আজকের দিনে মার্টিন স্করসেস ও ওয়েস অ্যান্ডারসনের চেয়ে সত্যজিৎ রায়ের নাম নিশ্চয়ই অনেক কম মানুষই জানেন। ভারতীয় পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র বাংলা সিনেমার ন্যারেটিভে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। তিনি গল্প বলার যে অনন্য পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন, তা আজকের দিনে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি প্রথম বাঙালি (ভারতীয়) পরিচালক হিসেবে ১৯৯২ সালে অস্কার জিতেছিলেন। তার প্রভাব আজকের দিনেও বাঙালি সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সত্যজিৎও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। রায় একাধারে লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, ডিজাইন করেছেন (অলঙ্করণ, পোশাক প্রভৃতি), গান লিখেছেন, সিনেমার ক্রেডিট লাইনের জন্য ক্যালিগ্রাফি করেছেন এবং সিনেমাটোগ্রাফিকেও সামলেছেন। একই সঙ্গে তিনি একজন স্বশিক্ষিত পেইন্টার।
সত্যজিৎ রায় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি জার্নালে প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে। নির্বাক সিনেমার শেষ যুগে হলিউডের সবচেয়ে বিখ্যাত তাত্ত্বিক রুডলফ আর্নহেমের লেখা এবং জ্যাঁ রেনোয়ার সিনেমা ‘দ্য রিভার’ দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি।
মার্টিন স্করসেসের চোখে ‘চার মহান’ পরিচালক হচ্ছেন সত্যজিৎ রায়, আকিরা কুরোসাওয়া, ইঙ্গমার বারিমান ও ফেদেরিকো ফেলিনি। সত্যজিৎকে ‘নিঃসন্দেহে বিশ্ব সিনেমার এক অতিকায়’ বলে অভিহিত করেছেন হেনরি কার্টিয়ার ব্রেসো। তার পরও দুনিয়ায় তিনি একজন কম পরিচিত পরিচালক। সত্যজিতের জীবনীকার অ্যান্ড্রু রবিনসনকে কুরোসাওয়া একবার লিখেছিলেন, ‘রায়ের সিনেমা না দেখা মানে চাঁদ-সূর্য না দেখে বেঁচে থাকা।’ সমসাময়িক বারিমান বা কুরোসাওয়ার মতো সত্যজিতের খ্যাতি না পাওয়ার পেছনে ছিল একটিই কারণ, আর সেটি হলো তিনি তাদের মতো প্রচার পাননি।
তার সিনেমা বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট প্রদর্শনের সুযোগ পায়নি। কিন্তু রায়ের কাজ পশ্চিমের অনেক জনপ্রিয় পরিচালককে প্রভাবিত করেছে। ওয়েস অ্যান্ডারসন তার পঞ্চম সিনেমা ‘দ্য দার্জিলিং লিমিটেড’ উত্সর্গ করেছেন সত্যজিৎ রায়কে। সত্যজিতের ‘চারুলতা’ সিনেমাটির সংগীত অ্যান্ডারসন তার সিনেমায় ব্যবহার করেছেন। রোলিং স্টোনকে তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘এটা আমাদের ব্যবহার করা সেরা সংগীতগুলোর একটি।’ তিনি আরো জানান, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তাদের বোঝাতে সক্ষম হই যে তার তৈরি সংগীতগুলো ডিজিটাল সংস্করণে নেয়া প্রয়োজন। আমি কলকাতায় পাঁচদিন অপেক্ষা করে সেগুলো তাদের হাতে তুলে দিই। এত অপেক্ষার পরও সেটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।’ ‘দার্জিলিং’ সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় জ্যাক, পিটার ও ফ্রান্সিস ‘বেঙ্গল ল্যান্সার’ ট্রেনটির পেছনে ছুটছে। এ দৃশ্যে সত্যজিতের প্রভাব খুব স্পষ্ট— মনে পড়বে দূরে ট্রেনের হুইসেল শুনে ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার ছুটে যাওয়া।
চলচ্চিত্র সমালোচক মাইকেল স্রাগো মনে করেন অপু ট্রিলজি পরবর্তীকালের অনেক পরিচালককে প্রভাবিত করেছে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ দেখার পর পলিন কায়েল লিখেছিলেন: ‘অন্য আর যেকোনো পরিচালকের চেয়ে সত্যজিৎ রায়ের কাজ আমার মনে আনন্দের এক জটিল অনুভূতি তৈরি করে। তার মতো আর কোনো শিল্পী আমাদের সাধারণ অনভূতিগুলোকে নতুন করে মূল্যায়ন করাতে পারেননি।’ শোনা যায়, উইলিয়াম ওয়েলার এবং এলিয়া কাজান ‘দেবী’ সিনেমাটিকে সেলুলয়েডের কবিতা বলে অভিহিত করেন। সত্যজিৎ স্ট্যানলি কুবরিককেও মুগ্ধ করেছিলেন। ধারণা করা হয় স্করসেসই ১৯৯২ সালে সত্যজিৎকে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। স্করসেসের বহু সিনেমায় সত্যজিতের প্রভাবের ছাপ দেখা যায়। অন্যদিকে স্করসেস স্পষ্ট করে বলেছেন যে, স্পিলবার্গের ‘ইটি’ সিনেমায় সত্যজিতের প্রভাব পরিষ্কার। রায়ের ‘এলিয়েন’ সিনেমাটি নির্মিত হয়নি। তার লেখা গল্পের ওপর ভিত্তি করে তিনিই এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে জালিয়াতির কারণে তিনি কাজটি নিয়ে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। সিনেমাটি ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কিংবদন্তি মার্লোন ব্রান্ডোর অভিনয় করার কথা থাকলেও পরে তিনি আর এতে থাকেননি। সব মিলিয়ে পুরো সিনেমাটি আর আলোর মুখ দেখেনি। আমেরিকায় সত্যজিতের লেখা চিত্রনাট্যটি বিভিন্নভাবে ছাড়িয়ে পড়েছিল এবং স্পিলবার্গের ইটি সিনেমাটি এই চিত্রনাট্যকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন। সত্যজিতের সিনেমায় ক্রুর কোনো দৃশ্য নেই। বরং তার কাজ প্রকৃত অর্থেই শিল্প যা সমকালের সিনেমায় দুর্লভ।
(লিখেছেন
)সূত্র: ইন্ডিওয়্যার