লিখেছেন আবুল কালাম
বাংলাদেশ-ভারত-কানাডার গোয়েন্দাদের পাশাপাশি ইন্টারপোলও নিশ্চিত, তাদের জারি করা ‘রেড কর্নার নোটিস’ যার বিরুদ্ধে, সেই খন্দকার তানভির ইসলাম এবং কানাডার উদ্যোক্তা তারেক রানা আসলে একই ব্যক্তি। দুইজনের মধ্যে কী ভীষণ মিল! নামে, ছবিতে, শরীরের চিহ্নে, বাবার নাম, জন্মতারিখ এমনকি স্ত্রীর নাম- সব কিছুতেই আশ্চর্য রকমের মিল। শুধু তা-ই নয়, দু’জনেরই দুই পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। কিন্তু তারেক রানার দাবি, তিনি কিছুতেই খন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয় নন! তার দাবি, বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তানভিরের সঙ্গে তার এত্ত মিল তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে। অবশেষে কানাডা থেকেও তারেক রানা এখন লাপাত্তা।
কে এই খন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয়? কে-ই বা তারেক রানা?
তানভির ইসলাম জয় বাংলাদেশে কয়েক ডজন খুন, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মামলায় অভিযুক্ত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অনুরোধে ইন্টারপোল ‘রেড কর্নার নোটিস’ জারি করে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ পুলিশ জানায়, সেই সময়েই তারা জয়ের মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশের কুখ্যাত সেভেন স্টার গ্যাংয়ের প্রধান ছিল জয়। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করত ‘সেভেন স্টার গ্যাং’। টাকা না দিলে খুনও করতে পিছপা হত না তারা।
বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, ২০০৬ সালের ১৪ মে বিদেশে কাজের জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া সংস্থা ‘তুর্কি অ্যাসোসিয়েট’-এর মালিককে ৮ লাখ মার্কিন ডলার চেয়ে ফোন করে জয়। টাকা না দেওয়ায় ওই সংস্থার অফিসে ঢুকে ৬ জনকে গুলি করে খুন করে জয়ের লোকজন। জয় তখন সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে টাকা চেয়েছিল বলে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি। এ রকম একের পর এক খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকা পুলিশের দাবি, এখনও শহরের বুকে জয়ের দলবল চাঁদা তোলে একই রকমভাবে। ৫ কোটি পর্যন্ত চাঁদা চায় জয়ের গ্যাং! এক সময়ে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসাবেও পরিচয় দিত সে! কিন্তু, জয়কে সেই সময় কেউ ধরতে পারেনি।
এর পরের ঘটনা ভারতের কলকাতায়। সেটা ২০০৭ সাল। বাগুইআটির চীনার পার্কের একটি বাড়ি থেকে জয়কে গ্রেফতার করে সেখানকার সিআইডি। দেখা যায়, ভোল বদলে তারেক রানা নামে সে গা ঢাকা দিয়েছিল বাগুইআটির ওই ভাড়াবাড়িতে। ভুয়া নথির মাধ্যমে তারেক রানা নামে সে তত দিনে ভারতীয় পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ড্রাইভিং লাইসেন্স— সবই জোগাড় করে ফেলেছে।
কলকাতায় তখন তার পরিচয় ‘জি ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক সংস্থার মালিক! ভারতীয় সিআইডি তার বিরুদ্ধে পাঁচটি আলাদা আলাদা মামলা রুজু করে। সেই সময় সিআইডির ডিআইজি (অপারেশনস) ছিলেন সিআইডির বর্তমান এডিজি রাজীব কুমার। তার নেতৃত্বেই তৈরি হয় স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ। তারাই গ্রেফতার করে জয়কে।
এই মামলাগুলো যখন চলছে, তখনই জয়কে ফেরত পেতে ভারতকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। সেই সময়ে স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জানান, ওই প্রত্যার্পণ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই জামিন পেয়ে যায় জয়। তার পর প্রায় কর্পূরের মতো সে কলকাতার বুক থেকে উধাও হয়ে যায়। এর পর জয়ের আর কোনও ‘খোঁজ’ পাওয়া যায়নি।
