে আপনাকে যে বিষয়টি জানতে হবে তা হলো, শহরের মধ্যে নির্মাণ করা উড়ালসড়কগুলো কোনো সুবিধা যোগ করতে পেরেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই।”
অতিরিক্ত আন্তঃনগর উড়ালসড়কের খারাপ দিকগুলোর বর্ণনা করে ড. হক বলেন, “শহরের প্রাণকেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে উড়ালসড়ক কেবলমাত্র যানজটের চাপ বাড়াবে। কেনোনা উড়ালসড়কের উভয় প্রান্তই আবার মূল রাস্তাগুলোর সঙ্গে দ্রুত মিলে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “মগবাজার-মালিবাগ উড়ালসড়কটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচনায় করা যেতে পারে। এটি যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে একই রাস্তায় দ্বিগুণ যানবাহনকে একত্রিত করে, যার ফলে ওই এলাকায় যানজট ব্যবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।”
বিশেষ করে তিনি বলেন, “আমরা সড়কের ওপর সড়ক নির্মাণ করেছি। এটা যানজট সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। যার ফলে, আমরা একই সড়কে দ্বিগুণ যানবাহনের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছি।”
সরকারকে গণপরিবহনের সংখ্যা আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত করেন তিনি।
তিনি যোগ করেন, “যেহেতু জনগণের চাহিদার বিপরীতে গণপরিবহনের বিশাল সংকট রয়েছে, তাই এ চাহিদা পূরণ করতে উড়ালসড়ক নির্মাণ না করে গণপরিবহনে বিনিয়োগ করা উচিত।”
এ পরিবহন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “বিভিন্ন কারণে ঢাকা শহরে উড়ালসড়ক নির্মাণ করার ব্যয় অনেক বেশি। অনেক সময় নির্মাণ কাজে বিলম্বের কারণে সরকারকে এর বাজেট বাড়াতে হয়। আমাদের একটি বাস্তববাদী সমাধানের খোঁজার সুযোগ ছিলো, তবে আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছি… দীর্ঘ মেয়াদে এই সংকট আমাদের দেশের মতো ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকা সরকারকে সমস্যায় ফেলবে।”
পরিবহন পরিকল্পনাকারী এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞ রবার্ট গ্যালাগারের গবেষণায় ঢাকার বর্তমান যানজটের পেছনে দুটি প্রধান কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- বিগত দশকগুলোর তুলনায় পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অভাব এবং বাসের মতো গণপরিবহনের পরিবর্তে গাড়ির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা।
তার সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন যানবাহনের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বর্তমানে ঢাকা যেখানে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ৬.৪ কিলোমিটার, ২০৩৫ সালের মধ্যে তা ঘণ্টায় ৪.৭ কিলোমিটারে নেমে যেতে পারে। উড়ালসড়কের সংখ্যা বাড়ার পরেও এ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।
এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ড. আদিল মোহাম্মদ খান পরিবহন অবকাঠামোর পরিশীলিত পরিকল্পনার গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেছেন।
তিনি বলেন, “পরিকল্পনা একটি সার্বিক ব্যাপার; এতে জড়িত প্রায় সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গেই অনেকগুলো উপাদান জড়িয়ে আছে… একটি শহরের অভ্যন্তরীণ উড়ালসড়ক নির্মাণই এক্ষেত্রে কোনো সমাধান দিতে পারে না। এর মাধ্যমে উপশহরগুলো কিছুটা সুবিধা পেলেও মূল শহরের বাসিন্দারা তেমন কোনো সুবিধা পায় না।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. খান বলেন, “উড়ালসড়কগুলোর সুযোগ ব্যয় অসীম। সব ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট সুযোগ ব্যয় থাকে… ঢাকায় বর্তমানে সাতটি উড়ালসড়ক রয়েছে। যার জন্য সরকারের ব্যয় চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। এতো পরিমাণে টাকা যানজট কমানোর জন্য অন্য কোথাও ব্যবহার করা যেতো।”
ড. খান বলেন, “এই টাকায় যদি আরও বেশি বাস কেনা যেতো, বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যেতো, যা সাতটি উড়ালসড়কের সামগ্রিক প্রভাবের চেয়ে নাগরিকদের বেশি কাজে লাগতো। গণপরিবহন বৃদ্ধির আর একটি ইতিবাচক ফল হলো ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমতো।”
তিনি বলেন, “ঢাকা শহরে উড়ালসড়ক করার এই প্রবণতা চট্টগ্রামের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতেও দেখা গেছে, যা সেখানে তেমন কোনো কাজেই আসবে না… বরং সেখানেও যানজট আরও বাড়বে।”
ড. খান বলেন, “উড়ালসড়ক নির্মাণ করার মাধ্যমে আরও জটিল যানজটের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানোর কোনো বিকল্প হতে পার না।”
তিনি বলেন, “আমাদের গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বাসের সংখ্যা। বিভিন্ন এলাকার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী এ বাসগুলোকে এগুলোকে বহুমুখী করা যেতে পারে… আমি মনে করি ‘ঢাকা চাকা’ মতো পরিবহনের চাহিদা মেটাতে শ্রেণীভিত্তিক গতিশীল পরিকল্পনা অনুসরণ করা যেতে পারে।”
বহুল প্রত্যাশিত ‘রুট ফ্রাঞ্চাইজি’ পদ্ধতি দ্রুত প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “এ পদ্ধতিতে একটি কোম্পানির বাস একটি এলাকায় চলবে এবং এ থেকে যা আয় হবে, তা তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। এটা সড়ককে নিরাপদ করার সঙ্গে সঙ্গে অধিক যাত্রী উঠানোর প্রতিযোগিতা কমাতে সহায়তা করবে।”
দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে এ দুই বিশেষজ্ঞ বলেন, “যানজট নিরসনে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা, ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা করা এবং ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে।”