কানাডার অভিবাসন দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে পর্যটক ভিসা নিয়ে কানাডায় আসেন তারেক রানা নামে এক ব্যক্তি। তখন থেকেই তিনি এখানে আছেন। ইতোমধ্যে টরন্টোর শহরতলি অ্যাজেক্সে ওই ‘ভারতীয়ের’ নাম একজন সফল ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তারেকের দাবি, তার জন্ম থেকে বড় হওয়া— সবটাই কলকাতায়। অ্যাজেক্সের অভিজাত এলাকায় তার ‘এসজে ৭১’ সংস্থার বিশাল অফিস রয়েছে। নিয়মিত তাকে সেখানকার ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা যায়। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত মোটা অংকের অর্থসাহায্য করেন তিনি। এমনকি এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলেও দেন মোটা অংকের চাঁদা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে তারেককে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি সে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, এনেছেন বিনিয়োগও।
কলকাতার উদ্যোক্তা হিসেবে অ্যাজেক্সে থাকা তারেক রানার সঙ্গে কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশি ডনের একের পর এক সাদৃশ্য খুঁজে পান কানাডার পুলিশ কর্মকর্তারাও। ২০১১ সালে প্রথম বার কানাডা যান তারেক রানা। ২০১৪ সালে তৈরি করেন সম্পত্তি কেনাবেচার ‘এসজে ৭১’ সংস্থা। সম্প্রতি ‘এসজে ৭১’-এর ডিরেক্টর তারেক রানার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ডন’ তানভিরের সঙ্গে সব রকম মিল খুঁজে পেয়েছে কানাডা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। কী রকম? গোয়েন্দারা নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন:
১। ২০০৫ সালে খন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয়ের যে ছবি ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিসে রয়েছে, তার সঙ্গে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া জয়ের ছবি এবং তারেক রানার সাম্প্রতিক ছবিতে সাদৃশ্য রয়েছে।
২। খন্দকার তানভিরের বাবার নাম এবং তারেক রানার বাবার নাম একই— খন্দকার নজরুল ইসলাম।
৩। তাদের দু’জনের জন্মসালও এক (১৯৬৭)।
৪। উভয়েরই দুইপায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার চিহ্নও দু’জনের শরীরেই রয়েছে।
৫. এছাড়াও পাসপোর্টে তাদের দু’জনের স্ত্রীর নামও একই বলে জানা গেছে (সূত্র: গ্লোবাল নিউজ)।
শুধু কানাডার অভিবাসন দফতর নয়, সিআইডির কর্মকর্তারা, যারা জয়কে ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার করেছিলেন, তারাও কানাডার তারেক রানার ছবি দেখে এক মুহূর্তে চিনতে পারছেন। তারা নিশ্চিত, বাংলাদেশের কুখ্যাত ডন খন্দকার তানভির ইসলামই আসলে এই তারেক রানা।
সিআইডি যখন জয়কে চীনার পার্ক থেকে গ্রেফতার করে, তখন সে বাড়িতে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিল। গ্রেফতারের কয়েক দিন আগে বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচার হয়। সে কারণে তাই জয়ের গ্রেফতারির পর এমআর বাঙুল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তাকে ভর্তি করেছিল সিআইডি। কানাডার অভিবাসন দফতরের কাছে ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দেওয়া তারেক রানার ফাইলেও রয়েছে পায়ের অস্ত্রোপচারের তথ্য। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, জয়ের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর, কসবা, দমদম, তিলজলা এবং কাঁকসা থানায় পাঁচটি মামলা থাকার পরও সে কীভাবে জামিন পেল? জামিন পাওয়ার পর কীভাবেই বা দেশ ছেড়ে পালাল? জবাব দিতে চাননি সিআইডির কর্মকর্তারা। তবে তাদের একজন শুধু ইঙ্গিত দিয়েছেন, “কানাডাতে ঠিক যেভাবে প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠাবসা করে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছিল জয় ওরফে তারেক রানা, ঠিক সেই মন্ত্রেই এই কলকাতা ছেড়েছিল বাংলাদেশের ‘দাউদ ইব্রাহিম’ খ্যাত এই জয়।”
তারেক রানা কী বলছেন এ বিষয়ে? কানাডার এই উদ্যোক্তা প্রথমে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতেই রাজি হননি। তার সঙ্গে সংবাদকর্মীর শেষ বার কথা হয় গত অক্টোবরে, তখনও তিনি কানাডাতে। তখন বলেছিলেন, “সম্প্রতি এটা আমারও অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। ওই অপরাধীর সঙ্গে আমার মুখের অদ্ভূত সাদৃশ্য রয়েছে। এখানকার পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।” একই সঙ্গে তিনি দাবি করেছিলেন, “তবে, আমি তানভির ইসলাম জয় নামে কাউকে চিনি না।”
তাকে কি কখনও কলকাতায় গ্রেফতার করা হয়েছিল? তারেক দাবি করেন, তার জীবনে কখনও কোনও অপরাধের সঙ্গে যোগ ছিল না। ফলে গ্রেফতারের প্রশ্নই নেই বলে জানান তিনি। তা হলে কলকাতা হাইকোর্টে ২০০৭ সালের অগস্ট মাসে খন্দকার তানভির ইসলাম জয় ওরফে তারেক রানা (সিআরআর ২৮৮৭/২০০৭) হিসাবে তিনি কেন তার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে চলা মামলা খারিজ করার আবেদন জানিয়েছিলেন? সেখানে তো তারেক রানার সঙ্গে মোস্ট ওয়ান্টেড খন্দকার তানভির ইসলাম জয় নামটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন কেন?
এসব প্রশ্নের কোনও জবাব অক্টোবরের ওই কথোপকথনের সময়ে তারেক দেননি। তাকে এটাও সেই সময় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ওই মামলার নথি থেকে হদিস মিলেছে, তারেকের যে ভারতীয় পাসপোর্ট (এফ ১১১৫১৩৪) তা আসলে ভুয়া নথি দিয়ে বানিয়েছিল জয়— সিআইডি আদালতে তেমনটাই জানিয়েছিল। এবারও নিরুত্তর ছিলেন তারেক। আর সিআইডি বলছে, ওই ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তারেক রানা কানাডা যাওয়ার জন্য ১০ বছরের ভিসা পেয়েছিলেন।
অক্টোবরে তারেকের সঙ্গে যে দিন কথা হয়, তার কয়েক দিনের মধ্যেই কানাডার অভিবাসন দফতর একাধিকবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর হঠাৎ করেই অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ তিনি ‘উধাও’ হয়ে যান। তার পরিচিতদের তারেক জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে তিনি ফিরবেন অ্যাজেক্সে ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি কানাডায় ফেরেননি। তিনি কোথায় আছেন জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ওই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, তারেক রানা বর্তমানে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে রয়েছেন।
তারেক রানার অ্যাজেক্সের অফিস তালাবদ্ধ। পাওনাদাররা টাকা না পেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন বলে পুলিশ জানায়। উঠে আসা তথ্যপ্রমাণ থেকে স্পষ্ট, কানাডার হোমরাচোমরাদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করা তারেকই জয়ের আর এক নতুন ‘অবতার’। যেমন কলকাতায় তার ‘অবতার’ ছিল পোশাক সংস্থার মালিক। কানাডায় তার ‘অবতার’ এসজে ৭১-এর ডিরেক্টর। সম্প্রতি অ্যাজেক্সের মেয়রের কাছ থেকে এওয়ার্ডও পেয়েছেন তারেক।
তবে শত চেষ্টা করেও তারেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি জয়ের সঙ্গে মিলগুলোকে মুছে ফেলা। ডন থেকে উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেও গোয়েন্দা চোখের আড়ালে যাওয়া যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনই ফেরার হয়ে নিজেকে লুকানোও ক্রমশ মুশকিল হয়ে পড়ছে তার। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই তার মোবাইল নিষ্ক্রিয়। ইমেইলও অকার্যকর। আর সেখানেই প্রশ্নটা উঠছে, তারেক যদি মোস্ট ওয়ান্টেড জয় না-ই হন, তবে নিজের এত বড় ব্যবসা ফেলে কেন উধাও হয়ে গেলেন!
(গ্লোবাল নিউজ ও আনন্দবাজার অবলম্বনে)